সার্বভৌমিকতাকে স্বীকৃতির কারণ: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রের আইনগত চূড়ান্ত ক্ষমতাই হল সার্বভৌমিকতা। রাষ্ট্রের নির্দেশ রাষ্ট্রাধীন সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে মান্য করতে হয়। অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয়। এই কারণে অনেকের মতে লোকে শাস্তির ভয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার প্রতি আনুগত্য দেখায়। কিন্তু এই ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। বলপ্রয়োগের দ্বারা মানুষের আনুগত্য সাময়িকভাবে পাওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্র শাস্তির ভয় দেখিয়ে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের আনুগত্য পেতে পারে না। বস্তুত মানুষ যখন বুঝতে পারে যে রাষ্ট্রের নির্দেশ আইনসঙ্গত, যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত এবং এই নির্দেশ মান্য করার প্রয়োজনীয়তা আছে, তখনই লোকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মান্য করে।
অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা: সার্বভৌমিকতার দুটি দিক আছে—আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা বলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও চরম ক্ষমতাকে বোঝায়। এই ক্ষমতার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র তার এলাকার ভিতরে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর আদেশ জারি ও বলবৎ করে কিন্তু কারও কাছ থেকে কোন আদেশ গ্রহণ করে না। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করার এই চূড়ান্ত ক্ষমতাকে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা বা সার্বভৌমিকতার আভ্যন্তরীণ দিক বলা হয়। এ হল রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ও আইন বলবৎকরণের চূড়ান্ত ক্ষমতা। আইনকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বলবৎ করে রাষ্ট্র তার নিজের ইচ্ছাকে কার্যকর করে। এই ক্ষমতার জন্যই রাষ্ট্রের এলাকাধীন সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের ইচ্ছার অনুবর্তী হয়ে চলতে হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুনের বিরোধ বাধলে রাষ্ট্রের আইনই বলবৎ হবে; প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সাধারণতঃ রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত বা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে সহসা হস্তক্ষেপ করে না। তবে রাষ্ট্র চাইলে বা প্রয়োজন মনে করলে, অথবা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি বাধা দেয় কেবল তখনই রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কেবলমাত্র শেষ পর্যায়েই রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনগত বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসা করার এবং ব্যক্তি ও সংঘের উপর প্রযোজ্য কর্তৃত্বের চরম ক্ষমতাই হল আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংঘসমূহের ধারণার সমন্বয় সাধনের স্বার্থে এই চূড়ান্ত কর্তৃত্বের দরকার হয়। মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সুদারল্যাণ্ড (Justice Sutherland) মন্তব্য করেছেন: “Rulers come and go; government and forms of governments change; but sovereignty survives.”
বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা: বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীনতাকে বোঝায়। গেটেল (Gettell)-এর মতানুসারে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলে আইনগত বিচারে বাহ্যিক ক্ষেত্রেও তার স্বাধীন হওয়া আবশ্যক (“If a state is internally sovereign, it must of necessity be legally independent externally.”)। কোন দেশ বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও সার্বভৌমত্বের অধিকারী হতে পারে না। কারণ তখন চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকে নিয়ন্ত্রণকারী প্রভু রাষ্ট্রের হাতে। এই কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বা বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণবিহীনতা আবশ্যক। বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতাকে বোঝায় যার সাহায্যে রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে নিজের আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে থাকে। জেলিনেক (Jellineck) -এর মতে, সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের সেই বৈশিষ্ট্য যার ফলে স্বেচ্ছায় আরোপিত ছাড়া অপর কোন প্রকার বন্ধন আরোপিত হতে পারে না, অথবা অপর কোন শক্তি একে সীমিত করতে পারে না। তিনি বলেছেন: “That characteristic of the state by virture of which it cannot be legally bound except by its own will or limited by any other power than itself.” প্রকৃত প্রস্তাবে বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার অর্থ হল রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে আপন নীতি ও কর্মধারা নির্ধারণ করতে পুরোপুরি সক্ষম। বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে গেটেল (Gettell) সেই সমস্ত অধিকারকে বুঝিয়েছেন যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে নিজের আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে ব্যক্ত করে (“What is called external sovereignty is in reality the totality of rights, by which internal sovereignty manifests itself in its dealing with foreign states. “)। এই কারণে গেটেল ‘বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা’-র পরিবর্তে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা সার্বভৌমিকতার দুটি পৃথক প্রকার নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা ও বাহ্যিক সার্বভৌমিকতাকে এক সঙ্গে নিয়েই সার্বভৌমিকতা হল এক ও অখণ্ড।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ সার্বভৌমিকতার পরিপন্থী নয়: অনেকে রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার উপরিউক্ত ধারণাকে স্বীকার করার পক্ষপাতী নন। তাঁদের মতানুসারে এখন সকল রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইন মান্য করতে হয়। তাই কোন রাষ্ট্রই সম্পূর্ণ স্বাধীন বা সার্বভৌম নয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য রাষ্ট্রগুলির বাধ্যবাধকতা এক্ষেত্রে আরও বেশি। কারণ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যদের জাতিপুঞ্জের সনদের বিধি-বিধান মান্য করে চলতে হয়। তবে রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ স্বীকার করা যায় না। বর্তমান সভ্য দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রই অল্পবিস্তর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। স্বাভাবিক, সুস্থ ও প্রীতিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়েছে। জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক নয়। আইনগত বিচারে জাতিপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বিরোধী নয়। জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ স্বেচ্ছামূলক। বৃহত্তর স্বার্থে স্বেচ্ছারোপিত নিয়ন্ত্রণ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নয়, তাই স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তির শর্তাদি পালনের প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বিরোধী নয়।
বহুত্ববাদীদের ভিন্ন মত: সার্বভৌমিকতার উপরিউক্ত ধারণা সম্বন্ধে বহুত্ববাদী (Pluralist) রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিরূপ মত পোষণ করেন। তাঁরা রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত ও সীমাহীন ক্ষমতার পক্ষপাতী নন। তাঁদের অভিমত হল, সমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আছে। উদাহরণ হিসাবে ধর্ম প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংঘ প্রভৃতির কথা বলা যায়। মানুষের সমাজজীবনের সুখসমৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলির অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনন্য। অতএব সার্বভৌম ক্ষমতায় এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলিরও অংশ বা দাবি আছে। সুতরাং সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রসহ অন্যান্য সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভক্ত করা উচিত। রাষ্ট্র সার্বভৌমিকতা এককভাবে ভোগ না করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রে ভোগ করবে। বহুত্ববাদী ল্যাস্কি (Laski) বলেছেন: “… because society is federal, authority must be federal also.” এই হল বহুত্ববাদীদের বক্তব্য।
বহুত্ববাদীদের বক্তব্য স্বীকার করা যায় না: সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি প্রসঙ্গে বহুত্ববাদীদের এই ধরনের বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। সার্বভৌমিকতা একটি আইনগত ধারণা। একে বিভক্ত করা যায় না। তা ছাড়া, সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একটি চূড়ান্ত ক্ষমতাশীল প্রতিষ্ঠান দরকার। সমাজের সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর এর কর্তৃত্ব হবে নিরঙ্কুশ বা অবাধ। এই কর্তৃত্বের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসা করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখে। রাষ্ট্রই হল সেই সীমাহীন ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী প্রতিষ্ঠান। সুতরাং সুস্থ সমাজব্যবস্থার স্বার্থে সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অপরিহার্য। বার্কার (Ernest Barkar) -এর মতে, ‘আইনানুসারে সংগঠিত জনসমাজ অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরিধির মধ্যে সৃষ্টি সকল আইনসংক্রান্ত দ্বন্দ্বের আইনসংগত মীমাংসার উদ্দেশ্যে একটি চূড়ান্ত ক্ষমতার অস্তিত্ব অপরিহার্য। তিনি বলেছেন: “There must exist in the state as a legal association, a power of final legal adjustment of legal issues which arise in its ambit.” এই কারণে সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বহুত্ববাদী ধারণা সমর্থন করা যায় না।
সার্বভৌমিকতা এখন একটি তত্ত্বগত ধারণা: যুদ্ধোত্তরকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সার্বভৌমিকতাকে অনেকে একটি তত্ত্বগত ধারণা হিসাবে গণ্য করেন। তাঁদের মতে চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ ক্ষমতাসম্পন্ন কোন রাষ্ট্র বাস্তবে দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে এবং পরিপূর্ণ অর্থে সার্বভৌমিকতার বাস্তব প্রকাশ সম্ভব নয়। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয়ক্ষেত্রেই কোন রাষ্ট্র অবাধ ক্ষমতার অধিকারী নয়। বার্কার-এর মতানুসারে ‘সার্বভৌমিকতা তার নিজের প্রকৃতি ও কর্মপদ্ধতির দ্বারা সীমাবদ্ধ’ (Sovereignty is “limited…by its own nature and its own mode of action.”)। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র জনমতের চাপ ও প্রভাবকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। এখন গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছে। তার ফলে জনমতের গুরুত্ব ও নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ গণতন্ত্র বলতে প্রকৃত অর্থে জনমতের অনুগামী শাসনকেই বোঝায়। তাই আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র জনমতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার বৈদেশিক ব্যাপারেও রাষ্ট্র অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রকে অনেক সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও বিশ্বজনমতের চাপকেও কোন রাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অবাধ নয়— সীমাবদ্ধ। বুন্টস্লি (Bluntschli) -র মতানুসারে সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকারের দ্বারা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা সীমাবদ্ধ এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আপন প্রকৃতি ও তার সদস্যদের অধিকারের দ্বারা সীমাবদ্ধ। তিনি বলেছেন: “…the state as a whole is not almighty, for it is limited externally by the rights of other states and internally by its own nature and by the rights of its individual members.” অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অবাধ নয়, সীমাবদ্ধ। কিন্তু তত্তগত বিচারে সার্বভৌমিকতা সীমাবদ্ধ হতে পারে না। এই কারণে বলা হয় যে সার্বভৌমিকতার ধারণা বর্তমানে অচল। তাই লিওসে (A. D. Lindsay) মন্তব্য করেছেন: ‘বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের তত্ত্ব ভেঙ্গে পড়েছে’ (“If we look at the facts, it is clear enough that the theory of sovereign state has broken down. “)। ল্যাস্কি (Laski)-র মতানুসারে ‘সার্বভৌমিকতার সমগ্র ধারণাটিকে পরিত্যাগ করতে পারলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্থায়ী মঙ্গল হত’ (“… it would be of lasting benefit to Political Science if the whole concept of sovereignty were surrendered.”)।
সার্বভৌমিকতার ধারণা আইনগত: সার্বভৌমিকতার ধারণার বিরুদ্ধে উপরিউক্ত অভিযোগ পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না। সার্বভৌমিকতা যে একটি তত্ত্বগত ধারণা, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কেবল তত্ত্বগত নয়, এই ধারণা আইনগতও বটে। আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমাত্রেই চূড়ান্ত ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। বহুত্ববাদী ল্যাস্কি-ই Foundation of Sovereignty গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, ‘আইনগত বিচারে রাষ্ট্রের এমন কিছু অঙ্গ আছে যার কর্তৃত্ব সীমাহীন’ (“Legally no one can deny that there exists in every state some organ whose authority is unlimited.”)। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই আইনসংগত নিরঙ্কুশ প্রাধান্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর বৈদেশিক কোন বিষয়ে রাষ্ট্র অপর কোন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে নিলে, ধরে নিতে হবে যে, এ হল স্বেচ্ছারোপিত নিয়ন্ত্রণ। কোন রাষ্ট্রই আইনসংগতভাবে অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর কোনপ্রকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। আর স্বেচ্ছায় আরোপিত নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণই নয়। স্বেচ্ছায় সম্পাদিত আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তি মান্য করা সার্বভৌমিকতার পরিপন্থী নয়। তেমনি স্বেচ্ছায় স্বীকৃত নিয়ন্ত্রণও সার্বভৌমিকতার বিরোধী নয়।
আধুনিক ধারণা: বর্তমানে বাস্তব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা যায় না। আধুনিক ব্যাখ্যা অনুসারে সাধারণত রাষ্ট্রের সংবিধানকেই ‘সর্বশেষ’ সার্বভৌম হিসাবে গণ্য করা হয়। অপরদিকে আইনসভা বা আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকে ‘তাৎক্ষণিক’ সার্বভৌম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সরকারী কর্তৃপক্ষকে এই ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসাধারণের চাহিদা ও অধিকার, জাতীয় স্বার্থ ও মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায় প্রভৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করতে হয়। সার্বভৌম ক্ষমতা নির্ধারিত হয় রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও রাজনীতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে। সার্বভৌমিকতার স্বরূপ ও প্রয়োগ গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় এক রকমের হয় না। আবার রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে না।
তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সাম্প্রতিককালের লেখকদের অনেকে মনে করেন যে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি এখন আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ক্ষমতা (Power), প্রভাব (Influence) প্রভৃতি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
Leave a comment