সাহিত্যের অবলম্বন মানব হৃদয়। সমগ্র বিশ্ব বস্তুময়, ভালো মন্দ, মুখ্য গৌণ প্রকৃতির অপক্ষপাত প্রাচুর্য হেতু পৃথিবীময় জড়াজড়ি করে আছে। মানব হৃদয়ের বিচিত্র ভাররসের এই বস্তুময় পৃথিবী রূপান্তরিত হয়। সাহিত্যের ধর্ম হল বাস্তব পৃথিবীকে মানসিক ও মানবিক করে তোলা। জঠরের জারক রসে যেমন খাদ্যদ্রব্যকে পরিপাকে শক্তি আহরণ করে, তেমনি হৃদয় বৃত্তির জারক রসে বাইরের জগৎ অন্তরের হয়ে যায়। চেতনার স্পর্শে যা নিতান্ত জড়বস্তু তা হয় সুন্দর। “আমারই চেতনার রঙে, চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। পান্না হল সবুজ।
বাইরের জগতের সঙ্গে মানব জগতের পথিক বিদ্যমান, মানবজগৎ জানায় সুন্দর ও পার্থক্য, অসুন্দরের ভালো মন্দের ব্যবধান, জগৎ ও জীবনের প্রবাহ অত্যন্ত পুরাতন, কিন্তু কবি একে নব নব রূপে উপলব্ধি করেন বলেই যা পুরানো তা নিত্য নবীন রূপে প্রতিভাত হয়, কিন্তু জগৎকে হৃদয়ে গ্রহণ করে বাইরে প্রকাশ করতে না পারলে তা হয়ে ওঠে অসার্থক। মানব হৃদয় তাই চিরকাল নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছে। এই প্রকাশের নাম সাহিত্য।
কবি যে অরূপকে উপলব্ধি করেন, তাকে রূপের মধ্যে প্রকাশিত করতে ভাষার মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করতে হয়। নারীর যেমন শ্রী, সাহিত্যের অনির্বচনীয়তা তেমন ছন্দ, অলংকার ও ভাষার অতীত নিগূঢ় ব্যঞ্জনায় আভাসিত হয়। এই যে ভাষাতীত ব্যঞ্জনা তার জন্য কাব্যে চিত্র ও সংগীত—এই দুই উপকরণের প্রয়োজন, চিত্রের মাধ্যমে মানব হৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং সংগীতের মাধ্যমে অন্তগূঢ় ভাবকে ব্যক্ত করা।
সাহিত্যে কেবলমাত্র মানুষের হৃদয় নয় মানবচরিত্রও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আয়ত্ত হয়। মানবচরিত্র স্থির নয়, সুসংগতও নয়। তার নানা স্তর ও বিভাগ আছে, কোথাও প্রকাশিত কোথাও অপ্রকাশিত। এবং সদা চঞ্চল ও পরিবর্তনশীল, এর অন্দরে বাইরে অবারিত গতি, তাই তাকে সম্পূর্ণ রূপে জানাও কঠিন, কিন্তু মহৎ কবিগণ তা সহজভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হন।
বাইরের জগৎ ও মানব জীবন উভয়ের মিলনে যে ঐক্যতান রচিত হয় তারই প্রকাশ সাহিত্য। এই প্রকাশ কখনও ভাষায়, চিত্রে কখনও সংগীতের সুরে, এই প্রকাশ যথাযথ হলে অনির্বচনীয়ের ব্যঞ্জনা বহুদূর প্রসারিত হয়, কবির তাই প্রবল আকাঙ্ক্ষা :
অন্তর হতে আহরিবচন
আনন্দ শোক করি বিরচণ
গীত রসধারা করি সিন
সংসার ধূলিজালে ৷
ভগবানের বিচিত্র সৃষ্টি প্রকৃতির ও মানব জীবনের সৌন্দর্যকে নিয়ে উৎসারিত। কিন্তু সৌন্দর্য প্রকাশ সাহিত্যের উপলক্ষ্য মাত্র, উদ্দেশ্য নয়, হ্যামলেট বা ওথেলার চিত্র মানব হৃদয়ের প্রকাশ। সাহিত্যে সমগ্র মানুষের পরিচয় বিধৃত। মহৎ কবিদের রচনায় মুষ্যত্বের নিরাবরহণ প্রকাশ লক্ষিত হয়। প্রকাশ সেখানে যথাযথ তার সংঘাতে মনুষ্যত্বের উদ্ঘাটন হয়, জীবনের প্রকাশ যেখানে সামগ্রিক সেখানে সুবৃহৎ অনাবরণ অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট।
বিশ্বের নিঃশ্বাস মানুষের চিত্তে রাগিণী বাছাচ্ছে, সাহিত্য তাকেই স্পষ্ট করে প্রকাশের প্রমাণ করছে। এই যে সাহিত্য তা ব্যক্তি বিশেষের নহে, রচয়িতারও নহে, তাহা দৈববাণী।” বাইরের জগৎ যেমন তার ভালো মন্দ, আসম্পূর্ণতা নিয়ে ব্যক্ত হবার প্রয়াস করে, মানুষের বাণীও সেইরকম হৃদয় থেকে সুসম্পূর্ণ রূপে বের হবার জন্য নিয়ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কবি যা সৃষ্টি করেন তা দৈবী প্রেরণার বশে, লেখক একটা অর্ধচেতন শক্তির প্রভাবে মানুষের মর্মর সিংহাসনের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়।
মানব হৃদয়কে জানতে পারলে, তার অতলান্ত, রহস্যের পরিচয় পেলে, মানব চরিত্রকে প্রকাশ করা সহজ হয়ে পড়ে। প্রাণের রঙ্গভূমিতে মানুষ আবির্ভূত হল অনেক পরে। সে তার চৈতন্যের আলোয় জড় বিশ্বকে জয় করেছে, পৃথিবী জুড়ে চলেছে মানুষের চৈতন্য প্রকাশের পালা, কবির ধর্ম হল, এই মানবচৈতন্যকে প্রকাশ করা, তার প্রকাশের বাধা অপসারিত করে দেওয়া— “পৃথিবীর নাট্যমঞে/অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা /আমি সে নাট্যের দলে/পরিয়াছি সাজ ।।”
Leave a comment