সাহিত্য বা শিল্পের ইতিহাসকে বুঝতে হলে দেশকালের প্রেক্ষিতের প্রয়োজন। দেশ-কালের বহতা ধারা দিয়ে প্রবাহিত হয় জীবনস্রোত। আর এই জীবনস্রোতকে অবলম্বন করেই সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব হয়। সমাজ যখন নতুন নতুন পর্বে মোড় ফেরে, তখন সাহিত্য তার রূপ ও রীতি নিয়েও মোড় ফেরে। নতুন জীবনযাত্রার আশা জাগে, নতুন জীবনযাত্রার চিত্রও ফুটে ঠ। সাহিত্যশিল্প এই জীবন ও জীবনধারাকে তাদের সৃষ্টি সম্ভারে প্রস্ফুটিত করে তোলে। এই কারণে সমালোচকরা বলেন, সাহিত্যবিচারে ঐতিহাসিক বিনয় প্রয়োজন। ‘ঐতিহাসিক বিনয়’ বলতে ইতিহাসের করাল গ্রাস সম্পর্কে বিনয়বোধ, সম্ভ্রমবোধ ও শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা দিয়ে ইতিহাসকে দেখতে পারলেই কবিকে বা শিল্পীকে জানা যায়। কবি বা শিল্পী সমাজের নানা টানাপোড়েনের ফলেই এগিয়ে যান। তাই ইতিহাসের বা কালের ছবি যাকে আমরা অনেক সময় বলি যুগধর্ম বা ‘কালধর্ম’ তার কথা ফুটে ওঠে কাব্যে শিল্পে।

প্রতি যুগের সাহিত্য তার পরবর্তীযুগের সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। যুগ থেকে যুগ পর্যন্ত সাহিত্যের বহতা ধারা গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সাহিত্যে রূপ লাভ করে। একেই বলে সাহিত্যশিল্পের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারের জন্য প্রয়োজন Tradition বা ঐতিহ্য। মানবসম্পর্ক নিয়ে সাহিত্য, যুগে যুগে এই মানবসম্পর্কের সমস্যা আমাদের চিন্তিত করে। Humayun Kavir একটি প্রবন্ধে—”Human Relations and Democracy”-তে এই সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন : ‘Problems of human relations affect every one of us at every moment of our lives. One may indeed say that the whole of human experience is a continual study and adjustment in human relations.” (Chap. XXIII-Towards & Sociology of Culture in India P-352)। মানুষের সম্পর্কে অভিযোজনই সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের সংস্কৃতির ইতিহাসে যুগে যুগে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তাতে এই মানবসম্পর্কের অভিযোজনই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নিষ্ফলতা ও সাফল্যের মধ্যেই এই অভিযোজন ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ধারায় ঈশ্বর গুপ্তকে প্রণিধান করতে গেলে দেশজ সংস্কৃতির ইতিহাসকে জানতে হবে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় নব্যশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নতুনভাবের সৃষ্টি করেছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই সাহিত্যের পটভূমিকে বুঝতে গেলে প্রাচীন সাহিত্যের ধারাকে জানতে হবে। ঐতিহাসিক বিনয় ছাড়া এই পটভূমিকে জানা যাবে না। ঈশ্বর গুপ্ত যে ধারার স্রষ্টা, সেই ধারার গতি ও দ্বন্দ্বকে জানা প্রয়োজন। এই কারণে “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি, ঈশ্বর গুপ্ত বাংলার কবি।” লেখক বঙ্কিমের এই মতামত ঐতিহাসিক বুদ্ধির প্রমাণ। বাংলার জনসমাজের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে যাবার প্রয়োজনে ঈশ্বর গুপ্তের ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রয়োজন। দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধনের কথা জানার জন্য ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাবলী পাঠ ও চর্চার প্রয়োজন। “দেশজ ঐতিহ্যের সন্ধান আজকে তার প্রথম পর্ব।” প্রথম পর্বের এই ভাবনাকে বুঝতে না পারলে বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিকে বোঝা যাবে না। দেশজ ঐতিহ্যকে বুঝতে গেলে লোকশিল্প বা সাহিত্যকে প্রণিধান করতে হবে। পাহাড়পুরের শিল্প নিদর্শন থেকে গ্রামাঞ্চলের যে-সব নিদর্শন গ্রাম বাংলার মেলায় মেলায় দেখা যায় সে-সব বহির্জগতের বস্তু সম্বন্ধে সুস্থ মনোভাবের দৃষ্টান্ত। একে লেখক বলেছেন, “সুস্থ মনোযোগের প্রমাণ।” “চণ্ডীকাব্যে, মঙ্গলকাব্যে এমনকি বৈষুবপদাবলীতেও এই স্বাস্থ্য” লেখককে বিস্মিত করেছে। চণ্ডীকাব্য, মঙ্গলকাব্য, লোকশিল্প ও গ্রামীণ সাহিত্যের যে ধারা বাংলায় শিষ্ট সমাজের সাহিত্যের অন্তরালে বহমান, তাই ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে স্পষ্ট। পুরাতন ও নতুনের সন্ধিস্থলের কবি ঈশ্বর গুপ্ত। ব্রিটিশ-পূর্ব শিল্পসাহিত্যের উৎস যে প্রাচীন সাহিত্যলিপ্সা, তাই বিকশিত হয়েছে ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে। শিল্প সমাজের নব্যশিক্ষিত তরুণদের সাহিত্যে যে আধুনিক মানস আছে তার প্রতি ঈশ্বর গুপ্তের কৌতূহল বা আগ্রহ ছিল। এই কৌতূহল বা আগ্রহ ঈশ্বর গুপ্তের কবি মানসের বৈশিষ্ট্য। ইংরেজি নববর্ষ কবিতায় দ্বৈতধর্মী বস্তুবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই দ্বৈতবাদকে বুঝতে হলে উত্তরাধিকারকে বুঝতে হবে। এই উত্তরাধিকারকে বুঝতে গেলে ঐতিহাসিক বোধের প্রয়োজন। আর এই ঐতিহাসিক বোধের জন্য প্রয়োজন ঐতিহাসিক বিনয়। বিদ্যার প্রতি ইতিহাসের প্রতি বিনয়নম্র মনোভাবই ভাবুক ও লেখকের প্রধান সম্পদ। বিষ্ণু দে ঈশ্বর গুপ্তের কার্যাবলী পাঠের প্রয়োজনীয় পটভূমিকাকে পর্যালোচনার জন্য এই উক্তি করেছেন।