রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সাবেকী তত্ত্ব বা একত্ববাদ: আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার উৎপত্তি ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে নিহিত আছে। বদ্যা, হস, বেন্থাম প্রমুখ দার্শনিকদের লেখায় অখণ্ড, চরম, অবাধ ও অসীম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমি কতার এই ধারণা একত্ববাদ (Monism) নামে পরিচিত। একে সার্বভৌমিকতার সাবেকী তত্ত্ব (Traditional or Classical Theory)-ও বলা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন অস্টিন-এর হাতে এই মতবাদ পূর্ণতা লাভ করে। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার কেন্দ্রীকরণের নীতি বা রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কথা বলা হয়। প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা হল মৌলিক, নিরঙ্কুশ ও অসীম। এই ক্ষমতার দুটি দিক আছে—আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে রাষ্ট্রের নির্দেশ বা আইন হল অপ্রতিহত ও চূড়ান্ত। প্রাকৃতিক আইন, জনগণের প্রাকৃতিক অধিকার প্রভৃতি এর উপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। একে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা বলে। বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে বোঝায় যে, রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন; স্বাধীনভাবে ও স্বেচ্ছায় পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনা করবে এবং অন্য কোন রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে পরিচালিত হবে না। রাষ্ট্র সব রকম বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবে কাজ করবে। প্রকৃত প্রস্তাবে বাহ্যিক সার্বভৌমিকতাকে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতার অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে দেখা হয়।

কোন রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আন্তর্জাতিক সমাজের উপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রভাব পড়ে। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক সমাজের কোন পরিবর্তনজনিত প্রতিক্রিয়া রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সমাজ ও তার সমস্যাদির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সমস্যা বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।

অপ্রতিহত ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসম্পর্কিত বিষয়াদি পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া দরকার। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি কোন রাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে না। পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে কোন রাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না। যদি তা হয়, তা হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়কে আটকান যাবে না। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সাবেকী ধারণা মানবজাতির তথা মানবসভ্যতার স্বার্থের পরিপন্থী। কারণ অবাধ ও অপ্রতিহত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরম-চূড়ান্ত এবং অবাধ-অপ্রতিহত ক্ষমতাকে স্বীকার করার অর্থ একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারকে স্বীকার করা। তা হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ ও যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হবে। রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমিকতা স্বীকার করলে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। তা ছাড়া যে-কোন রাষ্ট্রই হল নির্দিষ্ট শ্রেণী-সম্পর্কের প্রতিভূ। রাষ্ট্র মাত্রেই তার সার্বভৌম ক্ষমতার দ্বারা এই শ্রেণী-সম্পর্ককে সংরক্ষণের চেষ্টা করে। আবার সাম্প্রতিককালে কেবলমাত্র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ পেয়ে থাকে।

বর্তমান আন্তর্জাতিক-তার যুগে রাষ্ট্রীয় সার্বৗেমিকতার ধারণা অসঙ্গত: বিংশ শতাব্দীর বর্তমান পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার এই ধ্রুপদী ধারণা অনেকাংশে অচল হয়ে পড়েছে। এখনকার জটিল সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হব্স-অস্টিনের সার্বভৌমিকতার পরম্পরাগত মতবাদ গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয় না। আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা সকল রাষ্ট্রকেই অল্পবিস্তর অনুসরণ করতে হয়। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থাতেও আন্তর্জাতিক বিধি-ব্যবস্থার কিছু কিছু গ্রহণ ও প্রয়োগ করে। আবার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation)-এর মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বৈদেশিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার অপ্রতিহত প্রয়োগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। তবে একথা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক আইন কোন সার্বভৌম শক্তির আদেশ নয় এবং প্রকৃত বিচারে ও পরিপূর্ণ অর্থে আইন নয়। আন্তর্জাতিক আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রকে শাস্তি দেওয়া যায় না।

সাম্প্রতিক প্রবণতা: কিন্তু সাম্প্রতিককালের প্রবণতা হল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠন করা ও রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্বের দত্তকে সংযত করা এবং আন্তর্জাতিক আইনকে দৃঢ়ভিত্তিক করা। এখন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনকে কার্যকর করার ব্যবস্থা আছে। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক আইনের উপযোগিতার উপলব্ধি রাষ্ট্রগুলিকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রের অবাধ কর্তৃত্বের উপর সীমা টেনেছে। রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্ব মেনে নিলে এবং চরমত্বের ধারণা স্বীকার করলে মানবসভ্যতার ধ্বংস আটকান যাবে না। ল্যাস্কি (Harold Laski) মন্তব্য করেছেন: “The full implications of sovereignty in this context are a licence to wreck civilisation.”

পারস্পরিক নির্ভর-শীলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা অস্তিত্বহীন: আধুনিক যুগের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বিচারে কোন রাষ্ট্রই পুরোপুরি বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অধিকারী হতে পারে না। বর্তমানে পৃথিবীকে কয়েকটি রাষ্ট্রের সমষ্টি হিসাবে মনে করা যায় না। বর্তমানে পৃথিবী হল বিভিন্ন দেশের মানুষ নিয়ে গঠিত এক বিশ্বজনীন সম্প্রদায়। এখন কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রাষ্ট্রগুলি এখন বিভিন্ন কারণে এবং নানাভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতা ছাড়া কোন রাষ্ট্রই চলতে পারে না। জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন অচল। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের উপর এত বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে কোন রাষ্ট্রই পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে খেয়াল-খুশীমত আচরণ করতে পারে না। যে কোন রাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীন আচরণ অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বার্থ ও শাস্তির প্রতিকূল। অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বার্থ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও অধিকারের দিকে নজর রেখে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মানব সমাজে সকল স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা প্রত্যেকের স্বাধীনতার সীমা নির্ধারিত হয়। সকলকে স্বাধীন হতে হবে বলেই কারও স্বাধীনতা অবাধ হতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এই নীতি প্রযোজ্য হয়।

বৈদেশিক ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অবাধ নয়: অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বার্থ ও অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অবাধ ও অপ্রতিহত হতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় বা স্থানীয় বিষয় তার নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। কিন্তু যে সকল বিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, সেই সমস্ত বিষয়ে কোন রাষ্ট্রই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করতে পারে না। প্রতিটি রাষ্ট্র এখন এক বিশ্বসমাজ (World Community)-এর অংশ। প্রত্যেক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও ভালমন্দের সঙ্গে এই বিশ্বসমাজের অভাব-অভিযোগ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বর্তমান যুগে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হবে। কারণ কোন রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে টিকে থাকতে পারে না।

যুদ্ধের আশংকার অবসানের জন্য রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিলোপ বাঞ্ছনীয়: বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ণ অগ্রগতি ও বিকাশ ঘটেছে। তারফলে একদিকে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সম্ভার সমৃদ্ধ‌ হয়েছে, অপরদিকে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের ভাণ্ডার বৈচিত্র্যে এবং মারণক্ষমতায় ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এখনকার যুদ্ধ মানে আণবিক যুদ্ধ। আর আণবিক যুদ্ধ মানে সভ্যতার সামগ্রিক বিনাশ। এই অবস্থায় বৈদেশিক ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাকে স্বীকার করা যায় না। কারণ বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা স্বীকার করে নিলে, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার নামে বিশ্বজুড়ে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ সাধনের জন্য নানাভাবে উদ্যোগী হবে এবং বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলবে। তা ছাড়া, পুঁজিপতি রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত শিল্পসম্ভার ও অস্ত্রশস্ত্র বিক্রয়ের জন্য দরিদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলিতে বাজার স্থাপনের চেষ্টা করে। ঔপনিবেশিকতার সাম্রাজ্যবাদী পথেই এই শতাব্দীতেই দু’দুটি মহাসমর মানবসভ্যতাকে বিপন্ন করেছে। এই রকম পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে স্বীকার করার অর্থ হল তৃতীয় একটি ভয়াবহ বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে মানবসভ্যতাকে জোর করে ঠেলে দেওয়া। আজকের পারমাণবিক যুগে যুদ্ধকে বিলোপ করতে হবে, তা না হলে যুদ্ধই মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করবে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েবী (Arnold Toynbe) বলেছেন: “In the atomic age if we do not abolish war, war is going to abolish us.”

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা নিয়ন্ত্রণের কারণ: বর্তমানে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজ নিজ সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উদ্দেশ্য ও নীতিগত পার্থক্য আছে। দুর্বল ও উন্নতিকামী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি জানে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার অপ্রতিহত রূপটিকে স্বীকার করে নেওয়া যায় না। কারণ তা হলে তাদের নিজেদের সামগ্রিক অগ্রগতি ও বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে। এই কারণে তারা নিজেদের অস্তিত্ব ও অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখার জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার মাধ্যমে চলতে চায়। শক্তিধর ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে অন্য উদ্দেশ্য কাজ করে। ধনতান্ত্রিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আগেকার প্রচলিত পথে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ বজায় রাখতে পারে না। এই অবস্থায় এই রাষ্ট্রগুলি অনুন্নত ও উন্নতিকামী দেশগুলিকে শর্তাধীন আর্থিক সাহায্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে, গোয়েন্দা ও সামরিক সাহায্য দিয়ে পুতুল সরকার গঠন করে ও আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, আঞ্চলিক ও সামরিক জোট গঠন করে প্রভৃতি। এ সব হল পুঁজিবাদী দেশগুলির নয়া-উপনিবেশবাদী উপায়-পদ্ধতি। এই সমস্ত নয়া-উপনিবেশবাদী পন্থা পদ্ধতি অবলম্বনের স্বার্থে শক্তিধর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে কৌশল হিসাবে কিছুটা সঙ্কুচিত করে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বভৌমিকতার নিয়ন্ত্রণ: সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার নীতির বিরোধী। তবে এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ও নীতিগত কারণ আলাদা। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুসারে সর্বহারা শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতার কথা বলা হয়। এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উগ্রজাতীয়তাবাদ ও চরম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরোধিতা করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিকতার মহান আদর্শের অনুগামী। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রগুলি সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত এক সাম্যবাদী সমাজ গঠন করতে চায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মহান লক্ষ্য।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা সত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে এখনও অধিকাংশ রাষ্ট্রই কার্যক্ষেত্রে সার্বভৌমিকতাকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে অনাগ্রহী। বরং সরাসরি বলা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রমাত্রেই নিজের চরম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে অটুট ও অব্যাহত রাখার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সতর্ক। এই কারণেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদেও (U. N. Charter) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাকে এখনও পুরোপুরি বাতিল করা যায়নি। এবং নিকট ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতার দাবিকে পরিত্যাগ করার মত মানসিকতা রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক আচার-আচরণ বা কার্যকলাপের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির উপর বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়েছে। তার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোন রাষ্ট্রই এই সমস্ত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারে না। পরিশেষে উল্লেখ করা দরকার যে আর্থনীতিক ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্য বজায় থাকলে চরম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণাকে একেবারে বাতিল করা যাবে না।