ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাম্যের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন: সাম্য সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাঁর A Grammar of Politics এবং Liberty in the Mordern State শীর্ষক গ্রন্থ দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ল্যাস্কি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে সকলের জন্য অভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অস্তিত্বকে সাম্য বলে না। সাম্য বলতে সকলের প্রতি একই রকম আচরণকে বোঝায় না। A Grammar of Politics গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “Equality does not mean identity of treatment.” সকল ব্যক্তির জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা অনভিপ্রেত। কারণ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অভাব, সামর্থ্য ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সকলের চাহিদা বা দাবি অভিন্ন নয়। এই পার্থক্যকে অস্বীকার করা যায় না। যদি তা করা হয়, তা হলে তা হবে সমাজের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে প্রত্যেকের জন্য তার কাজ অনুসারে পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একজন গণিতজ্ঞ এবং একজন রাজমিস্ত্রীকে একই রকম সুযোগ দিলে তার ফলাফল ভালো হতে পারে না।

বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়া: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে ব্যাপকভাবে সাম্য বলতে বোঝায় বিভিন্ন ভাবধারার ঐক্য (coherence of ideas)। প্রত্যেক ভাবধারার যথাযথ পর্যালোচনার উপর তিনি জোর দিয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত সত্তা বা সামর্থ্যকে বিকশিত করতে চায়। প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ অন্যান্যদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই সাম্য বলতে সামাজিক শক্তিসমূহের এক বিশেষ বিন্যাসকে বোঝায়। যার ফলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ থেকে কোন ব্যক্তি বঞ্চিত হবে না। সমাজে জীবনধারণের উদ্দেশ্যে যে শ্রম নিয়োজিত থাকে, তার সঙ্গে সুযোগের সামঞ্জস্য থাকবে। সামাজিক সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকবে। এই ভারসাম্যের ভিত্তিতে সাম্যের সৃষ্টি হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে সাম্য হল মৌলিকভাবে বৈষম্য দূরীকরণের এক বিশেষ প্রক্রিয়া।

সাম্যের ধারণা: ল্যাস্কির ব্যাখ্যা অনুসারে ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। এই কারণে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছা প্রকাশের ব্যবস্থা এমন হওয়া আবশ্যক যাতে প্রত্যেকেরই বক্তব্য মর্যাদা পায়। ল্যাস্কি বলেছেন: “…meaning of equality… lies in the fact that very differences in the nature of men require mechanisms for the expression of their wills that give to each its due hearing.” ব্যক্তিবর্গের প্রকৃতিগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকের বক্তব্যই যাতে গুরুত্ব পেতে পারে তার সুযোগ থাকা দরকার। অর্থাৎ প্রত্যেকের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এই অবস্থায় সাম্যের সৃষ্টি হবে। সাধারণভাবে সাম্য বলতে বোঝায় যে, ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বৈষম্যের অবসান আবশ্যক। কাজের সুযোগ-সুবিধা সকলে সমানভাবে পাবে। সকলে সুখে-স্বচ্ছন্দে বসবাসের ব্যাপারে সমানাধিকার লাভ করবে। কেউ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং সেই সূত্রে চূড়ান্ত উন্নতি করবে; আবার কেউ অবহেলা পাবে, তা হতে পারে না। এই ব্যবস্থা সাম্যের পরিপন্থী। সকলেই রাষ্ট্রের নাগরিক। তাই তাদের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। প্রত্যেকের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে স্ব স্ব বক্তব্য ব্যক্ত করার সুযোগ থাকতে হবে। এবং প্রত্যেকের মতামতকে মর্যাদা দিতে হবে। কাউকেই অবহেলা করা যাবে না।

ল্যাস্কি সাম্যের ধারণার কতকগুলি দিক তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ সাম্যের কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

(১) বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি: সাম্য বলতে বোঝায় বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতিকে। তিনি বলেছেন: “Equality, therefore, means first of all absence of special privileges.” সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দূর করতে হবে। সকলকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সকল নাগরিক সমানাধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্র সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য করবে না। রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রত্যেকের ভোটাধিকার থাকবে। প্রত্যেকের ভোটের সমান মূল্য থাকবে। তা ছাড়া প্রত্যেকেরই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার সমানভাবে থাকবে। এই প্রসঙ্গে ল্যাস্কি উত্তরাধিকার সূত্রে সুযোগ লাভের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে উত্তরাধিকারমূলক ব্যবস্থা সাম্যের পরিপন্থী। কাউকে উত্তরাধিকারসূত্রে কোন পদমর্যাদা প্রদান অনুচিত। সেক্ষেত্রে অযোগ্য লোকেরও ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ থাকে। ল্যাস্কির মতে প্রত্যেকের গুণগত যোগ্যতা অনুসারে কর্তৃত্ব প্রয়োগের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই ল্যাস্কি আইনসভার উত্তরাধিকারমূলক উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করেছেন।

(২) সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা: সাম্য বলতে সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানকে বোঝায় (adequate opportunities are laid open to all)। তবে ল্যাস্কির মতানুসারে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বলতে একই রকম সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায় না। এ কথার অর্থ এই নয় যে সকলকে একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কারণ সকলের গুণ ও প্রতিভা অভিন্ন নয়। শিশুর উপর পরিবারের প্রভাব পড়বেই। এবং এই প্রভাবের মূল্য কম নয়। এই কারণে একটি পরিশীলিত পরিবারের সন্তানের মানসিক বিকাশ একটি সাধারণ পরিবারের সন্তানের থেকে অধিক হওয়াই স্বাভাবিক। কোন রকম আইনের মাধ্যমে এই প্রভাবের অবসান অসম্ভব। তবে এর অর্থ এই নয় যে দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে না। প্রত্যেকের মানসিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। সকলের জন্যই শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ: ল্যাস্কির মতানুসারে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সকলকে আত্মোপলব্ধির জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা দরকার। এই আত্মবিকাশের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। সুতরাং সবাইকে শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া দরকার। যে কোন কাজ করতে গেলে শিক্ষার দরকার। শিক্ষা ছাড়া কোন কাজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা যায় না। তাই কাউকে কোন কারণেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা অনুচিত। প্রত্যেকের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা হলে সকলের সর্বোচ্চ আত্মবিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকে, তা হলে ক্ষমতা প্রয়োগের সামর্থ্যের ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা দেবে। সাম্যের অন্যতম শর্ত হল পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা। এই শর্ত পূরণের জন্য নাগরিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকা দরকার।

অত্যাবশ্যক চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত সুযোগ প্রদান: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের সুখী জীবনের দাবিকে রাষ্ট্র স্বীকার করবে এবং সেই দাবি পূরণের ব্যবস্থা করবে। সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থার স্বার্থে মানুষের মৌলিক দাবি মেটাতে হবে। কিছু কিছু বস্তু মানুষের কাছে অপরিহার্য। এই সমস্ত জিনিস ছাড়া জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার স্বীকার করতে হবে। এবং রাষ্ট্রকে এই সমস্ত প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কাউকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্রয়োজন বা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The urgent claims of all must be met before we can meet the particular claims of some. ” তবে সমাজকল্যাণের দিকে নজর রেখে বিশেষ সুযোগ প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তা ছাড়া কেবলমাত্র জের কাজের পারি যক হিসাবে ব্যক্তি এই সুযোগ পেতে পারে। ব্যক্তিকে নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে হবে। এই রকম অতিরিক্ত সুযোগের অধিকার স্বীকার করা উচিত। নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে। তবে সমাজের সকলকে সমপর্যায়ভুক্ত করা যায় না। একজন শল্য-চিকিৎসক অবশ্যই একজন খনি শ্রমিকের থেকে অধিকতর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারী হবেন। কারণ এই দু’জনের প্রয়োজন পৃথক। এবং এই প্রয়োজন তাঁদের কর্ম ক্ষমতার সমানুপাতিক। তবে খনি-শ্রমিকের মৌলিক দাবি না মিটিয়ে শল্য-চিকিৎসকের বিশেষ দাবি পূরণের প্রশ্ন উঠে না। প্রত্যেকের অত্যাবশ্যক বা মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা আগে করতে হবে। কেবল তারপর সমাজের প্রতি বিশেষ অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে কারুর জন্য অতিরিক্ত সুযোগের ব্যবস্থা করা যায়। ল্যাস্কির মতানুসারে কারো বিশেষ দাবি পূরণের আগে সমাজের সকলের অত্যাবশ্যক দাবি পূরণ করতেই হবে। সর্বাগ্রে সমগ্র সমাজের স্বার্থে সভ্যতার ন্যূনতম ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। কেবল তারপরেই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের পার্থক্য স্বীকার করা উচিত। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The differences in the social and economic position of men can only be admitted after a minimum basis of civilization is attained by community as a whole.” সঙ্গে সঙ্গে ল্যাস্কি এও বলেছেন যে সভ্যতার সংশ্লিষ্ট ন্যূনতম ভিত্তি প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত হওয়া চাই। তাঁর অভিমত হল: “That minimum basis must admit of my realising the implication of personality.”

উপরিউক্ত বিষয়ে ল্যাস্কি তাঁর বক্তব্যের বিশদভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন: “ব্যক্তি মানুষের প্রাথমিক দাবি মেটাতেই হবে। এবং তার কর্মক্ষমতার বিষয় বিচার করা চলবে না।” সকল মানুষের মৌলিক দাবি সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকের ন্যূনতম দাবি আগে মেটাতে হবে। তার আগে কারও বিশেষ সুবিধা বা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বিবেচনা করা যাবে না। সরকারকেই সকলের মৌলিক দাবি পূরণের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তার পর কাউকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে মানবকল্যাণের বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মানব কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। এবং সেই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।

আনুপাতিকতার সমস্যা: ল্যাস্কি বলেছেন যে, কাজের অনুপাতে ব্যক্তিকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এবং তাঁর মতানুসারে মূলত আর্থিক ক্ষেত্রে এই সুযোগ সুবিধা দেওয়া দরকার। অর্থাৎ সাম্য হল মূলত একটি আনুপাতিকতার সমস্যা। ল্যাস্কি বলেছেন: “…equality is most largely a problem in proportions.” তাঁর আরও অভিমত হল যে আনুপাতিক সমস্যা হল প্রধানত আর্থনীতিক সমস্যা (“…the problem of proportions is largely an economic problem.”)। আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধার বণ্টন হল একটি তাত্যন্ত সমস্যাজড়িত বিষয়। সমাজের সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে এই সমস্যার সঠিক সমাধান আবশ্যক। প্রত্যেক নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর কথা মাথায় রেখে দেশের অর্থব্যবস্থার কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।

আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বন্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা: আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধার বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধানত দু’ধরনের পদ্ধতির কথা বলা হয়। একটি মত হল যে, ব্যক্তির আর্থিক দাবি-দাওয়া তার প্রয়োজন অনুসারে পূরণ করা দরকার। আর একটি মত হল যে, তার অবদান অনুসারে ব্যক্তিকে আর্থিক সুযোগ প্রদান করা প্রয়োজন। আর্থিক সুবিধা বন্টনের ব্যাপারে ল্যাস্কি এই দুটি পদ্ধতির কোনটিকেই সমর্থন করেননি। তাঁর মতানুসারে প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক দাবি পূরণ সম্পর্কিত কমিউনিস্ট পদ্ধতিকে পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না। তার পিছনে একাধিক কারণ বর্তমান। ল্যাস্কির মতানুসারে কমিউনিস্ট মতামত কেবলমাত্র মানুষের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া যায়। অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণের পর কমিউনিস্ট বক্তব্য আর অনুসরণ করা যায় না। কারণ তখন মানুষের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সকলের প্রয়োজন এক রকম হয় না। আবার সকলেই এক রকমের কাজ করে না। ব্যক্তিবর্গের কাজের পরিমাণে ও গুণগত মানে পার্থক্য থাকে। আবার ব্যক্তির অবদান অনুসারে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের নীতিও সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। কাজের অনুপাতে ব্যক্তির বেতন নির্ধারণের অসুবিধা অনেক। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে কাজের মূল্য নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন বিষয়। নিউটন, লিস্টার, সেক্সপীয়র বা রবার্ট ওয়েন প্রমুখ মনীষীর কাজের মূল্যায়ন মোটেই সহজ নয়। মানুষ গ্যালিলিও’র মতবাদের অবদান প্রথমে অনুধাবন করতে পারেনি। ল্যাস্কির মতে একজন ব্যাঙ্ক মালিক বা রাজমিস্ত্রী উভয়েরই সমাজের প্রতি অবদান আছে। কিন্তু কার অবদান কতটুকু তার মূল্যায়ন মোটেই সহজ নয়। এই সমস্ত কারণের জন্য অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত হল যে, প্রত্যেকের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন আগে পূরণ করতে হবে। তারপর যে যার কাজের প্রয়োজন অনুসারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করা যেতে পারে। প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগের ব্যবস্থার প্রতীক হল মানুষের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে সাম্য। ল্যাস্কি বলেছেন: “Equality…involves up to the margin of sufficiency in identity of response to primary needs.”

আর্থিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ: ল্যাস্কি আর্থনীতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য না থাকলে রাজনীতিক ক্ষমতা আর্থনীতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। আর্থনীতিক সাম্য ব্যতিরেকে রাজনীতিক সাম্য অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “Politi cal equality is never real unless it is accompanied by virtual economic equality, political power is bound to be the handmaid of economic power.” ধনবৈষম্যমূলক শ্রেণীসমাজে সাম্যের অস্তিত্ব অসম্ভব। ধনী ও দরিদ্র এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত সমাজে সাম্য থাকতে পারে না। এ ধরনের সমাজে সম্পদশালীরা অধিক সুবিধার অধিকারী হবেই। সমাজে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য থাকলে সরকারী যন্ত্র সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হবে। সমাজ সংখ্যালঘু ধনী ও সংখ্যাগুরু দরিদ্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়লে সরকারী যন্ত্র ধনিক শ্রেণীর দ্বারা তাদেরই স্বার্থে পরিচালিত হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “A state divided into small number of rich and a large number of poor will always develop a government manipulated by the rich to protect the amenities represented by their property.” আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য না থাকলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য থাকতে পারে না। সম্পদের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত হল: “Where there are great inequalities of fortune there is always inequality of treatment.” সমাজে সম্পত্তির মালিকানার মাধ্যমে মানুষ প্রভাব-প্রতিপত্তি কায়েম করে। সুতরাং সম্পত্তির মালিকানা না থাকলে সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় সকলের স্বার্থের বৈধতা সুনিশ্চিত হবে। এই কারণে ল্যাঙ্কি সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদের কথা বলেছেন। সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা অস্বীকৃত হলে ধনবৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিত হবে।