চিত্র সংগীতেই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ।
সাহিত্য রচনার সময় দুটি বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে। প্রথম হল সাহিত্য স্রষ্টা তাঁর হৃদয় দ্বারা বহির্জগৎকে কতখানি গ্রহণ করতে পেরেছেন ও অপরটি হল তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে স্থায়ী রূপ দিতে পারছেন কিনা। রচনার নৈপুণ্য তথা শৈলী ও সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই রচনা নৈপুণ্যের ফলে কবি আনেন অনুভূতি বাইরে স্থায়ী রূপ গ্রহণ করে। এই হৃদয়ের ভাব অন্যের মনে উদিক্ত করার জন্য কথা কৌশলের প্রয়োজন হয়। পুরুষের বেশভূষা সাধারণ ও যথাযথ হলেই চলে কিন্তু ‘মেয়েদের সুন্দর হওয়া চাই। সাহিত্য ও তেমন ভাবে নিজেকে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করার জন্য অলংকার, শব্দের কারুকথার আশ্রয় নেয়। নারীদেহের অলংকারকে আশ্রয় করে যেমন শ্রী ও স্ত্রী পরিস্ফুট হয়, তেমনি ছন্দ-অলংকারের সাহায্যে সাহিত্যের অনির্বচনীর প্রকাশিত হয়। ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রকাশ করার জন্যই সাহিত্য, চিত্র ও সংগীতের আশ্রয় নেয়। ভাষায় যে ভাব সহজে প্রকাশিত হয় না, তা চিত্রে সহজেই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের ভাবকে উপমা-রূপক স্বর্গে গঠিত চিত্ররীতির মাধ্যমে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। বলরাম দাসের রচিত ‘দেখিবার আঁখি পাখি ধায়’-র মাধ্যমে চিত্রের ব্যাকুলতা আশ্চর্য রূপ লাভ করেছে। সংগীতের মাধ্যমে ও কাব্যের গভীর ভাবকে সহজে প্রকাশ করা যায়। যেখানে কথার সমাপ্তি, সেখানেই গানের সূচনা, বাক্য যা বলতে পারে না, গান তাই-ই বলে। চিত্র ভাবকে রূপ দান করে ও সংগীত তার মধ্যে বেগের সঞ্চার করে। চিত্র কাব্যের দেহ ও সংগীত হল তার আত্মা।
সাহিত্য ব্যক্তি বিশেষত নহে, তাহার রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী।
বিশ্বের নিঃশ্বাস আমাদের চিত্তে প্রতিনিয়তই বাজিয়ে চলেছে রাগিণী। সাহিত্য তাকেই স্পষ্ট করে প্রকাশ করে। এই যে সাহিত্য কবি রচনা করেন, তা কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের নয়, নয় রচয়িতারও তা দৈববাণী। কবি যা সৃষ্টি করেন তা দৈবী প্রেরণার বশে। ‘ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাতে আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই যে সৃষ্টির আবেগ, সাহিত্য তারই বিকাশ। প্লেটো তাঁর ‘The Republic’ গ্রন্থে যাকে বলেছেন ‘Inspiration’ –একটা মুগ্ধ অবস্থা—এমন সময়েই সাহিত্যের জন্ম। এ প্রসঙ্গে ‘A Defence of Poetry’ -তে শেলির মন্তব্য— Poetry is Indeed Something devine’—রবীন্দ্রনাথ একেই বলেছেন দৈববাণী। বিখ্যাত কবি মনীষী এলিয়ট ও উচ্চশ্রেণির কবিতাকে যে Spiritual বলেছেন—তা এবং কবিমানস ও কবি প্রতিভাকে বিধি দত্ত বলার প্রবণতা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।
সাহিত্যের বিষয় মানব হৃদয় ও মানব চরিত্র।
বাহিরের জগৎ আমাদের মনের মধ্যে প্রকাশ করে, আমাদের হৃদয় বৃত্তির রাস জারিত হয়ে অপরটি জগৎ গড়ে তুলেছে। যাদের হৃদয়বৃদ্ধির জারকরস পর্যাপ্ত নেই তাঁরা বহির্জগৎকে বস্তুসীমার বাইরে উপলব্ধি করতে পারেন না, তারা আমাদের আলোচ্য নন, আমাদের আবিষ্ট সেই সহৃদয় মানুষ যিনি বহির্জগৎকে অন্তরে ‘আপন মনের মাধুরী মিশয়ে’ গ্রহণ করে সাহিত্যে ব্যক্ত করেন, ছন্দ-অলংকার ইত্যাদির সাহায্যে সজ্জিত করে। কিন্তু মানব হৃদয়ই সাহিত্যের একমাত্র বিষয় নয়, মানব চরিত্রকেও রবীন্দ্রনাথ অন্যতম বিষয় বলে গণ্য করেছেন। সাহিত্যের তাৎপর্য প্রবন্ধে তিনি বলেছেন—’মানুষের চরিত্রও এমন একটি সৃষ্টি যাহা জড়সৃষ্টির ন্যায় আমাদের ইন্দ্রিয়ের রূপ আয়ত্বগম্য নয়। কারণ মানব চরিত্র ধরা বাঁধার অতীত। তার লীলা এত বিচিত্র ও সূক্ষ্ম যে একমাত্র ব্যাসদেব, বাল্মীকি, কালিদাস প্রমুখ মহান কবির পক্ষেই এ কাজ সম্ভবায়িত হয়েছে। বাইরের জগৎ ও মানব চরিত্র মানুষের অন্তরে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করে তুলেছে, ভাষা-রচিত সেই চিত্র বা অনেকেই সাহিত্য বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিদিন।
আমাদের অধিকাংশ হৃদয় ভাবের এই দুইটা দিকই আছে; একটা নিজের জন্য, একটা পরের জন্য।
আমরা আমাদের আনন্দ বা শোক যখন প্রকাশ করি তখনই সঙ্গতির সীমা অতিক্রম করে যাই। যা একান্ত ভাবেই আমাদের নিজস্ব সেইখানে আমাদের প্রকাশ স্বাভাবিক সংযম রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের যে অংশ অপরের কাছে ঘোষণা, তা আনন্দই হোক, কিংবা শোকই হোক কিছুটা রাগ করে দেখানো হয়—যদিও তা অস্বভাবিক নয়, পল্লির মাতা যখন পুত্রশোকে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করেন তখন তিনি শুধু পুত্রশোক নয়, পুত্রশোকের গৌরব ও প্রকাশ করতে চান। রবীন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছেন যে নিজের সুখ দুঃখ নিজের কাছে প্রমাণের দরকার পড়ে না, কিন্তু পরের কাছে প্রকাশের কালে তা প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে। আর তাই-ই স্বাভাবিক শোক প্রকাশে যতটুকু ক্রন্দন প্রয়োজন শোক প্রমাণের জন্য তার চাইতে উচ্চস্বরে না কাঁদলে চলে না। অর্থাৎ নিজের শোক যতক্ষণ আপনার ততক্ষণ তাতে একটা সংযমের বন্ধন থাকে, কিন্তু শোক যখন অন্যের কাজে প্রকাশ করতে হয় তখন তা ‘ঘোষণা’ ফলে তাতে সংযমের বাঁধন থাকে না, এখানেই প্রাবন্ধিকের মন্তব্য শুধু শোকীতাপ নয় আমাদের সকল হৃদয় ভাবেরই দুটি দিক আছে, একটা নিজের জন্য আরেকটি পরের জন্য।
সাহিত্য ঠিক প্রবৃত্তির আরশি নহে। কেবল সাহিত্য কেন, কোনো কলা বিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুসরণ নয়।
আমাদের বহু প্রচলিত ধারণা—সাহিত্য প্রকৃতির দর্পণ। এ বিষয়ে প্রথমটির দার্শনিক প্লেটো ও তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল অভিমত দেন-এরপর বহু বাগ-বিতণ্ডা চলে আসছে এই মত নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যের বিচারকে প্রবন্ধে দর্শাতে চেয়েছেন যে——যেমন ঠিক তেমনি লিপিবদ্ধ করা সাহিত্য নহে’ সত্যকে রক্ষা করে সাহিত্য বস্তুকে বাড়িয়ে তোলাই সাহিত্যের কাজ, সাহিত্যে জীবনের ঘটনাবলির যথাযথ, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থাকে না—তার বেশির ভাগই কল্পনা। লেখকের উদ্ভাবনা—অথচ সাহিত্য কিন্তু মিথ্যাশ্রয়ী নয়। কারণ প্রকৃতিতে আমরা যা দেখি তা প্রত্যক্ষ, কিন্তু তাকে সাহিত্যে প্রকাশ করতে গেলে তাকে একটু বাড়াতে হয়, একটু কল্পনার রঙে জারিয়ে নিতে হয়। কারণ মন যা গড়ে তোলে তা নিজের আবশ্যকের জন্য, সাহিত্য যা গড়ে তোলে সকলের জন্য, অর্থাৎ মনের জিনিসকে বাইরে ফলিয়ে তুলতে গেলে বিশেষভাবে ছন্দকলার দরকার হয়। এইভাবে প্রকৃতি থেকে মনে ও মন থেকে সাহিত্যে যা প্রসিলিত হয় তা প্রকৃতির হুবহু অনুকরণ নয়। তাই বলা হত শুধু সাহিত্যে কেন কোনো কথাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুসরণ বা আপশ নয়।
জগতের ওপরে মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের ওপর বিশ্বমানবের কারখানা—সেই ওপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি।
কবির দৈবী প্রেরণার সাহায্যে কাব্য রচনা করেন। এই সাহিত্য রচনার রস বা প্রাথমিক উপাদান আমরা বর্হিপ্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করি। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আমাদের স্বল্প পরিচিত। এমনকি আমাদের পরমাত্মীর ও তাঁর সম্পূর্ণটি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হন না। অনেক ফাঁক ও ফাঁকি থাকে—যাকে আমরা সাহিত্যে রূপদান করার সময় আপন কল্পনায় সম্পূর্ণতা দিই। বাস্তবে যার পরিচয় নানা তুচ্ছতা ও অসংগতিতে ভরা, সাহিত্যে তার জীবনের সার্থক প্রকাশ দেখে আমরা আনন্দিত হই। সাহিত্য আমাদের যা জানায় তা সম্পূর্ণ ভাবেই জানায়—অর্থাৎ শূন্যতাকে পূর্ণতা দিয়ে অন্তরকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণতা রক্ষা করে। সাহিত্য মানবজীবন থেকে উপবাস সংগ্রহ করার পর তা গ্রহণ করে সাহিত্য স্রষ্টার মন। এই মনেরই অপর সত্তা হল বিশ্বমানব মন—তা থেকে গ্রহণ বর্জন করে কল্পনায় ও অনুভূতিতে তা পরিপূর্ণ করে প্রকাশ করে। অর্থাৎ ‘মন সাধারণত প্রকৃতি’র মধ্য হইতে সংগ্রহ করে, সাহিত্য মনের মধ্য হইতে সঞ্চয় করে। এই মনের জিনিসকে সৃজনী প্রতিভার নূতন করে গড়ে তোলা হয়। সুতরাং লক্ষণীয় যে বাস্তব জগৎ ও সাহিত্য সৃষ্টি এর মধ্যে মন ও বিশ্বমানব মন রূপী দুটি স্তর আছে। আমাদের অন্তরে দুটি অংশের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। একটি হল নিজস্ব ও অন্যটি হল মানবত্ব। লেখক তার তখন কল্পনা শক্তির সাহায্যে এই দুয়ের যোগ সাধন করে থাকেন। সাহিত্য স্রষ্টার মানবত্ব-ই আসল স্রষ্টা—সে লেখকের নিজস্বকে আপন করে, যা ক্ষণিক তাকে চিরন্তনের মর্যাদা দেয়। ‘জগতের ওপরে মনের কারখানা বসিয়াছে’—এই জগৎই সাহিত্য সৃষ্টি উপাদানের উৎস স্থল। এই উপাদানকে মন সংগ্রহ করে থাকে ও বিশ্ব তার কাছ থেকে নির্বাচন করে। সুতরাং ‘সেই ওপরের তলা থেকে সাহিত্যের উৎপত্তি’ অর্থাৎ সাহিত্য = প্রকৃতি জগৎ + মন + বিশ্বমন। এই জন্যই সহিত্য চিরকালের ত চিরন্তন।
সৌন্দর্য মূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং মঙ্গল মূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বরূপ/ সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলের সম্পর্ক।
আমাদের ব্যবহারিক জীবনের মঙ্গলের সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। মঙ্গল শুধু আমাদের মঙ্গল সাধনই করে না, তা অহৈতুকী বলে সুন্দরও, নিছক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে তার স্থানে। যা প্রয়োজন মেটায় তা কিছুতেই সুন্দর হতে পারে না, তাহলে কিংবা ভোগ্যসামগ্রী শুধুই আমাদের কেজো প্রয়োজন মেটায় বলে তার কোনো সৌন্দর্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু স্বেচ্ছায় রামচন্দ্রের সাথে লক্ষ্মণের বনবাস অমানব শঙ্কা আমাদের হৃদয়কে পুলকিত করে। এই-ই হল সুন্দর। আর এই সৌন্দর্যের মধ্যে মঙ্গল নিহিত আছে। সৌন্দর্য যেহেতু আমাদের সাংসারিক সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে আর তাতেই তার ঐশ্বর্য লক্ষ করা যায়। মঙ্গলের মধ্যেও সেই ঐশ্বর্য বিদ্যমান। কোনো বীরপুরুষ যখন এই আদর্শের জন্য নিজ প্রাণ বিসর্জন দেয়, তখন তার সৌন্দর্য আমাদের আর্বিভূত করে। এই সৌন্দর্যের মধ্যে মঙ্গল বিরাজমান। সৌন্দর্যবোধের মতো মঙ্গলও আমাদের স্বেচ্ছাকৃত ত্যাগে অনুপ্রাণিত করে। যে ব্যক্তি আপন স্বার্থে নিমজ্জিত, সে মঙ্গল সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারে না। স্বার্থপর মানুষ নিজ সংকীর্ণ হৃদয়ের মধ্যে নিজে সংকুচিত থাকে। কারণ সে শুধুই উপস্থিতকে তথা বর্তমানকে নিয়েই মত্ত হয়ে থাকে। কিন্তু উপস্থিতের ঊর্ধ্বে মানুষকে গ্রহণ করার শিক্ষা তার হয়নি। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এও যে দেখি যেখানে প্রেমময়ী নারী জননী হয়েছেন, প্রবৃত্তির বিক্ষোভ যেখানে বেদনার তপস্যায় অগ্নিশুদ্ধ হয়েছে, সেখানেই রাজদম্পতির মিলন সার্থক হয়েছে। এই কাব্যে কবি মঙ্গলের সাথে সৌন্দর্যের পরিচয় প্রকাশ করেছেন। সৌন্দর্য যেখানে সম্পূর্ণতা পায়, সেখানে কোনো প্রলয়ভতা থাকে না সৌন্দর্য এখানেই সৌন্দর্যকে আমরা মঙ্গলের সাথে এক কীর্তি দেখি। ভোগ বিলাসের সাথে তার সৌন্দর্যের কোনোই সম্পর্ক থাকে না। সংযত মন ও দুটি নিয়ে দেখলে আমরা সৌন্দর্যের অন্তরে অবস্থিত পরম ও মঙ্গলকে উপলব্ধি করতে পারি। অর্থাৎ ভাবদৃষ্টি বা শান্ত সমহিত পরম মঙ্গলকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। অর্থাৎ ভাবদৃষ্টি বা শান্ত সমহিত দৃষ্টিতে দেখলেই সেই সুন্দর ধরা দেয়, যার মধ্যে মঙ্গল বিরাজমান।
Leave a comment