বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো ও কার্যপ্রক্রিয়া বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে। আধুনিককালের পশ্চিমী ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনীতিক ভিত্তি কতকগুলি উপাদান বা শক্তির প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে কতকাংশে হীনবল হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলি হল: আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, সামরিক ও নৈতিক। এই উপাদানগুলি সাধারণ একটি প্রক্রিয়া বা প্রবণতার বিভিন্ন দিকের দ্যোতক হিসাবে পরিগণিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি বিশ্বায়ন হিসাবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া প্রবলভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সর্বব্যাপী। মানবসভ্যতার ও জনজীবনের বিভিন্ন দিকের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব পড়ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে বিশ্বায়নের বিষয়টি সার্বভৌমিকতার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার ধারণা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশ্বায়নের যুগের পটভূমিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতায় ধ্যান-ধারণার কি পরিবর্তন ঘটেছে বা ঘটতে পারে তা রাজনীতির গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আধুনিককালের মানবসমাজ আন্তর্জাতিকতার ভাব-ভাবনায় পরিপুষ্ট। আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রসমূহের সমসার্বভৌমিকতার স্বীকৃতি একান্তভাবে অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবে আন্তর্জাতিক সমাজের অবস্থা অন্য রকম। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অস্থিরতা, পারস্পরিক বিরোধিতা ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সামাজিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল মোটেই সাম্যভিত্তিক বা সহযোগিতামূলক নয়। কূটনীতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ, মারণাস্ত্রের মারাত্মক ভাণ্ডার, সমরোন্মাদ, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি প্রভৃতি সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্রগুলিকে মল্লযোদ্ধার চেহারা দিয়েছে। এ যেন সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ’ (war of all against all)-এর পরিস্থিতি বা হবসের নৈরাজ্যময় প্রাকৃতিক অবস্থার প্রত্যাবর্তন। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও নৈতিক বন্ধনের অভাব দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে সাধারণ কোন শক্তি অনুপস্থিত। আজকাল কোন সাধারণ কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্রগুলি মান্য করে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় ন্যূনতম নৈতিক দাবি ও তার প্রয়োজনীয়তাকে রাষ্ট্রসমূহ স্বীকার করছে না। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রসমূহ স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন রাজনীতিক বিন্যাস হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার এ রকম এক নৈরাজ্যময় রূপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা পড়েছে। তদনুসারে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমিকতা সীমাবদ্ধ। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যে আর্থ-রাজনীতিক পরিকাঠামোর সৃষ্টি হয়েছে, তা চেহারা-চরিত্রে নতুন। এ রকম এক পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার বিরুদ্ধে অনেক দিন আগেই বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সোচ্চার হয়েছেন। তবে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বা সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী ধারণার বিরুদ্ধে সকলে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেননি। বহুত্ববাদীদের বক্তব্যের মধ্যেও অল্পবিস্তর মতপার্থক্য বর্তমান। বহুত্ববাদীদের মধ্যে একটি অংশকে নয়া বহুত্ববাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। নয়া বহুত্ববাদীরা সাবেকি বহুত্ববাদীদের বক্তব্যকে সর্বাংশে স্বীকার করেন না। এঁরা বহুত্ববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু নতুন ধারণা তুলে ধরেন। এই শ্রেণীর বহুত্ববাদীরা বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সংগঠনসমূহের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কিত আলোচনার মধ্যে তাঁদের বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তাঁরা গোষ্ঠী স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টিকে রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। তাঁরা বিভিন্ন অ-রাষ্ট্রীয় (non-state) পক্ষ বা শক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার উদাহরণ হিসাবে ‘বহুজাতিক সংস্থা’ (MNC – Multi-National Corporation)-র কথা বলা যায়। আন্তর্জাতিক আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থাকে অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহ প্রভাবিত করে। নয়া বহুত্ববাদীরা এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বহুত্ববাদীদের মধ্যে আর একদল আছেন যাঁরা এলিটবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এই শ্রেণীর বহুত্ববাদীরা প্রথমশ্রেণীর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও শিল্পোদ্যোগীদের ক্ষমতাকে আইনানুমোদিত করার উপর জোর দেন। এঁরা পেশাদারিত্বের নীতির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সরকারী সংগঠনকে বিভক্ত করার কথা বলেন। সরকারের একটি অংশে পেশাদারি গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের ব্যবহার করা উচিত বলে এঁরা মনে করেন। এলিটবাদের প্রবক্তা বহুত্ববাদীরা ব্যবসায়ী, পেশাদারী গোষ্ঠী ও সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তির ক্রমবর্ধমান ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের উপর জোর দেন এবং এই সমস্ত গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিক সংগঠনের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রতিপন্ন করেন।

বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে আর একদল অন্য কথা বলেন। তাঁরা উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা, সমাজোন্নয়ন, সমাজ সংগঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গঠনমূলক নেতৃত্বের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রের আগের ভূমিকাকে ফিরিয়ে এনে সমাজ সংস্কার ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেন। এঁরা নতুন ব্যবস্থায় রাজনীতির ক্ষেত্রকে সংকুচিত করার কথা বলেন এবং শিল্প সংগঠন, বাজার ও ক্রেতা-ভোক্তার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করার কথা বলেন। তবে সদ্য স্বাধীন দেশসমূহে রাষ্ট্র ও সরকার অধিকতর দায়িত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও জাতিগঠনের কাজে অধিকতর সক্রিয় হবে। নতুন যুগের বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অধিকতর পেশাদায়িত্ব ও দক্ষতাসম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অধিকতর সংগঠিত করতে হবে। রাষ্ট্রের কাজকর্মের মধ্যে আনতে হবে মানবিকতার চেতনা। তবেই আইনমূলক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ হিসাবে সমাজের অন্যান্য সংগঠনের থেকে রাষ্ট্রের অধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে প্রতিপন্ন করা যাবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের এবং পরের বিশ্ব-ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মানবসভ্যতার চেহারা-চরিত্রের পার্থক্য মৌলিক প্রকৃতির। যুদ্ধোত্তর কালে পৃথিবী থেকে সাবেকি ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটে। এই সময় অসংখ্য জাতি-রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। স্বভাবতই এই সময়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিষয়টি বিশেষ মাত্রা প্রাপ্ত হয়। সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের ২(১) ধারায় সার্বভৌম সাম্য নীতির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে “The organization is based on the principle of the sovereign equality of all its Members.” সার্বভৌম শক্তি হিসাবে রাষ্ট্রসমূহ হবে সমান। প্রত্যেক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে স্বীকার করবে ও মর্যাদা দেবে। কোন রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের স্বাধীন এলাকায় হস্তক্ষেপ করবে না। রাজনীতিক সমাজে রাষ্ট্রই হবে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে রাষ্ট্রই হবে চূড়ান্ত আইন প্রণয়নকারী ও চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ। আবার বাহ্যিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর কোন রকম বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতায় সংকট আসেনি। কিন্তু বাহ্যিকভাবে সার্বভৌমিকতা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বাহ্যিক দিক থেকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিরোধী বিষয়গুলি বহু ও বিভিন্ন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল: সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা ও ঔপনিবেশিকতা, বিশ্বযুদ্ধ, অঞ্চলগত রাজনীতিক ব্যবস্থা, ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় জাতিসমূহের মধ্যে পার্থক্য প্রভৃতি। জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমিকতা এবং সার্বভৌম সাম্য নীতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদর্থক ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কথা বলা যায়। জাতিসংঘের পতনের পর অতি জাতীয়তাবাদী শক্তি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণাকে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সংকট নিরসনে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সদর্থক ও যথাসম্ভব সফল ভূমিকা পালন করে।

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বা রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌম সমতা সংরক্ষণে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সর্বাংশে সফল হয়েছে এমন দাবি করা যায় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারকে সমানভাবে কার্যকর করতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সক্ষম হয়নি। এই ব্যর্থতা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌম ক্ষমতাকে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও প্রকট হয়ে পড়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী শক্তি জোটের দাপটে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অবস্থা বেহাল। ইরাকের উপর ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রকট হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ক্ষুদ্র, দরিদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমিকতা সাম্প্রতিককালে সংকটের সম্মুখীন। এর কারণ হিসাবে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল : পুঁজিবাদী বৃহৎ শক্তিসমূহের প্রভাবাধীন বহুজাতিক সংস্থা সমূহ, G8-এর মত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের জোট, NATO-র মত সামরিক জোট এবং সর্বোপরি বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া। বস্তুত বর্তমান বিশ্ব বহুলাংশে এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌম সমতার বিষয়টি বিপন্ন। দরিদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমিকতা বা সার্বভৌম সম মর্যাদা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এবং এই সমস্ত অনগ্রসর ও হীনবল রাষ্ট্রগুলিকে শক্তিধর রাষ্ট্রের মাৎস্যন্যায়ের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অসহায় অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকট হয়ে পড়েছে। স্বভাবতই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার অস্তিত্ব আজ সংকটের সম্মুখীন।