ভূমিকা: অধিকার ও স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে সাম্যের আদর্শ অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। বস্তুত সাম্য ব্যতিরেকে অধিকার ও স্বাধীনতার আদর্শ অর্থহীন হয়ে পড়ে। সমাজে সাম্যের আদর্শ স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হলে অধিকার ও স্বাধীনতার বাস্তবায়ন সহজে সম্ভব হয়। সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদাগত বিচারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বৈষম্য বর্তমান থাকলে, তাদের পক্ষে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ সমানভাবে ভোগ করা সম্ভবপর হয় না। এই কারণে ব্যক্তির রাজনীতিক জীবনের অধিকার ও স্বাধীনতার মতো সাম্যের আদর্শও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সাম্যের ধারণা প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য সম্পর্কিত আলোচনা সর্বকালের একটি বহু আলোচিত বিষয়। প্রাচীনকালের গ্রীক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ পর্যন্ত সকলেই সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সাম্যের আদর্শ মানুষের মনে সংগ্রামী চেতনার সৃষ্টি করেছে। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুগে যুগে মানুষ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের সামিল হয়েছে। ফরাসী বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা মূলত সাম্য ও সমানাধিকারের দাবি সম্বলিত ঘোষণা। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় (১৭৭৬) বলা হয় যে কতকগুলি অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও অভিন্ন মর্যাদা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রত্যেকে পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসী জাতীয় পরিষদের মানবাধিকার সম্পর্কিত ঘোষণা (১৭৮৯)-ও উল্লেখযোগ্য। এই ঘোষণা অনুসারে জন্মসূত্রেই সকলে স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন। প্রকৃত প্রস্তাবে মানবজাতির ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার মাধ্যমে সাম্যের আদর্শের মূল ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য মানুষের আত্মত্যাগের নজির ইতিহাসে অসংখ্য।


সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

সাম্য বলতে সমাজে সকলে সব বিষয়ে সমান হবে- একথা বোঝায় না: সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সকল মানুষই সমান। তাই প্রত্যেকে সমান সুযোগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বলতে সমস্ত বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতা বোঝায় না। বাস্তবে মানুষে মানুষে শারীরিক ও মানসিক গঠন ও গুণগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। এই সহজাত পার্থক্যের অবসান অসম্ভব। তাই একে অস্বীকার করা যায় না। মানুষে মানুষে শক্তি-সামর্থ্য ও বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্য আছে বলে প্রত্যেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুযোগ-সুবিধা বা ব্যবহার দাবি করতে পারে না। রাষ্ট্র যদি একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিককে একই মূল্য দেয় তা হলে প্রতিভার বিকাশ হবে না এবং সমাজের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The purpose of society will be frustrated at the outset if the nature of a mathematician met an identical response with that of the nature of a bricklayer.” সুতরাং রাষ্ট্র সকলকে সমান করবে বা সমাজে প্রত্যেকে সববিষয়ে সমান হবে এই অর্থ সাম্য শব্দটিতে ব্যবহৃত হয় না।

সাম্যের প্রকৃত অর্থ: সাম্যের প্রকৃত অর্থ হল সকলের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার সমতা। এই অর্থে সাম্য প্রত্যেকের আত্মোপলব্ধির সহায়তা করে। রাষ্ট্র কোন রকম পক্ষপাতিত্ব না করে প্রত্যেক নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দিবে, যাতে সকলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সমান সুযোগ পায়। অর্থাৎ কারও জন্য যেমন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকবে না, তেমনি প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে। রাষ্ট্রের কাজে বা আইনের চোখে সকল নাগরিকই সমান সুযোগ পাবে। আইনের চোখে সকল নাগরিকই সমান। এই অর্থে সাম্য একটি আইনগত ধারণা। অধ্যাপক ল্যাস্কিকে অনুসরণ করে সাম্যের মূল দুটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা হয়। (১) বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি। ল্যাস্কি বলেছেন: “Equality… means first of all the absence of special privilege.” এবং (২) সকলের জন্য যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা। ল্যাস্কির কথায়: “Equality means…that adequate opportunities are laid open to all.” বস্তুত সাম্য হল সমানুপাত নির্ধারণের একটি সমস্যা। ল্যাস্কি বলেছেনঃ “Equality is in fact largely a problem in proportion.”

অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকলে সমান সুযোগ পাবে: সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দিলেই প্রত্যেকে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের উন্নতি করতে পারবে তা বলা যায় না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব নেই। রাষ্ট্র কেবল সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে যাতে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকলে সমান সুযোগ পাবে। বার্কার বলেছেন: “It is derived from the supreme value of the development of personality-in each alike and equally but each along its own different line and its own separate motion.” সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সুযোগ-সুবিধার সমতাকে বলা হয়। কিন্তু এর ফলে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে এবং প্রত্যেকে একই রকম গুণগত যোগ্যতা অর্জন করবে তা বোঝায় না। তবে প্রকৃত সাম্য মানুষের আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে।

মার্কসীয় ধারণা: রাষ্ট্র প্রত্যেক ব্যক্তির পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের সমান সুযোগ সৃষ্টি করলে সাম্য সার্থক হবে অর্থাৎ সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রত্যেকে যে যার যোগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সমান সুযোগ পেতে পারে। তাই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব অসম্ভব। লেনিন বলেছেন: “..there can be no real, actual equality until all possibility of exploitation of one class by another has been totally destroyed.” মার্কসবাদীদের মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এবং সাম্য একসঙ্গে থাকতে পারে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের অবসানের মাধ্যমে সমাজে সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। এইভাবে আর্থনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও শ্রেণী-শোষণের বিলোপের দ্বারা সাম্যের পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে এবং প্রকৃত সাম্য সার্থক হতে পারে।