প্রাচীন গ্রীক ও রোমান ধারণা: আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। তবে প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগেও সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত ধারণাটির পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যারিস্টটলের আমলেও সার্বভৌমিকতার ধারণা ছিল। অ্যারিস্টটল (Aristotle) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রীক্ পণ্ডিতই প্রথম রাষ্ট্রের ‘চরম ক্ষমতা’ (supreme power)-র কথা বলেছেন। তবে সে সময় সার্বভৌমিকতার ধারণা ছিল অত্যন্ত অস্পষ্ট। অ্যারিস্টটল-এর মতনুসারে এই ক্ষমতা একজন, কয়েকজন বা বহুজন ব্যবহার করতে পারে। আধুনিক অর্থে সার্বভৌমিকতার এই ধারণা গ্রহণ করা যায় না। রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের আমলেও সার্বভৌমিকতার ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। তবে রোমান আইনে শাসকের চূড়ান্ত ক্ষমতার কথা আছে। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি বা কর্তৃত্ব এই অর্থে সার্বভৌমিকতার আলোচনা রোমের আইন সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতে পরিলক্ষিত হয়। এই কথার মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার ইঙ্গিত নিহিত আছে।
মধ্যযুগ: মধ্যযুগে ধর্মগুরু পোপকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য সভ্যতা গড়ে উঠে। এই সময় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন লোক বিভিন্ন ধরনের অধিকার ভোগ করত এবং নিয়ন্ত্রণের কোন সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ছিল না। কোকারের মতানুসারে তখন সব কিছু ছিল চার্চের কর্তৃত্বাধীন, রাষ্ট্রের নয়। এই সময় আনুষ্ঠানিক ও বৈধ নিয়ম অনুসারে সংগঠনের কোন ধারণা ছিল না। দ্বাদশ শতাব্দীতে রোমক আইনের চর্চাকে কেন্দ্র করে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ সম্পর্কিত ধারণার সৃষ্টি হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর অ্যাকুইনাস (Thomas Acquinas) চরম ক্ষমতার ভিত্তি হিসাবে জনগণের কথা বলেন। মারসিগুলিও (Marsiglio of Pauda) এবং ওহ্যাম এই ধারণাকে সম্প্রসারিত করেন। এই সময় জনগণ সম্পর্কে ধারণা ছিল অসংগঠিত প্রজাপুঞ্জ সম্পর্কিত ধারণা। মধ্যযুগে সার্বভৌমত্বের ধারণাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিপন্ন করা হত। তবে এই অধ্যায়েও আধুনিক অর্থে সার্বভৌমিকতার ধারণার সৃষ্টি হয়নি। রোডী, আণ্ডারসন ও ক্রিস্টল (Rodee, Anderson and Christol) মন্তব্য করেছেন: “It is significant that the middle ages produced discussion of the limits of secular, as against spiritual authority, but not in the terminology of state sovereignty because the state, as we know it, did not exist.” গেটেল তাঁর Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, এই সময় গোষ্ঠীগত আনুগত্য (tribal allegiance) এবং সার্বজনীন সাম্রাজ্য (Universal Empire) এই দুটি ধারণার সমন্বয়ই সার্বভৌমিকতার ধারণা হিসাবে প্রচলিত ছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘রাষ্ট্র’ বলতে যা বোঝান হয়, মধ্যযুগে তার আবির্ভাব ঘটেনি। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের দার্শনিকদের মধ্যে সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয়নি।
ষোড়শ শতাব্দী: পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমাজব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পোপের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জনসাধারণ শক্তিশালী একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। সংক্ষেপে সমকালীন মধ্যযুগীয় সামাজিক ও আর্থনীতিক অবস্থা রাজার শক্তি বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। এই সময় ইউরোপের নবজাগরণ (Renaissance) এবং সংস্কার আন্দোলন (Reformation Movement) শুরু হয় এবং পোপের জায়গায় রাজন্যবর্গের চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় শিল্পের উদ্ভব ও নতুন উৎপাদিকা শক্তির উন্মেষ ঘটে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে। নগর সভ্যতা বিকশিত হয়। এই সমস্ত ঘটনা সামন্ত সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক কর্তৃত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠে। এবং এর মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের জরাজীর্ণ রূপ প্রতীয়মান হয়। ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্য ও পোপ আনুগত্যের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ইউরোপ জুড়ে ধর্মীয় ও রাজনীতিক সংঘর্ষ প্রবল ও প্রকট হয়ে উঠে। সামন্ততন্ত্রের অবসান আসন্ন হয়ে পড়ে এবং অচিরেই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ও সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সামন্তবর্গের হাত থেকে রাজার হাতে ভূমিগত কর্তৃত্ব চলে আসে। বণিকশ্রেণী ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। ঐক্যবদ্ধ একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম শাসক হিসাবে রাজা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তা ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে রাজা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ‘জাতীয় রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ (National Monarchical State)-এর উদ্ভব হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সার্বভৌমিকতার ধারণার সৃষ্টি: ষোড়শ শতাব্দীতেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গে সার্বভৌমিকতার ধারণা সৃষ্টি হয়। ষোড়শ শতাব্দীর ধর্মীয় সংঘর্ষই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎস। ল্যাস্কি (H. Laski)-র অভিমত অনুসারে আঞ্চলিক ও সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র হল ষোড়শ শতাব্দীর ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল। তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন : The territorial and omnipotent state is the offspring of the religious struggles of the sixteenth century.” (C. D. Burns) তাঁর Political Ideals শীর্ষক গ্রন্থে সার্বভৌমিকতাকে ইউরোপের নবজাগরণের ফল হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এই সময় নৃপতি ও ধর্মযাজকরাই চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করতেন। উভয়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই সূত্রপাত হয়েছে জাতীয় রাষ্ট্রের। জাঁ বদ্যা (Jean Bodin) তাঁর Republic নামক গ্রন্থে পোপের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করেছেন। এই সময় শান্তি ও ঐক্যের জন্য রাজার কর্তৃত্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করা হয়। জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সার্বভৌমিকতার ধারণাও বিকশিত হয়েছে। মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটার পরই আধুনিক অর্থে জাতীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
বদ্যা: গোড়ার দিকে সার্বভৌমত্ব প্রকৃতপক্ষে রাজার ক্ষমতা হিসাবে গণ্য হত। ষোড়শ শতাব্দীর ইতালীয় চিন্তানায়ক মেকিয়াভেলী রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ইঙ্গিত দেন। ফরাসী আইনজ্ঞদের হাতেই সার্বভৌমি কতার ধারণাটি সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। আধুনিক অর্থে সার্বভৌমিকতার সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ফরাসী লেখক বদ্যা। রোডী, আণ্ডারসন ও ক্রিস্টল যথার্থই বলেছেন: “The so called ‘father’ of the modern theory of sovereignty was Jean Bodin (1530-1595). ” তিনি তাঁর Six Books on the Republic (1576) গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ‘আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক ও প্রজাগণের উপর প্রযুক্ত সর্বময় ক্ষমতাই হল সার্বভৌমিকতা’ (“Sovereignty is supreme power over citizens and subjects unrestrained by law.)। বস্তুত বদ্যাই প্রথম রাষ্ট্রের উপাদান হিসাবে সার্বভৌমিকতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। গার্নার মন্তব্য করেছেন: Originally conceived as a personal attribute of the monarch, sovereignty came in the hands of Bodin to be regarded as a constituent element of the State.” বদ্যা কিন্তু সার্বভৌমিকতাকে কেবল আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ও অপ্রতিহত ক্ষমতা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
গ্রোটিয়াস: সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ্ আন্তর্জাতিক আইনবিদ্ প্রোটিয়াস (Hugo Grotious) সার্বভৌমিকতার বাহ্যিক দিকের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ১৬২৫ সালে সার্বভৌমিকতার বিশদ ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। তাঁর মতানুসারে সার্বভৌমিকতা হল এমন একটি শক্তি যার কোন কাজ বা ইচ্ছা অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তিনি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমমর্যাদার কথা বলেছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়ে উঠল।
টমাস হব্স: ইংরাজ দার্শনিক হস (Thomas Hobbes) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে মোটামুটি বদ্যার ধারণার অনুগামী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল Leviathan। ১৬৫১ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থেই তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনিই প্রথম সার্বভৌমিকতার রাজনীতিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি রাজার চরম ক্ষমতার কথা বলেছেন। রাজতন্ত্রকে সর্বশক্তিমান ও দৃঢ়ভিত্তিক করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাঁর মতানুসারে শাসক বা রাজার ইচ্ছাই হল চূড়ান্ত। রাজার আদেশই হল আইন। রাজার আদেশ প্রজাসাধারণ অমান্য করতে পারে না। কারণ সে ক্ষমতা বা অধিকার প্রজাসাধারণের নেই। সকল আইনের উৎস হলেন রাজা। কিন্তু তিনি কোন আইনের অধীন নন। হস যে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের কথা বলেছেন তার ক্ষমতা চরম ও চূড়ান্ত এবং অবিভাজ্য ও অহস্তান্তরযোগ্য।
জন লক্: জন লক্ রাজার অবাধ ক্ষমতা ও রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের ধারণাকে সমর্থন করেননি। তিনি অবাধ রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। লক্ সীমাবদ্ধ বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র (Limited Monarchy) -এর সমর্থক ছিলেন। ১৬৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Two Treatises on Civil Government প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তাঁর ধ্যান-ধারণার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। উদীয়মান বুর্জোয়া সমাজের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসাবে লক্ বিশেষভাবে পরিচিত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতিক দর্শন উপস্থাপিত করে তিনি পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে সার্বভৌম ক্ষমতা চরম বা অবিভাজ্য নয়। প্রজাসাধারণই হল মূল ক্ষমতার অধিকারী। এবং শাসক হলেন প্রজাসাধারণের অছি বা Trustee মাত্র। প্রজাসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা মতামতের উপর শাসকের ক্ষমতা নির্ভরশীল।
রুশো: অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী দার্শনিক রুশো (Rousseau) বলেছেন সার্বভৌম ক্ষমতা হল অখণ্ড, অবিচ্ছেদ্য ও চরম। তাঁর মতে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। জনগণের সমষ্টিগত ইচ্ছা বা সাধারণের ইচ্ছাই (General Will) হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রুশো সাধারণের ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের কথা বলে বস্তুতঃ গণ-সার্বভৌমত্বের (Popular’s sovereignty) ধারণা সৃষ্টি করেছেন। রুশো সাধারণের ইচ্ছাকেই সার্বভৌম বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতানুসারে এই সাধারণের ইচ্ছাই হল চরম এবং আইনের উৎস। জনগণের সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব প্রচার করে রুশো জনসাধারণের ক্ষমতা ও অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের কট্টর বিরোধী হিসাবে পরিচিত। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত রুশোর তত্ত্বে হস ও লকের তত্ত্বের সার্থক সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
অস্টিন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরাজ আইনবিদ অস্টিন সার্বভৌমিকতার ধারণাকে বিশেষভাবে বিকশিত করেন। প্রকৃতপক্ষে, সার্বভৌমিকতার ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে অস্টিনের অবদান অপরিসীম। অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, “যদি কোন নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষ অন্য কোন ঊর্ধ্বর্তনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে এবং কোন বিশেষ সমাজের অধিকাংশের স্বভাবগত আনুগত্য লাভ করতে থাকে তা হলে সেই সমাজে উক্ত নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হল সার্বভৌম।”
বেস্থাম: বেন্থামও আইনগত সার্বভৌমিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে বেস্থাম আলোচনা করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তিনি সম্পূর্ণরূপে রাজতন্ত্রের বিরোধী। কিন্তু টমাস হবসের মতই তিনি চরম, চূড়ান্ত ও অসীম সার্বভৌম ক্ষমতার উপর জোর দিয়েছেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেই এই ক্ষমতার প্রয়োগের কথা তিনি বলেছেন। বস্তুত উদারনীতিবিদ বেন্থাম ছিলেন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সমর্থক। তাই তিনি ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার প্রসারের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি আইনগত সার্বভৌমিকতার উপর জোর দিয়েছেন।
বহুত্ববাদিগণ: বিংশ শতাব্দীর ল্যাস্কি প্রমুখ বহুত্ববাদী (Pluralists) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের একত্ববাদের (Monistic Theory) তীব্র সমালোচনা করেছেন। একত্ববাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে কেবলমাত্র একটি কেন্দ্রেই সার্বভৌম ক্ষমতা কেন্দ্রীয়ভাবে ন্যস্ত থাকে। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদী আলোচনা বদ্যার মতবাদ থেকে শুরু করে অস্টিনের মতবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। বহুত্ববাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্র এককভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। রাষ্ট্র অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মতই একটি সংগঠন। সুতরাং রাষ্ট্র অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে একত্রে সার্বভৌমিকতাকে ভোগ করবে। তবে কোকার, দ্যুওই প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বহুত্ববাদীদের এই বক্তব্য সমর্থন করেন না। সাম্প্রতিককালের কোন কোন চিন্তাবিদ আন্তর্জাতিক আইন ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্যের স্বার্থে রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্বকে সীমিত করার কথা বলেন। আবার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ব্যাপক স্বীকৃতি, বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্প্রসারণ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন সার্বভৌমিকতার ধারণার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রচিত্তায় সার্বভৌমিকতার পরিবর্তে ক্ষমতা (power), কর্তৃত্ব (authority), প্রভাব (influence) প্রভৃতি ধারণাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে।
Leave a comment