সার্বভৌমিকতা অবিভাজ্য: সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ইচ্ছার প্রকাশ। রাষ্ট্রের এই ইচ্ছা চরম ও চূড়ান্ত। তাই সার্বভৌমিকতা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে না। সার্বভৌমিকতার বিভাজন তত্ত্ব তাই সকলে স্বীকার করেন না। প্রচলিত ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা হল নির্দিষ্ট এবং অবিভাজ্য। গার্ণার মন্তব্য করেছেন: “Being the highest will (or power) in the state, it cannot be divided without producing several wills, which is… inconsistent with the notion of sovereignty.” নির্দিষ্ট ও অবিভাজ্য বলে সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের মধ্যে বিশেষ একটি জায়গায় নির্দিষ্টভাবে থাকাই স্বাভাবিক। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতার কেন্দ্র মাত্র একটি। এর ভাগাভাগি অসম্ভব। এই চরম ক্ষমতার ভাগাভাগি এর বিলুপ্তিরই সামিল। সার্বভৌমিকতার বিভাজন একটি স্ববিরোধী ধারণা। গেটেল (Gettell) বলেছেন: A divided sovereignty is an contradiction in terms.” বস্তুত সার্বভৌমিকতা একটি সামগ্রিক বিষয়। ক্যালহন (J. C. Calhaun) নামে এক মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক মন্তব্য করেছেন: “Sovereignty is an entire thing; to divide it is to destroy it.” সার্বভৌমিকতার এই নির্দিষ্টতা ও অবিভাজ্যতার কারণে এর সঠিক অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সার্বভৌমিকতার অবস্থান ও বিভাজ্যতার প্রশ্নটি এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে।
এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার সার্বভৌমিকতা: এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হল কেন্দ্রীয় সরকার। তাই আইনগত বিচারে এখানে পার্লামেন্টই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ব্রিটেনে ‘রাজা বা রানী-সহ পার্লামেন্ট ই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে-কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে, পরিবর্তন করতে পারে এবং বাতিল করতে পারে। এখানে পার্লামেন্টই আইনগত চরম ক্ষমতার অধিকারী। ব্রিটেনের কোন আদালত পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে না। সুতরাং আইন সংক্রান্ত বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এ রকম সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট জনমতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে কিছু করতে পারে না। জনমত এবং রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার প্রভাব অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে পার্লামেন্ট কোন কাজ করতে পারে না। সুতরাং বাস্তব ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও আইনগত বিচারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
যুক্তরাষ্ট্রে সার্বভৌমিকতার অবস্থান: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌমিকতার অবস্থান নির্ধারণ এক দুরূহ ব্যাপার। ল্যাস্কির মতে তা সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার (“Discovery of sovereignty in a Federal State…is an impossible adventure.”)। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যসরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত থাকে। উভয় সরকারই নিজ নিজ এক্তিয়ারের মধ্যে নির্দিষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্বসম্পন্ন। শাসনতন্ত্র অনুসারে উভয় সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ, কেউ কারও অধীন নয়।
মার্কিন উদাহরণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচনার সময় হ্যামিল্টন (Hamilton), ম্যাডিসন (Madison) প্রমুখ নেতারা কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সার্বভৌম বলে ঘোষণা করেন। গোড়ার দিকে ১৭৯২ সালে মার্কিন সুপ্রীম কোর্টও Chisolm Vs. Georgia, 1792 মামলায় বিভাজ্য সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে স্বীকার করেছেন। হুইটন (Wheaton), টক্ভিল্ (Tocqueville) প্রমুখ চিন্তাবিদ এবং স্টোরী (Story), কুলী (Cooley) প্রমুখ বিচারপতিগণ দ্বৈত বা বিভক্ত সার্বভোমিকতা (Dual or Divided Sovereignty)-র তত্ত্বকে স্বীকার করেছেন। সমালোচকদের মতানুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি সংবিধানে প্রদত্ত নির্দিষ্ট ক্ষমতার অধিকারী—চরম ও চূড়ান্ত সার্বভৌমিকতার অধিকারী নয়। কালহন প্রমুখ চিন্তাবিদ্গণ দ্বৈত বা বিভক্ত সার্বভৌমিকতার ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং অঙ্গ রাজ্যসমূহের আইনসভার মধ্যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নির্দিষ্ট ও সীমিত। এই সীমারেখা কোন আইনসভা অতিক্রম করলে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট তা অবৈধ বলে ঘোষণা করবে। এই অবস্থায় অনেকের মতে ক্ষমতা বিভক্ত ও বণ্টিত থাকে বলে যুক্তরাষ্ট্রে উভয় সরকারই নির্দিষ্ট ক্ষমতার অধিকারী, কেউই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়।
বিভক্ত সার্বভৌমিকতা: আবার অনেকের মতে যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংবিধান একটি শাসনসংক্রান্ত লিখিত দলিলমাত্র। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানও পরিবর্তন করা যায়। সুতরাং সংবিধানও সার্বভৌম ক্ষমতাযুক্ত নয়। লীকক সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতাকেই সার্বভৌম হিসাবে গণ্য করার পক্ষপাতী। গেটেল এই মতের বিরোধী। সার্বভৌম ক্ষমতা কেবলমাত্র সংবিধান সংশোধন কার্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। গেটেল প্রমুখ চিন্তাবিদের মতানুসারে যুক্তরাষ্ট্রে সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী হল সকল আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। অর্থাৎ গেটেল প্রমুখরা বিভক্ত সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন। বহুত্ববাদীরাও বিভক্ত সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন। ব্লুণ্টস্লি, ফ্রিম্যান, দ্যুওই প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও বিভক্ত সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করেছেন। অনেকে বলেন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা বিভাজ্য।
বিভক্ত সার্বভৌমিকতার সমালোচনা: কিন্তু অবিভাজ্যতা সার্বভৌমিকতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। একত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এবং রুশো বিভক্ত সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। একত্ববাদীদের মতানুসারে সার্বভৌমিকতা একক ও অবিভাজ্য এবং কেবল রাষ্ট্রের হাতেই তা ন্যস্ত থাকে। ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতে সার্বভৌমিকতা একমাত্র সাধারণ ইচ্ছা (General will)-র হাতেই ন্যস্ত আছে। ক্ষমতার বিভক্তিকরণ সম্ভব, কিন্তু সার্বভৌমিকতার বিভক্তিকরণ একেবারে অসম্ভব। অধ্যাপক গার্ণারের মতে কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারসমূহের ঊর্ধ্বে সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব বর্তমান। গার্ণার বলেছেন : “That power is not in the central government, nor in the state; it is over and above both, and wherever it is, there is the sovereign.” মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবী (Willoughby) তাঁর The Nature of the State গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার অবিভাজ্যতার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা একাধিক উৎসের মাধ্যমে প্রকাশ পেলেও তা বিভক্ত সার্বভৌমিকতা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সরকারসমূহের মধ্যে বণ্টিত ক্ষমতা শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা মাত্র – চরম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা বণ্টিত হয়: বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা বণ্টিত হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন ও তা সংশোধনকারী কর্তৃপক্ষের হাতেই সার্বভৌমিকতা কেন্দ্রীভূত থাকে। তবে এই সার্বভৌমিকতার প্রয়োগ ও পদ্ধতি বণ্টিত অবস্থায় থাকে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একাধিক উৎসের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। তাতে সার্বভৌমিকতা বিভক্ত হয়ে পড়ে না।
Leave a comment