‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভার জন্য একটি ভাষণ রচনা কর।
আজকের মহতী আয়োজনের সম্মানিত সভাপতি, মান্যবর প্রধান অতিথি ও উপস্থিত সুপ্রিয় সুধীবৃন্দ – আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ।
এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ দুকথা বলার যে বিরল সুযোগ পেয়েছি তা আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে উল্লেখ করছি । মূলত এক বৈষম্যহীন উদার পৃথিবী গড়ার যে শাশ্বত আহ্বান তা হয়তো আজ এখান থেকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে যাবে- সে আশার বাতিঘর হয়তো এ আলোচনা সভাই হতে পারে ।
প্রিয় সুধী
মানুষের পৃথিবী নানা ভাগে বিভক্ত; অথচ এ আধুনিক সভ্যতার যুগে এ ধরনের চিন্তা-বাতুলতা মাত্র । কিন্তু তারপরও সীমাহীন ভেদাভেদে মানুষের পরিচয় আজও নির্ণীত হয় । অথচ মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা-গবেষণা সমস্ত কিছুর মূলে রয়েছে এক সম্প্রদায়- নিরপেক্ষ ভাবদর্শন। মানুষ তবুও তার পরিচয়ে সম্প্রদায়কেই মুখ্য করে দেখে।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ
মানুষ জন্মের সময় কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নিয়ে জন্মায় না, তাহলে একই রক্ত-মাংসের মানুষ ভিন্ন হয় কী করে? স্বয়ং স্রষ্টাও তো মানুষকে ভিন্নভাবে, ভিন্ন নামে সৃষ্টি করেননি বরং তিনি তারই অপার প্রেমে আমাদের সৃষ্টি করেছেন । আর মানুষের সকল ভিন্নতাকে অস্বীকার করেই মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস উল্লেখ করেছেন সেই অবিস্মরণীয় বাণী— ‘সবার উপরে মানুষ সত্য ।’
উপস্থিত সুধীমণ্ডলী
তবে কি আমাদের মনে প্রশ্নের উদয় হয় না এই ভেদ-বিভেদের শুরু হলো কীভাবে? যখন আদি মানবেরা গুহাবাসী ছিল তখন কি সম্প্রদায়ের কোনো রকম-ফের ছিল— নিশ্চয়ই নয় । পৃথিবীতে মুনি-ঋষিরা এসেছেন মানুষের বিভেদের বার্তা নিয়ে নয়, বরং মানুষকে যথার্থ উপলব্ধির কথাই প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে । কিন্তু মানুষ তার ভুল ব্যাখ্যায় নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করে হীনস্বার্থ উদ্ধারে তৎপর ।
সুধীবৃন্দ
যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক নানা দ্বন্দ্বে রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পৃথিবী । অথচ নিবিড় দৃষ্টিতে দেখলে এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের কোনো পার্থক্য নেই । তারপরেও জাত-পাতের নানা দ্বন্দ্ব-বিভেদ আজও অব্যাহত । পৃথিবীর সভ্যতম ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত আমেরিকাতেও বর্ণ বৈষম্য আজও শেষ হয়নি । আফ্রিকা মহাদেশের কথা আমরা সকলেই জানি । সম্প্রতি আইএস তথা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চলছে তা মধ্যযুগের সমস্ত বর্বরতাকে হার মানিয়েছে ।
সুপ্রিয় সুধী
আমাদের মনে বংশানুক্রমে পাওয়া সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত রয়েছে; তাই হয়ত সুযোগ পেলেই এর অঙ্কুরোদগম ঘটে; আর তার ভয়াবহ পরিণতি সমস্ত মানবসভ্যতাকে তিরস্কৃত করে । অথচ মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ আরও বহু গুণিজন সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বর্ণ-বিভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন ।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ । এদেশে নানা সুফি, দরবেশ, পির, ফকির, সন্ন্যাসী, সাধক সম্প্রীতির যে আহ্বান জানিয়েছেন তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য । এ মহাদেশের প্রখ্যাত বাউল সাধক লালন শাহ সম্প্রদায়নিরপেক্ষতার চমৎকার যুক্তি তার গানে গানে ব্যক্ত করেছেন—
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না নজরে;
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীলোকের কি বিধান বামন
চিনে পৈত্যেয় প্রমাণ বামনি চিনে কী ধরে?
প্রিয় সুধী
সম্প্রদায়নিরপেক্ষতার সমস্ত কালিমাকে দূর করে বাউল আব্দুল করিম গেয়েছেন-
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-আর মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম ।…
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
বাঙালি তার রক্তে, শৌর্যে-বীর্যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষতার বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মানুষের এক ভেদাভেদহীন পৃথিবী নির্মাণ করেছে; তাই কবির যথার্থ উচ্চারণ—
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ।
প্রিয় সুধী
আবারও বলছি এ আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দানের জন্য আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক, মানুষের সম্প্রীতিতে বিশ্ব আনন্দময় হয়ে উঠুক । আপনাদের সকলকে অফুরন্ত ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি ।
Leave a comment