আমাদের হৃদয়-ভাবের দুটো দিক রয়েছে একটা নিজের জন্য, আর একটা অপরের জন্য। নিজের জন্য হৃদয়-ভাবের যে প্রকাশ ঘটে, তাতে একটা স্বাভাবিক সংযম থাকে, কিন্তু পরের জন্য যখন তা’ প্রকাশ করতে হয়, তখন স্বভাবতঃই তা অতিকৃত হয়ে থাকে। নিজের হৃদয়ভাবকে অনেকটা বাড়িয়ে প্রকাশ না করতে পারলে তা যদি বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে অপরের নিকট গ্রহণযোগ্য না হয়—এই আশঙ্কাতেই অনেক সময় সঙ্গতির সীমা ছাড়িয়েই প্রকাশ করা হয়, উদ্দেশ্য—এর ফলেই ব্যক্তির হৃদয়-ভাব সাধারণের হৃদয়ভাবে পরিণত হয়ে গৌরব অর্জন করবে। এই কারণেই পুত্রশোকাতুরা মাতার বিলাপের সুরও যথেষ্ট চড়া হয়। পুত্রের মৃত্যুতে জগতের হয়তো কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না, কিন্তু তাতে মাতৃহৃদয় যে কত ক্ষতিগ্রস্ত হল, তার উচ্চকণ্ঠে বিলাপের দ্বারা ‘তখন সে নিজের শোকের প্রবলতার দ্বারা এত ক্ষতির প্রাচুর্যকে বিশ্বের কাছে ঘোষণা করিয়া তাহার পুত্রকে যেন গৌরবান্বিত করিতে চায়!’ যা বস্তুগতভাবে সত্য, তাকে অপরের নিকট প্রকাশ করায় কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু যা একান্তভাবেই আমার উপলব্ধিগত সত্য, তাকে অপরের নিকট প্রমাণ করতে গেলে তার উপর অযথা গুরুত্ব আরোপ করারই প্রয়োজন দেখা দেয়।
তাই, লেখক প্রকৃতি থেকে যা উপলব্ধির সাহায্যে গ্রহণ করেন, তা তার নিকট প্রত্যক্ষগোচর হলেও যখন তিনি তা সাহিত্যের মাধ্যমে অপর ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করেন তখন পাঠকের নিকট প্রকৃতি আর প্রত্যক্ষগোচর নয় বলেই তাকে অনেকটাই বাড়িয়ে প্রকাশ করতে হয়। তার সাহিত্যকে প্রকৃতির যথাযথ অনুকৃতি বলা যায় না। প্রাকৃত সত্যে এবং সাহিত্য সত্যে এই পার্থক্য চিরকাল স্বীকৃত হয়ে আসছে বলেই সাহিত্য কিংবা কোনোপ্রকার কলাবিদ্যাকেই প্রকৃতির আদর্শ মনে করা হয় না। লেখকের নিকট প্রকৃতি প্রত্যক্ষ হলেও পাঠকের নিকট তা অপ্রত্যক্ষ বলেই লেখককে তাহা প্রত্যক্ষবৎ করে তুলতে হয় এবং এর জন্যই বহু শূন্যতা ও অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে, বিক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্তকে যথাসম্ভব সংহত করে যখন তিনি প্রাকৃত সত্যকে সাহিত্য সত্যে রূপান্তরিত করেন, যেন তা’ অধিকতর সত্য হয়ে ওঠে। মানুষের ভাব সম্বন্ধে প্রাকৃত সত্য জড়িত-মিশ্রিত ভগ্নখণ্ড, ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে সাহিত্যে সত্যকে আমরা সম্পূর্ণরূপে জানতে পারি। প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “মন প্রাকৃতিক জিনিসকে মানসিক করিয়া লয়; সাহিত্য সেই মানসিক জিনিসকে সাহিত্যিক করিয়া তুলে।”
প্রকৃতি থেকে মনে এবং মন থেকে সাহিত্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি একই রকম হলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃতি থেকে মন যা গ্রহণ করে, তা শুধু নিজের জন্য, আবার মন থেকে যখন তা সাহিত্যে রূপান্তরিত করা হয়, তখন তা করা হয় সর্বসাধারণকে আনন্দ দানের জন্যই! একটা বিশেষ সৃজনশক্তির সহায়তায় মনের জিনিসকে বাইরে প্রকাশ করা হয় বলে প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কটা অনেক দূরবর্তী হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লেখক সাহিত্য রচনা করলেও সেই সৃষ্টি সাহিত্য কিন্তু বর্তমান কিংবা সমকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষণকালের উপাদান নিয়েই লেখক যে সাহিত্য রচনা করেন, তা শুধু চিরকালেরই নয়। রবীন্দ্রনাথ সেই সাহিত্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, “অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।”
জগতের সঙ্গে মনের এবং মনের সঙ্গে সাহিত্যিকের প্রতিভার সম্পর্কটি বুঝতে হলে আমাদের মনের দ্বিবিধ সত্তা-বিষয়ে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা আমাদের অন্তরের মধ্যে দুটো অংশের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। একটি অংশ নিজস্ব, অপরটি মানবত্ব। এ দুয়ের মধ্যে যে ব্যবধান, তাতে রয়েছে কল্পনার কাচের শার্সির স্বচ্ছতা—যাতে দুই অংশের চেনাশোনার কোনো ব্যাখ্যাতত্ত্বে ঘটেই না, বরং দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণের মতোই এই কাচ অদৃশ্যকে দৃশ্য এবং দূরকে নিকট করে। লেখক বা সাহিত্যিকের এই মানবত্ব অংশই সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টি করে থাকে। এই মানবতই নিজত্বকে আপন করে নেয়, ক্ষণিককে চিরকালের করে তোলে এবং খণ্ডকে দান করে শূন্যতা। এই প্রাকৃত জগৎকে গ্রহণ করছে আমাদের নিজস্বতা, সেই নিজস্বতা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মানবত্ব, যার অপর নাম বিশ্বমানবমন—এবং সেখানেই চলছে সাহিত্য সৃষ্টির কারখানা।
মনের দিক থেকে সত্যতা বিচার খুব কঠিন কাজ। প্রাকৃত জগতে যা বস্তুঘটিত, তার সত্যাসত্য-নির্ণয়ে অসুবিধে নেই। তাই যা কালো, তা’ সবার নিকট কালো; কিন্তু যা ব্যক্তি-ঘটিত, সেখানে ঐক্যমত্য লাভ কষ্টকর, তাই একের ভালো অপরের নিকট ভালো না-ও হতে পারে। এই ভালোর বিচারের জন্য সর্বাধিক লোকের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য তো শুধু বর্তমানের উপর নির্ভর করা চলে না। এই কারণেই সাহিত্যিকের লক্ষ্য রাখতে হয় চিরকালের মনুষ্যসমাজের প্রতি। তাৎকালিক এবং তাৎসস্থানিক পাঠকসমাজের বিচারের উপর নির্ভর করলে তাতে অবিচার হবার সম্ভাবনাই থেকে যায়।
শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বলা যায় তাকেই যা’ দেশ-কালের সীমা লঙ্ঘন করেও আপন মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সমকালের বিচারকে অগ্রাহ্য করা চলে না। হাইকোর্টের আপিল আদালতে শেষ মীমাংসার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয় বলে তো জজকোর্টের বিচার বন্ধ রাখা চলে না, শেষ বিচারে তা বাতিল হলেও সমকালীন বিচারকেও মেনে নিতে হয়।
সাহিত্যিকের মতোই সাহিত্য-বিচারকের প্রতিভাও হতে পারে দেশকালাতিশায়ী। সাহিত্যে যা সত্য, ধ্রুব, তা কখনও তাঁর দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাঁরা সাহিত্যের নিত্যত্বের লক্ষণ যাচাই করেই তাদের দেহে স্থায়িত্বের চিহ্ন মুদ্রিত করে দেন। এ জাতীয় সাহিত্য-বিচারকরাই স্বভাবে ও শিক্ষায় সর্বকালের বিচারকের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে থাকেন। আবার পুথিগত বিদ্যার অধিকারী ব্যবসাদার বিচারকরা সাহিত্যের বহিঃশোভাতেই বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন; সাহিত্যের অন্তঃপুরের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে না। কিন্তু যারা সাহিত্যের প্রকৃত সেবক, দেউড়ির দারোয়ানদের দ্বারা যথার্থ মর্যাদাপ্রাপ্ত না হলেও সরস্বতীর দরবারে তাঁরা কখনও অনাদৃত হন না।
Leave a comment