অথবা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে হবস, লক ও রুশাের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোনাে রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলাে সার্বভৌমিকতা। যেকোনাে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চারটি উপাদানের মধ্যে সার্বভৌমত্বই হলাে অন্যতম। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন মত প্রদান করেছেন। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলেন হবস, লক ও রুশাে। সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে হবস-এর ধারণাঃ সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবস তার অমর গ্রন্থ ‘লেভিয়াথানে’ সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা প্রদান করেছেন। ইংল্যান্ডের তৎকালীন বিরাজমান অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তিনি লেভিয়াথান গ্রন্থে শাসকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পক্ষে জোরালাে সমর্থন জানাতে গিয়ে চরম ক্ষমতাধর সার্বভৌম শাসকের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ধারণা ব্যক্ত করেন।
হবসের মতে- ‘জনগণ যেহেতু তাদের অধিকার, কর্তব্য, শান্তি, নিরাপত্তা প্রভৃতির জন্য আইন প্রণয়নের ভার একটি ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তাই সেই ব্যক্তি বা গােষ্ঠী জনগণের অধিকার, কর্তব্য ও শান্তি-শৃঙ্খলা নিরূপণের জন্য যে সমস্ত বাধ্যতামূলক আইন পাস করে থাকেন তাই সার্বভৌম শক্তি।’ হবস সার্বভৌমত্বকে সব রকম সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হবসের সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যঃ হবস সার্বভৌম তত্ত্বের কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন যা নিয়ে দেয়া হলাে-
(১) হস্তান্তর অযােগ্যঃ হবসের মতে, সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য, স্থায়ী ও হস্তান্তরের অযােগ্য।
(২) নিয়ন্ত্রণমুক্তঃ তার মতে, সাধারণত সার্বভৌম শক্তি সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।
(৩) সার্বভৌম শক্তিঃ তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম শক্তিই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী।
(৪) বিরােধিতাহীনঃ হবসের ধারণা, সার্বভৌম শক্তির বিরােধিতা করার কোন অধিকার জনগণের নেই।
(৫) সার্বভৌমত্বের জন্মঃ হবসের মতে, মূলত সার্বভৌমত্বের জন্ম হয়েছে জনগণের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে।
(৬) সার্বভৌম ক্ষমতাধিকারীঃ তার ধারণা মতে, আইন এবং প্রজাদের অধিকারও সার্বভৌম শক্তির দ্বারাই প্রদত্ত হয়।
(৭) অধিকার নিশ্চিতকরণঃ তার ধারণা, জনগণের অধিকার, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই সার্বভৌম শক্তির জন্ম হয়েছে।
(৮) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ হবস মনে করেন, সার্বভৌম শক্তি হলাে সকল অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্মদাতা।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে লকের ধারণাঃ সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক জন লক আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত। তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘টু ট্রিয়েটিজ অন সিভিল গভর্নমেন্ট’-এ সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেছেন। লকের মতে, “শাসকের নিরংকুশ ক্ষমতা থাকবেনা।” জন লকের সার্বভৌমত্বের ধারণা তার সামাজিক চুক্তি ধারণা থেকে উদ্ভূত। চুক্তিবাদের মাধ্যমে লক জনগণকে সরকারি ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস বলে ধারণা ব্যক্ত করেন। এ চূড়ান্ত ক্ষমতাই সার্বভৌম ক্ষমতা। জনগণ জিম্মাদার হিসেবে এ ক্ষমতা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে বলে সরকার জনগণের আজ্ঞাবহ ও অধীন। তিনি সরকারের জিম্মাদার বলে যে ধারণা প্রদান করেছেন তাতে শুধু জনগণেরই অধিকার আছে, সরকারের বা শাসকের কোন অধিকার নেই। সুতরাং তিনি সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে একটি গণতান্ত্রিক ধারণা পেশ করেন।
জন লকের সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যঃ লকের সার্বভৌম তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য নিম্নে দেয়া হলাে-
(১) সার্বভৌমের জন্মঃ লকের মতে, সার্বভৌমের জন্ম হয়েছে জনগণের সম্মতিতে।
(২) সার্বভৌমের স্বরূপঃ তার মতে, সার্বভৌম কোনাে বিশেষ ব্যক্তি নয়, ব্যক্তিসমষ্টি।
(৩) সার্বভৌমের ক্ষমতাঃ তিনি মনে করেন, সার্বভৌমকে শাসন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কিন্তু সার্বভৌম অন্যায়ভাবে শাসন করলে জনগণ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
(৪) জনগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিতঃ জন লকের ধারণা, সার্বভৌম ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ও জনগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
(৫) সার্বভৌমের ধারণা গণতান্ত্রিকঃ জন লকের সার্বভৌমত্ব ছিল গণতান্ত্রিক। তিনি সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে গণতান্ত্রিক ধারণার পক্ষপাতী ছিলেন।
(৬) শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণঃ লকের সার্বভৌমত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। তিনি সার্বভৌমত্বে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার বিরােধী ছিলেন।
(৭) সরকার ও জনগণের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়াঃ লকের সার্বভৌমতত্ত্ব সরকার ও জনগণের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে রুশাের ধারণাঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর অবিসংবাদিত ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশাে তার অমর গ্রন্থ ‘দি সােস্যাল কন্ট্রাক্ট’-এ সার্বভৌম তত্ত্বের ধারণা ব্যক্ত করেন। তার মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমাজই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। “চুক্তি অনুসারে সকলেই তাদের অধিকার সকলের কাছে সমর্পণ করে একটি সাধারণ ইচ্ছার অধীনে এলাে।” রুশাের মতে, সাধারণ ইচ্ছাই সার্বভৌম ক্ষমতা।
রুশাের সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে রুশাের সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যগুলাে উল্লেখ করা হলাে-
(১) সার্বভৌমের জন্মঃ রুশোের মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমেই সার্বভৌম শক্তির জন্ম হয়েছে।
(২) সার্বভৌম ক্ষমতাঃ তার মতে, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ও জনগণ কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতাই সরকার প্রয়ােগ করে থাকে।
(৩) হস্তান্তর অযােগ্যঃ রুশাের ধারণা, সাধারণ ইচ্ছা সার্বভৌম হলে এটি চূড়ান্ত, স্থায়ী, চিরন্তন, অবিভাজ্য এবং অহস্তান্তরযােগ্য।
(৪) সার্বভৌমের স্বরূপঃ তিনি বলেন, আইনে সাধারণ ইচ্ছা’র প্রকাশ ঘটে ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থেকে যায়।
(৫) ভ্রান্তিহীনঃ রুশাের মতে, সার্বভৌমত্বভ্রান্তিহীন। সার্বভৌমতু কখনাে অন্যায় করে না। এই ক্ষমতা জনগণের সাধারণ ইচ্ছার মাধ্যমে রুপ লাভ করে। আর এ সাধারণ ইচ্ছা সর্বদা সমাজের কল্যাণসাধনে নিয়ােজিত থাকে।
(৬) অবিভাজ্যতাঃ সার্বভৌমত্বের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলাে অবিভাজ্যতা। কেননা একে বিভক্ত করার অর্থ হলাে একে ধ্বংস করা। রুশাের মতে, সার্বভৌম শক্তিকে ভাগ করার অর্থ দেহকে ভাগ করা।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে, হবস, লক ও রুশাের ধারণা এক যুগান্তকারী অবদান। হবস আইনগত সার্বভৌমত্ব, লক রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও রুশাে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রবক্তা হিসেবে মর্যাদার আসনে আসীন ছিলেন। যে যাই বলুক না কেন সার্বভৌমত্ব যে কোন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
Leave a comment