প্রাচীন গ্রীস: প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িক দার্শনিকগণ সর্বপ্রথম মানুষের স্বাভাবিক সাম্য ও সমানাধিকারের আদর্শ প্রচার করেন। স্টোয়িক দার্শনিকদের স্বাধীনতার ধারণার মতো সাম্যের ধারণাও ছিল রাজনীতি নিরপেক্ষ। তাঁদের মতানুসারে সব মানুষই সমান, তাই স্বাধীনতা হল সাম্যভিত্তিক। স্টোয়িক দার্শনিকরা বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আইন, বিশ্বজনীন নাগরিকতা এবং মানুষের স্বাভাবিক সাম্যের আদর্শের কথা বলেছেন। বস্তুত ক্রীতদাস প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে স্টোয়িকগণ মানুষের স্বাভাবিক সাম্যের কথা বলেছেন।
রোমক ও মধ্যযুগ: রোমান দার্শনিকরাও স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করেছেন। মধ্যযুগে খ্রীস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রচার করা হয়। সেন্ট পল (St. Paul) এই আদর্শ প্রচার করেন যে, মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষকে ঈশ্বরের সন্তান হিসাবে প্রচার করা হয়। তবে খ্রীস্টধর্মে মানুষের সাম্য স্বীকৃত হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিতে, কিন্তু পার্থিব সংসারে মানুষের মধ্যে অসাম্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ম্যুর (Thomas Moore) তাঁর Utopia গ্রন্থে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এক সাম্যবাদের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল সকল সামাজিক বিপত্তির কারণ।
লক্, ভল্টেয়ার, রুশো, জ্যাফারসন প্রমুখ: পরবর্তীকালে লক্, ভল্টেয়ার, রুশো, জ্যাফারসন প্রমুখ চিন্তাবিদদের হাতে সাম্যের তত্ত্ব বলিষ্ঠরূপ ধারণ করে। জন লক্ প্রাকৃতিক পরিবেশে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা ভোগের অধিকারের কথা বলেছেন। রুশো জনগণের অধিকার ও সাম্যের দাবিকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। টমাস পেইনের অভিমত হল সকলে সমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং সকলে সমানভাবে স্বাভাবিক অধিকার ভোগ করতে পারে। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীতে সাম্যের রাজনীতিক ও আইনগত ধারণাটি বিকশিত হয়। ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শকে বলিষ্ঠভাবে প্রচার করা হয়। ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের ঘোষণায় বলা হয় যে, মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন।’ প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীতেই অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে সাম্যনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। রিচি-র মতে, বৈষম্যের উত্তরাধিকার হিসাবে সাম্যের ধারণা উদ্ভব হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আইনগত ও রাজনীতিক সাম্যের ধারণা সুস্পষ্ট হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দী: ঊনবিংশ শতাব্দীতেই সাম্যের সামাজিক ও অর্থনীতিক আদর্শ সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। আবার এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেই সাম্য সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের অত্যুগ্র বাসনায় ব্যক্তিগত এক্তিয়ারের উপর সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিলোপ এবং সকল রকম বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অবসান দাবি করেন। তবে পরবর্তী কালে সাম্যের এই নেতিবাচক ধারণায় পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে সাম্য বলতে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের উপযোগী সুযোগ সুবিধার সমতাকে বোঝায়। এই অর্থে সাম্য প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করে। ল্যাস্কির মতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অবসান এবং সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাই হল সাম্য।
বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রীরা সাম্য শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার পক্ষপাতী। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বিকাশের আগে আইনের চক্ষে সাম্য এবং সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। বর্তমানে আর্থনীতিক সাম্যের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে মনে করা হয় যে, আর্থনীতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সামাজিক ও রাজনীতিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী-বৈষম্য, শ্রেণী-শোষণ প্রভৃতির অবসান ব্যতিরেকে যথার্থ সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। লেনিন বলেছেন: “We want to abolish classes and in this sense we are for equality.”
Leave a comment