নতুন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণাসমূহ থেকে পৃথক। মার্কসীয় দর্শনে এক নূতন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মার্কসীয় দর্শনে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি ও প্রয়োগ-পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত মার্কসীয় আলোচনা কোন রকম বিমূর্ত তত্ত্ব বা অনুমান-নির্ভর বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কসবাদীরা সার্বভৌমত্বের চরিত্র ও সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন। মার্কসবাদীদের মতানুসারে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি ও প্রয়োগ পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুধাবন করা যাবে।

সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের রাজনীতিক ক্ষমতা: মার্কসবাদ অনুসারে রাষ্ট্র একটি শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী শোষণের যন্ত্রমাত্র। সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের প্রকৃতি অনুসারে এর চরিত্র বদলায়। অর্থাৎ সমাজের উৎপাদন-উপাদানসমূহের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বা আর্থিক শক্তির বিন্যাসের উপর রাষ্ট্রের শাসন ও শোষণের প্রকৃতি নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার চরিত্র সম্পর্কেও এই কথাগুলি সমানভাবে প্রযোজ্য। কারণ সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রেরই রাজনীতিক ক্ষমতা বিশেষ। মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতা উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালকশ্রেণীরই করায়ত্ত থাকে। জোড (Joad) বলেছেন: “According to Marxist theory Sovereignty resides in that class in a community which owns the instruments of production.” এই ক্ষমতাবলেই বিত্তবান মালিকশ্রেণী বিত্তহীন শ্রমিকশ্রেণীকে শোষণ করে এবং শ্রমের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে।

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা হল শ্রেণী-সার্বভৌমিকতা: মার্কসীয় ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র এবং সার্বভৌম ক্ষমতা হল সমাজে আর্থনীতিক বিচারে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ সাধনের চরম নগ্ন ক্ষমতা। অর্থাৎ সার্বভৌমিকতা হল শ্রেণী-সার্বভৌমিকতা (sovereignty is class-power)। সার্বভৌমিকতা হল বিত্তবান প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর আর্থনীতিক প্রাধান্য সংরক্ষণ এবং বিত্তহীন দুর্বল শ্রেণীকে শোষণ করার অপ্রতিহত নগ্ন ক্ষমতা। রাষ্ট্র বা সার্বভৌমিকতা কোন শাশ্বত ও চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতা নয়। সমাজবিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-শোষণ ছিল না। তাই শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি। সর্বপ্রথম দাস-সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী-ভেদ ও শ্রেণী-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই সময় দাস-মালিকদের শ্রেণী-স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সামাজিক প্রগতির সর্বস্তরেই রাষ্ট্র বিত্তবান শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণীর বিরুদ্ধে সার্বভৌম শক্তি প্রয়োগ করেছে। রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তি বা চরম ক্ষমতাসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যই হল সমাজের প্রচলিত শ্রেণী-সম্পর্ক বজায় রাখা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের সাহায্যে শোষিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা।

বুনিয়াদ-উপরি-কাঠামোর ধারণা: আইন হল সার্বভৌম কর্তৃত্বের ইচ্ছার প্রকাশ। তাই আইন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মালিক শ্রেণীর স্বার্থেই প্রণীত হয়। এবং এই শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্ত হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সার্বভৌমিকতা কেবলমাত্র একটি আইনগত ধারণা নয়, এ হল একটি রাজনীতিগত আইনী প্রত্যয়। সামাজিক-আর্থনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্র নির্ধারিত হয়। এবং এই শ্রেণী চরিত্রের ভিত্তিতে সার্বভৌমিকতার শ্রেণী-চরিত্র গড়ে ওঠে। বস্তুত সমাজের আর্থনীতিক কাঠামোর উপর সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি নির্ভরশীল। আর্থনীতিক ব্যবস্থা হল বনিয়াদ (base or sub-structure)। এই বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে উপরি-কাঠামো (superstructure)। উপরিকাঠামো বলতে আইন, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতিকে বোঝায়।

দাস ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি: দাস-সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাসদের শাসন ও শোষণ করে দাস-মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে সামস্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সংখ্যালঘু ভূস্বামী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রেণী-সম্পর্ক অটুট রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই প্রাক্-পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভৌগোলিক সীমানায় একজন শাসকের সৃষ্টি হয়। তাঁর হাতেই সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। তিনিই হন সার্বভৌম। অর্থাৎ এই পর্যায়ে সার্বভৌম ক্ষমতা বিশেষ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতারূপে চিহ্নিত হয়।

পুঁজিবাদী সমাজে সার্বভৌমিকতার স্বীকৃতি: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন- উপাদানসমূহের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। সংখ্যায় এরা মুষ্টিমেয়। কিন্তু এই শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার সার্বভৌম ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হয়। জোড় বলেছেন: “The followers of Marx would, then insist that sovereignty in a community resides with the possessors of the instruments of production and the controllers of the sources of wealth, that is to say, with the Capitalist class.” এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আধুনিক অর্থে জাতি ও জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। তার ফলে সার্বভৌম ক্ষমতা জাতীয় ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরিগণিত হয়। সামস্ততন্ত্রের ধ্বংসের পর ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে জনপ্রিয় সার্বভৌমিকতার সৃষ্টি হল। বস্তুতপক্ষে, পুঁজিপতি শ্রেণী সার্বভৌম ক্ষমতা করায়ত্ত করে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করতে লাগল। সেইজন্য এই পর্যায়ে সার্বভৌমিকতার স্বরূপ সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এই পর্বে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘোষণা করা হয় বটে, কিন্তু জনগণের হাতে উৎপাদন-উপাদানসমূহের মালিকানা থাকে না। তা থাকে পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত। সেইজন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার সার্বভৌম ক্ষমতা এই পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় নিযুক্ত থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জনসাধারণ কখনই বাস্তবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। মার্কসবাদীদের মতানুসারে কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনগণ তত্ত্বগত এবং বাস্তব উভয় দিক থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।

বুর্জোয়া সার্বভৌমিকতা: পোপের কর্তৃত্বের জায়গায় রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করা হয়। বদ্যা, হস প্রমুখ দার্শনিকদের সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বৈরাচারী রাজাই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হন। তারপর সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিপতি শ্রেণীর কর্তৃত্ব কায়েম করার উদ্দেশ্যে জনগণের সার্বভৌমিকতার মতবাদ প্রচার করা হয়। এই মতবাদের অনুপ্রেরণায় ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮), আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬) ও ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) সংঘটিত হয়। কিন্তু কার্যতঃ সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে আসেনি। সার্বভৌমিকতা সামন্তপ্রভুদের পরিবর্তে বুর্জোয়াদের হাতে এল। এই সার্বভৌম বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে আইনসঙ্গত সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করা হয়।

বুর্জোয়া সার্বভৌমত্বের ঐতিহাসিক ভূমিকা: বুর্জোয়া সার্বভৌমিকতার সীমাবদ্ধতা আছে। একথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে বুর্জোয়া স্বাধীনতা একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছে। মধ্যযুগীয় গতানুগতিক সার্বভৌমিকতার ধারণার উপর বুর্জোয়া বিপ্লব প্রবল আঘাত হেনেছে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। বুর্জোয়া বিপ্লব সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার আক্রমণ পরিচালিত করে। সামন্তশ্রেণী ও সামন্ততন্ত্রের ধ্বংস সাধিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পুরাতন ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ে। ভূস্বামী ও অভিজাত শ্রেণীর কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতি ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এই ধারণা স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে ব্যক্তির মধ্যে নয়, জাতির মধ্যেই সার্বভৌম ক্ষমতা বর্তমান।

শাসক শ্রেণীর প্রাধান্যের বৈশিষ্ট্য: মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয় না। এ হল শাসক শ্রেণীর প্রাধান্যের বৈশিষ্ট্য বিশেষ। ক্রমবিকাশের ধারায় মানবসমাজের পরিবর্তন ঘটে। দাসব্যবস্থা থেকে সামস্ত ব্যবস্থা, তারপর সামন্ত ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজব্যবস্থাতেই আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী শাসকশ্রেণীর কর্তৃত্ব কায়েম করে। এই শ্রেণীহ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়।

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে জনগণের সার্বভৌমিকতা: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার জনগণের হাতে কখনই আসে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই কেবল জনগণ আর্থনীতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি দিক থেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার লাভ করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সংখ্যালঘু বুর্জোয়া শ্রেণীর পরিবর্তে সংখ্যাগুরু শ্রমিক শ্রেণী ও তার সহযোগী শ্রেণীগুলি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়। গুণগত দিক থেকে বিচার করলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল পৃথক প্রকৃতির। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসাবে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটে; উৎপাদনের উপাদানসমূহের সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হয়; রাষ্ট্র ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে আসে এবং শ্রেণী-শোষণের সমাপ্তি ঘটে। এইভাবে মুষ্টিমেয় বিত্তবান শোষক শ্রেণীর কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। তার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোসিত জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় শ্রমিক-শ্রেণীর সার্বভৌমিকতা ও সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্তরে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে দমন ও সর্বহারা শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ও সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়। তারপর সমাজতান্ত্রিক সমাজ সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হলে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে তখনই জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতানুসারে এক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের স্বাধীন জীবন বিকাশের শর্ত হল সার্বভৌমিকতা। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন জীবন বিকাশের শর্ত (“.the free development of each is the condition for the free development of all.”)।

সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণার বৈশিষ্ট্য:

সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত মার্কসবাদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যেতে পারে।

  • (ক) রাষ্ট্র কর্তৃক বলপ্রয়োগের চূড়ান্ত ক্ষমতাই হল সার্বভৌমিকতা। 

  • (খ) সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের একটি রাজনীতিক ক্ষমতা। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। সুতরাং সার্বভৌমিকতা হল শ্রেণী-সার্বভৌমিকতা বা শ্রেণী-ক্ষমতা।

  • (গ) শ্রেণী-সংঘাত যখন অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে উঠে, তখন দমনমূলক ক্ষমতার মাধ্যমে সার্বভৌমিকতার চরম ও নগ্ন প্রকাশ ঘটে।

  • (ঘ) সার্বভৌমিকতা হল সমাজের প্রভুত্বকারী শ্রেণীর রাজনীতিক হাতিয়ার বিশেষ। 

  • (ঙ) শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সার্বভৌমিকতা হল শাসকশ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। এই ক্ষমতা বিভাজ্য বা বিচ্ছিন্ন নয়।

  • (চ) সর্বহারার বিপ্লবের পর সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব ও মেহনতী মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

  • (ছ) সমাজতান্ত্রিক সমাজ সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বিলুপ্ত হয় এবং জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়।

  • (জ) আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার ঘটলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ থাকে।