প্রশ্নঃ সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ কী? কোন কোন ভিত্তিতে বহুত্ববাদীরা এই মতবাদের সমালােচনা করেন?

ভূমিকাঃ ‘Sovereignty is the supreme power of the state’। রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সার্বভৌমত্ব সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌমকতার ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের আইন ও কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং সার্বভৌমিকতাই রাষ্ট্রকে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক সত্তার অধিকারী করেছে। সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোনাে রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না।

সার্বভৌমত্বের একত্ববাদের মূলকথাঃ সার্বভৌমত্ব একক, অবিভাজ্য, সীমাহীন, হস্তান্তরের অযােগ্য, স্থায়ী, চরম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এ ক্ষমতার কোনাে সীমারেখা নেই। এর কোনাে বিভাজন সম্ভবপর নয়। সার্বভৌমত্ব কোনােভাবে হস্তান্তরযােগ্য নহে। মানুষের জন্য যেমন মাথা, রাষ্ট্রের জন্য তেমনি সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব কোনাে আদর্শ নয়, সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার আধার, সুনির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষ। অস্টিনের মতে, “যদি কোনাে সুনির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষ অন্যকোনাে অনুরূপ কর্তৃপক্ষের বশ্যতা স্বীকারে অভ্যস্ত না হয় অথচ সমাজের অধিকাংশের আনুগত্য সাধারণভাবে লাভ করেন, তাহলে সেই সুনির্দিষ্ট কর্তপক্ষ ঐ সমাজের সার্বভৌম শক্তি এবং উক্ত কর্তৃপক্ষসহ ঐ সমাজকে রাজনৈতিকভাবে গঠিত স্বাধীন সমাজ বলা হবে।

সার্বভৌমত্বের একত্ববাদের ওপর বহুতবাদের সমালােচনাঃ সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদীরা বিভিন্নভাবে একত্ববাদের সমালােচনা করেছেন। নিম্নে সার্বভৌমত্বের একত্ববাদের ওপর বহুতবাদের সমালােচনা উল্লেখ করা হলাে-

সমাজের সংঘসমূহের পরিপ্রেক্ষিতেঃ বহুত্ববাদীদের মতে সমাজে বহু সংঘ রয়েছে এবং ক্রমাগত তা গঠিত হচ্ছে। মানুষের বিভিন্ন প্রয়ােজন মেটাতে এসব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘ গড়ে ওঠেছে। অন্যান্য সংঘের মতাে রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংঘ। প্রত্যেক সংঘের রয়েছে স্বাধীন কর্মক্ষেত্র এবং কর্মপদ্ধতি প্রয়ােজনবােধে রাষ্ট্র এসব সংঘের মধ্যে মধ্যস্থতা অথবা সমন্বয়সাধন করবে। রাষ্ট্র একটি বিরাট প্রতিষ্ঠান কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান নয়। বহুত্ববাদীরা একত্ববাদী সার্বভৌমত্বের ধারণাকে অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব ইত্যাদি বলেছেন। রাষ্ট্র এমন একটি সংঘ যেটি শুধু রাজনৈতিক বিকাশসাধন করতে পারে অন্যান্য দিক পারে না, মানুষের জীবনের বিকাশসাধনের জন্য অন্যান্য সংগঠনের প্রয়ােজন হয়। যে সংঘ বা প্রতিষ্ঠান সমাজের যতটুকু সেবা করবে, তার ক্ষমতা ঠিক ততটুকু হওয়া উচিত। সুতরাং রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান মনে করা ভুল।

রাষ্ট্র মানুষের অঙ্গঃ রাষ্ট্র জীবনের ওপর কর্তৃত্ব কতে পারে না। MacIver বলেছেন, “কুঠার যেমন পেন্সিল কাটার অনুপযােগী, রাষ্ট্রও তেমনি ব্যক্তিজীবনের অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহের উন্নয়নের জন্য অনুপােযােগী।”

আইনের প্রেক্ষিতেঃ বহুত্ববাদীদের মতে, আইন রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্টি হয়নি। দুই এবং ক্সাবে-এর মতে, রাষ্ট্র আইনের অধীন। আইন সামাজিক জীবনের প্রতিফলন মাত্র। আইনের প্রামাণ্যতা নির্ভর করে তার দ্বারা সামাজিক সংহতির কতটা পরিপূর্ণ হয় তার ওপরে, সার্বভৌমের আদেশের ওপর নয়। আইনের উৎপত্তি হয়েছে রাষ্ট্রের উপত্তির পূর্বে, রাষ্ট্রও আইনের অধীন। একত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতার আদেশই আইন। বহুত্ববাদীরা একত্ববাদীদের এই দাবি মানেন। বহুত্ববাদীদের মতে, সরকার যেহেতু কতিপয় সাধারণ মানুষকে নিয়ে গঠিত, তাই তাদের মতে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পিত হলে স্বৈরাচারের আশঙ্কা থাকে। তাই তারা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে সামাজিক সংগঠনের হাতে রাখার পক্ষে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেঃ বহুত্ববাদীদের মতে, বর্তমান সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা বিপদজনক। আন্তর্জাতিকতার সার্বভৌম ক্ষমতার অহংকার অপেক্ষা সহযােগিতার মন্ত্র, বিশ্বভ্রাতৃত্বের আবেদন এবং মানবতার স্বপ্নই অধিক কাম্য।

বহুত্ববাদীদের মতে, রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা, জনমত ইত্যাদি মানতে হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ অসীম ক্ষমতা প্রয়ােগ করলে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে, বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হবে এবং দুর্বল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে। এ ছাড়াও বর্তমানে বিশ্বায়নের এই যুগে কোনাে একট রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বিভিন্ন কারণে একটি রাষ্ট্রকে আর একটি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার একটি কার্যকর শক্তি হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এর রাষ্ট্রের চরমক্ষমতা প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা যেমন চরম ও অবিভাজ্য, তেমনি মানবজীবনে সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। সংঘগুলাের ভূমিকার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এক কথায় বলতে পারি, একত্ববাদের বহু সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও সারাবিশ্বে একত্ববাদই প্রচলিত।