সাম্প্রতিককালে মানব সভ্যতা বিশেষভাবে গতিসম্পন্ন হয়ে পড়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অবশ্যই রাজনীতিক ক্ষেত্রে বেশকিছু সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটেছে। তারফলে মানবজাতির বাসভূমি এই পৃথিবীর চেহারা-চরিত্রের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন মুলুকের নিউইয়র্ক ওয়াশিংটনে সাড়া জাগানো সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ অবধি বিবিধ ঘটনাবলী মানবসভ্যতার ইতিহাসকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধের বিষয়টি দীর্ঘকালীন। ঠাণ্ডাযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় হল পুঁজিবাদ ও কমিউনিস্ট মতবাদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে এই মতাদর্শগত বিরোধ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে অমিত শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের ফলে। অবশেষে এই ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসানের পিছনে দুটি কারণ কাজ করেছে। ১৯৮৯-‘৯১ সালে পূর্ব ইউরোপীয় বিপ্লবের ফলে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান এবং অতি সম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের তাণ্ডব। ঠাণ্ডাযুদ্ধের সমাপ্তির সুবাদে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পরিণাম হয়েছে সুদূরপ্রসারী।

কমিউনিস্ট মতবাদের পতনের মতাদর্শগত ফলশ্রুতি বা তাৎপর্য হয়েছে ব্যাপকভাবে অর্থবহ। অবশ্য এ বিষয়ে বিতর্কও আছে। সমাজতন্ত্রবাদের উপর এই ঘটনার স্বাভাবিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ, বিশেষত সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রবাদ বা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মডেল উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে এবং বিশ্বের উন্নয়নশীল অঞ্চলে হীনবল হয়ে গেছে বা অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আবার এর ফলে গণতান্ত্রিক সমাজবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের অভিমত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সমাজ সমঝোতা করে কোনক্রমে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেছে। কমিউনিস্ট মতবাদ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের এবং সব থেকে প্রভাবশালী একটি ব্যাখ্যা আছে। তদনুসারে কমিউনিস্ট মতবাদের পতনের পরিণামে একটি মাত্র মতাদর্শই বিশ্বব্যাপী তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখতে সক্ষম। এই মতাদর্শটি হল পশ্চিমী ধাঁচের উদারনীতিক গণতন্ত্র; বিশেষতঃ উদারনীতিক গণতন্ত্রের মার্কিন মডেল।

কমিউনিস্ট মতবাদ বা সমাজতন্ত্রবাদের অবক্ষয়ের কারণে উদারনীতিবাদ এবং রক্ষণশীলতাবাদের অধিকতর বিকশিত ও শক্তিশালী হওয়ার কথা। কিন্তু কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের পতন উদারনীতিবাদের উপর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কারণ এ কথা কতকাংশে সত্য যে, বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রবাদ ও কমিউনিস্ট মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে বা বিরোধী মতাদর্শ হিসাবে উদারনীতিবাদ শক্তি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী মতাদর্শ অপসারিত হয়ে যাওয়ার ফলে একবিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদের সাবেকি চেহারা-চরিত্রের ঔজ্জ্বল্যে কতকাংশে ভাটা পড়েছে। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “The collapse or retrenchment of their traditional enemy means that in the twenty-first century liberalism and conservatism are each becoming more shapeless and differentiated.”

ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের ফলে কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শেরই অবক্ষয় ঘটেছে, এমন নয়; পৃথক প্রকৃতির প্রক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়েছে। কমিউনিস্ট মতবাদের ব্যাপকভাবে পতনের পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে বিশ্বজনীনভাবে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মতাদর্শগত শক্তির অভ্যত্থান ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট মতাদর্শসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল জাতীয়তাবাদ। বিশেষত জাতিতত্ত্বমূলক জাতীয়তাবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেশ কিছু উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে প্রাধান্যকারী মতাদর্শ মার্কসবাদ লেনিনবাদকে সরিয়ে জাতিতত্ত্বমূলক জাতীয়তাবাদ কায়েম হয়েছে। তাছাড়া উন্নয়নশীল দুনিয়ার অনেক অঞ্চলে ধর্মীয় মৌলবাদ বিভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

রাজনীতি বিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বিবিধ ঘটনা এবং আনুষঙ্গিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে মতাদর্শসমূহের কর্তৃত্বমূলক আমল অধুনা অনেকাংশে অতিক্রান্ত প্রাধান্যকারী কিছু মতাদর্শ সুদীর্ঘকাল ধরে রাজনীতিক দুনিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে এবং রাজনীতিক দুনিয়ার চেহারা চরিত্র নির্ধারণে কর্তৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করেছে। সংশ্লিষ্ট মতাদর্শসমূহ সাম্প্রতিককালে রাজনীতিক দুনিয়ায় কার্যকরি ভূমিকা হারিয়েছে এবং অনেকাংশে সাবেকি রাজনীতিক অবস্থান থেকে অপসারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হেউড মন্তব্য করেছেন: “At the very least the major ideological traditions are having to adjust to, and are in some cases are being re-defined by, a series of new and often interlinked challanges.”

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ‘মতাদর্শের সমাপ্তি’ (end of ideology) সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে আলোচনা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। এই ধারণার মূল কথা হল যাবতীয় উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের বিচারে মতাদর্শ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কার্যক্ষেত্রে রাজনীতির উপর অর্থনীতির কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। উন্নত ধরনের সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কিত নৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নসমূহ নিয়ে রাজনীতি অধুনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। রাজনীতির পরিসর এখন সীমাবদ্ধ; সীমাবদ্ধ প্রাচুর্যের সরবরাহ কীভাবে করা যেতে পারে এ রকম কিছু প্রায়োগিক প্রশ্নাবলীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিস্ট মতবাদের আগেকার আবেদন অধুনা অন্তর্হিত।

ডানিয়েল বেল (Daniel Bell): মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ ডানিয়েল বেল তাঁর The End of Ideology শীর্ষক গ্রন্থে মতাদর্শের সমাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় ডানিয়েল বেল গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পশ্চিমের রাজনীতিক দুনিয়ায় একটি মৌলিক ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমী প্রধান রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে মতাদর্শগত ব্যবধান ও বিতর্ক অপসারিত হয়। তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে ব্যাপকতর ভিত্তিতে সমঝোতার সৃষ্টি হয়। ডানিয়েল বেল যে রাজনীতিক প্রক্রিয়াটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা সর্বাংশে মতাদর্শের অবসান নয়; বিষয়টি হল প্রধান রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে মতাদর্শগত ঐকমত্য বা পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে ব্যাপক সম্মতি। তারফলে মতাদর্শগত বিরোধ-বিতর্ক চাপা পড়ে গেছে। হেউড (Andrew Heywood) এ বিষয়ে বলেছেন: “Bell drew attention to the exhaustion of rationalist approaches to social and political issues, and in the Afterword to the 1988 edition, he warned against tyranny of utopian end-states. He also helped to popularize the ‘post-industrialism’ highlighting to emergence of ‘information societies’ dominated by a new ‘Knowledge class’.”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের অব্যবহিত পরবর্তী পর্বে ‘উদারনীতিবাদ’, ‘সমাজতন্ত্রবাদ’ ও ‘রক্ষণশীল মতবাদ’—এই তিন রাজনীতিক মতাদর্শের প্রতিনিধিরা সাধারণ বা অভিন্ন একটি লক্ষ্য সম্পর্কে সহমত পোষণ করেন। সহমতভিত্তিক এই রাজনীতিক লক্ষ্যটি হল ‘নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ’ (managed capitalism’)। বস্তুত এই নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ পৃথক একটি রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। কারণ এ ধরনের ব্যবস্থায় কতকগুলি বিষয়ের উপর বিশেষ আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। এই বিষয়গুলি হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বাজার অর্থনীতি ও বস্তুগত উদ্দীপক বা প্রেরণা। এ সবের পিছনে সক্রিয় হয়েছে সামাজিক কল্যাণ ও আর্থনীতিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত বিশ্বাস বা অনুপ্রেরণা। প্রকৃত প্রস্তাবে মতাদর্শ হিসাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ‘কল্যাণমূলক পুঁজিবাদ’ (‘Welfare capitalism’) বা ‘সামাজিক গণতন্ত্র’ (‘social democracy’)। বিরোধী বা প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শসমূহের উপর ‘কল্যাণমূলক পুঁজিবাদ’ বিজয়ীর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। তবে এই কর্তৃত্ব খুব বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে নতুন ধরনের বামপন্থী ধারণার উদ্ভব হয়। এই সমস্ত বামপন্থী ধারণা অধিকতর র‍্যাডিক্যাল প্রকৃতির। মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদী চিন্তাধারায় পুনরায় আগ্রহ দেখা দেয়। আবার আধুনিক কিছু মতাদর্শেরও সৃষ্টি হয় এই সময়। আধুনিক এই সমস্ত মতাদর্শের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নারীবাদ’ (faminism) এবং ‘বাস্তুসংস্থানবাদ’ বা ‘ইকোলজিবাদ’ (ecologism)। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের আর্থনীতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির উপর পুনরায় আগ্রহ-আস্থার সৃষ্টি হয়। এই সময় অধিকারের প্রশ্নে নতুন মতবাদের সৃষ্টি হয়।

ফুকুয়ামা (Francis Fukuyama): মতাদর্শের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফুকুয়ামা ডানিয়েল বেলের বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ফুকুয়ামা তাঁর The End of History শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ফুকুয়ামা বিশ্বাস করেন না যে, রাজনীতিক মতাদর্শ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তাঁর অভিমত অনুযায়ী অন্য সকল রাজনীতিক মতাদর্শের উপর পশ্চিমী উদারনীতিবাদ তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর মতানুসারে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের উদীয়মান ঐকমত্য অনস্বীকার্য। এর অর্থ হল পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি এবং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিক ব্যবস্থা। ফুকুয়ামা বৃহত্তর পটভূমিতে তাঁর বক্তব্য পর্যালোচনা করেছেন। ১৯৪৫ সালে ফ্যাসিবাদ অপসারিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটেছে। ফুকুয়ামার মতানুসারে এই ঘটনার মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয় যে, গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তার তাৎপর্য হারিয়েছে। ফুকুয়ামার মতানুসারে রাজনীতিক ধারণাসমূহের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক মতাদর্শগত বিতর্কেরও অবসান ঘটেছে। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “By the end of history’ Fukuyama meant that the history of ideas had ended, and with it, fundamental ideological debate.”

ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার বক্তব্যের মধ্যে একটি সদর্থক বিশ্বাস বর্তমান। ধ্রুপদি উদারনীতিবাদ সূত্রে তিনি এই ইতিবাচক প্রত্যয়টি পেয়েছেন। তদনুসারে সমাজের সকল সদস্যই শিল্প পুঁজিবাদের সুবাদে সামাজিক সচলতা ও বস্তুগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ করে। স্বভাবতই নাগরিকমাত্রেই এ রকম পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত এবং আকর্ষণীয় বলে বিবেচনা করে। ১৯৮৯-‘৯১ সালের সময়কাল ব্যাপী পূর্ব ইউরোপীয় বিপ্লব এবং গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের মত অবশিষ্ট বা টিকে যাওয়া কমিউনিস্ট শাসনের মৌলিক সংস্কার সাধন বিশ্বব্যাপী মতাদর্শগত বিতর্কের চলে আসা ভারসাম্যকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

কিন্তু ইতিহাসের সমাপ্তি’ (end of history) শীর্ষক আলোচনায় ফুকুয়ামা মতাদর্শ সম্পর্কিত যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়।

(১) পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার ব্যাপকতা ও শক্তি-সামর্থ্যের গভীরতা বিরোধ-বিতর্কের উর্দ্ধে। এ কথা ঠিক। এতদসত্ত্বেও একথা বলা যাবে না যে, পুঁজিবাদ সকল সামাজিক শ্রেণী ও সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে।

(২) বিশ্বব্যাপী উদারনীতিবাদের জয়গান চলছে। এ বিষয়ে তেমন বিশেষ বিতর্ক নেই। এতদ্‌সত্ত্বেও বলা যাবে না যে, মতাদর্শগত বিবাদ-বিসংবাদ ও বিতর্কের অবসান ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল যে, বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবে। বাস্তবে তা হয়নি।

(৩) পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে এবং পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট মতবাদের অবসান ঘটে। কিন্তু এই ঘটনার ফলশ্রুতি হিসাবে উদারনীতিক গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় সম্পাদিত হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। বরং বলা যায় যে, কতকগুলি মতাদর্শের পুনরুভ্যুত্থান ঘটেছে। এই মতাদর্শগুলি হল জাতীয়তাবাদ; ধর্মীয় মৌলবাদ, জাতিগত উৎকৃষ্টতা সম্পর্কিত মতাদর্শ প্রভৃতি।

(৪) ফুকুয়ামা ইতিহাসের সমাপ্তি সম্পর্কিত আলোচনা পেশ করার পর অনতিবিলম্বে নতুন মতাদর্শগত শক্তিসমূহের আবির্ভাব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবহার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভিন্ন ধরনের মতাদর্শসমূহের অভ্যুত্থান পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল রাজনীতিক ইসলাম। রাজনীতিক ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তি এশিয়া-আফ্রিকার মুসলমান দেশগুলির সীমানা ছাড়িয়ে শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশগুলিতে এবং পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করে।

উত্তর আধুনিকতাবাদ (Postmodernism): উত্তর আধুনিকতাবাদকে সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের একটি উপায় বা ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা যায়। উত্তর আধুনিকতাবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় শিল্পায়ন ও শ্রেণী সংহতির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থা থেকে ক্রমবৰ্দ্ধমানভাবে বিখণ্ডিত বহুত্ববাদী তথ্য (imformation) সমাজে পরিবর্তন। এ রকম বহুত্ববাদী তথ্য-সমাজে ব্যক্তিবর্গ উৎপাদক থেকে ভোক্তায় রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া এই সমাজে শ্রেণীগত, ধর্মীয় ও জাতিগত আনুগত্যের জায়গায় কায়েম হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। উত্তর আধুনিকতাবাদে আলোচনা, বিতর্ক ও গণতন্ত্রের উপর জোর দেওয়া হয়। বিশ্বজনীন ও চূড়ান্ত সত্যের ধারণাকে উদ্ধৃত ও ভণ্ডামি বলে অগ্রাহ্য করা হয়। উত্তর আধুনিকতাবাদে নিশ্চয়তা বলে কোন কিছুকে স্বীকার করা হয় না। উত্তর আধুনিকতাবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, আধুনিক সমাজের সুপ্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্যসমূহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। আধুনিক সমাজে সৃষ্ট রাজনীতিক বিশ্বাস ও মতবাদসমূহ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

আধুনিক দুনিয়া গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের জন্মবৃত্তাত্ত নিহিত আছে। রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের মধ্যে কতকগুলি মূল (core) মতাদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়। এই সমস্ত মতাদর্শ থেকেই পরবর্তী কালের মতাদর্শসমূহের সৃষ্টি হয়েছে। উদারনীতিবাদ, রক্ষণশীলতাবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে পরবর্তী কালের রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে। মূল রাজনীতিক মতাদর্শসমূহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ার প্রতি বৈসাদৃশ্যমূলক প্রতিক্রিয়া। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার ত্রিবিধ মাত্রা বর্তমান। এই ত্রিবিধ মাত্রা হল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক। সামাজিক দিক থেকে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া সংযুক্ত ছিল ক্রমবর্দ্ধমান বাজারমূলক এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভবের সঙ্গে। নতুন সামাজিক শ্রেণীসমূহ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী এই অর্থনীতির উপর আধিপত্য কায়েম করেছে। সাংস্কৃতিক দিক থেকে উত্তর আধুনিকতাবাদ হল প্রবুদ্ধ বা জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার। তারফলে ধর্ম, রাজনীতি ও শিক্ষা-দীক্ষার ঐতিহ্যবাদী বিশ্বাস চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। যুক্তিবোধ ও প্রগতি সম্পর্কিত নীতিসমূহের প্রতি অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক দিক থেকে উত্তর আধুনিকতাবাদের অর্থ হল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে চরম রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপসারণ।

আধুনিকতাবাদী চিন্তাধারার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল ভিত্তিবাদ (foundationalism)। তদনুসারে বিশ্বাস করা হয় যে, বস্তুনিষ্ঠ সত্যসমূহ এবং বিশ্বজনীন মূল্যবোধসমূহ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সত্য ও মূলবোধসমূহ প্রগতির উপর গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত। আধুনিকতাবাদ উদ্ভূত হয়েছে বহুলাংশে জ্ঞানালোকে আলোকিত ধ্যান-ধারণা ও মতবাদসমূহ থেকে। আধুনিকতাবাদ রাজনীতিকভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে মতাদর্শগত ঐতিহ্যের মধ্যে। এই সমস্ত মতাদর্শগত ঐতিহ্য উন্নত জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণাসমূহ প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিবাদ এবং মার্কসবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উত্তর আধুনিকতাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী এই বিশ্বসংসারকে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার প্রচলিত উপায়-পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে অথবা পরিবর্তন সাধন প্রয়োজন। এ হল আধুনিকতাবাদ থেকে উত্তর আধুনিকতাবাদে সরে যাওয়া। আধুনিকতাবাদ ভিত্তিবাদের উপর আস্থাশীল। অপরদিকে উত্তর আধুনিকতাবাদ ভিত্তিবাদের বিরোধী। হেউড (Andrew Heywood) এ বিষয়ে বলেছেন: “… the central theme of postmodernism was summed up by Jean-Francois Lyotard (1984) as ‘incredulity towards meta-narratives’, meta-narratives being universal theories of history that view society as a coherent totality.” প্রধান প্রধান রাজনীতিক মতাদর্শসমূহ কোন-না-কোনভাবে উত্তর আধুনিক অবস্থাসমূহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তারফলে সংশ্লিষ্ট মতাদর্শসমূহ উত্তর আধুনিকতাযুক্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল উত্তর উদারনীতিবাদ, উত্তর মার্কসবাদ ও উত্তর নারীবাদ।

উত্তর আধুনিকতাবাদীরা আপাত কঠিন বাস্তবতা ও স্বীকৃত বিশ্বাসের বিরামহীন প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী কোনভাবেই কোন পরম মতবাদ সরবরাহ করা সম্ভব নয়। কারণ এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে সকল জ্ঞান অবশ্যই স্থানীয় ও নির্দিষ্ট হবে। তারফলে দুটি বিষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। একরূপতা ও পার্থক্যের মতামত নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আবার রাজনীতিক চাহিদাসমূহকে সংগঠিত করার ব্যাপারে নয়া সামাজিক আন্দোলনসমূহের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল পুঁজিপতি বিরোধী আন্দোলন, বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি। এই সমস্ত আন্দোলন প্রভাবিত হয়েছে বিশিষ্ট কিছু চিন্তাবিদের রচনার দ্বারা। এই সমস্ত চিন্তাবিদদের মধ্যে দু’জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন চমস্কি (Noam Chomsky) ও ক্লেইন (Naomi Kleim)। এদের মধ্যেই একবিংশ শতাব্দীর নতুন রাজনীতির মডেলের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। একদিক থেকে বিচার করলে, উত্তর আধুনিকতাবাদ মতাদর্শের সমাপ্তিই সুচিত করে। সামাজিক জীবনকে সংগঠিত করার উপায় হিসাবে এবং চিন্তার একটি ধরন হিসাবে মতাদর্শের অবসান উত্তর আধুনিকতাবাদের একটি বিশেষ দিক। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “As more or less coherent bodies of ideas that offer a critique of existing society by developing the image of a preferred alternative, political ideologies cannot but be guilty of foundationalism, regardless of whether they constitute full fledged meta-narratives.”

প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শগত ঐতিহ্যের সঙ্গে উত্তর আধুনিকতাবাদের ধারণাসমূহের সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ আয়োজনের দ্বারা নতুন মতাদর্শগত চিন্তাভাবনা উজ্জীবিত হয়েছে। তারফলে বিভিন্ন ধরনের উত্তর আধুনিক মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল তিনটি উত্তর আধুনিক মতাদর্শ। এগুলি হল: উত্তর-উদারনীতিবাদ, উত্তর-মার্কসবাদ এবং উত্তর-নারীবাদ। উত্তর আধুনিকতাবাদকে অনেক সময় বিলম্বিত আধুনিকতা হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। উত্তর আধুনিকতাবাদ একাধারে প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শসমূহের রূপান্তর সাধন করেছে এবং নতুন মতাদর্শগত আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বেশি কিছু নতুন সামাজিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ইকোলজিবাদ ও র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ। প্রধান রাজনীতিক মতাদর্শসমূহ বিভিন্নভাবে আধুনিকীকরণের ফসল হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক সমাজে রূপান্তর ভূমিকা ও প্রকৃতিগত কারণে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পায়ন ও শ্রেণীসংহতির দ্বারা আধুনিক সমাজের কাঠামো নির্ধারিত হয়। অপরদিকে উত্তর-আধুনিক সমাজ হল ক্রমবৰ্দ্ধমানভাবে বিচ্ছিন্ন ও বহুত্ববাদী।

উত্তর আধুনিকতাবাদী ‘নতুন রাজনীতি’-র ব্যঞ্জনা বিশেষভাবে গভীর। উদাহরণ সহযোগে অ্যান্ড্রু হেউড বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। উত্তর প্রভাবে রাজনীতিক দলগুলি মতাদর্শগত ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারফলে রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উদ্দেশ্যগত চেতনা বোধ এবং আবেগপূর্ণ সংযোগের ভিত্তি। রাজনীতিক দলগুলি বহুলাংশে নির্বাচনী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। দলগুলি আজকাল রাজনীতিক বেচাকেনা এবং ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়েই ব্যস্ত। অথচ সাবেকি ধারায় রাজনীতিক দলগুলির স্ব স্ব রাজনীতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য ও অঙ্গীকারবদ্ধতা ছিল বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ঐতিহ্যমূলক মতাদর্শগত আনুগত্যকে দলগুলি পরিত্যাগ করেছে। মতাদর্শ-নিরপেক্ষ হয়ে দলগুলি অধুনা পরিচালনাবাদের দীক্ষা নিয়েছে।

উত্তর আধুনিকতাবাদের সীমাবদ্ধতার দিকগুলিও আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) উত্তর আধুনিকতাবাদের সুবাদে মূল ধারার রাজনীতিক দলগুলি ব্যক্তিগত স্বার্থ বা বস্তুগত সুযোগ সুবিধা সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতির বাইরে ভোটদাতাদের সামনে বৃহত্তর কোন মতাদর্শমূলক বিষয়ের অবতারণা করে না। নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে যারা গভীরতর রাজনীতিক বিচার-বিবেচনার সঙ্গে সংযুক্ত, তাঁরা চরমপন্থী কোন গোষ্ঠী বা দলের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

(খ) উত্তর-আধুনিকতাবাদের আলোচনা থেকে এ কথাটি স্পষ্ট করে জানা যায় না যে, মানুষের রাজনীতিক জীবনকে কতদূর পর্যন্ত মতবাদ-নিরপেক্ষ করা সম্ভব।

(গ) মতাদর্শ-নিরপেক্ষ রাজনীতিক দল আদর্শবাদী হয় না, হয় অধিকতর বাস্তববাদী। মতাদর্শ-নিরপেক্ষ রাজনীতি রাজনীতিক দর্শন দেয় না, দেয় রাজনীতিক ফলাফল।

(ঘ) মূল ধারার রাজনীতিক মতাদর্শের প্রতি অঙ্গীকার আনুগত্যের অবক্ষয় ঘটেছে এবং রাজনীতিক দলগুলি পরিচালনবাদী দলে পরিণত হয়েছে। তারফলে রাজনীতিক দলের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং ভোট প্রদানের হারও হ্রাস পাচ্ছে। কারণ ভোটদাতাদের মধ্যে নৈতিক অঙ্গীকার ও মতাদর্শগত আবেগের অভাব ঘটেছে।

(ঙ) মতাদর্শ-নিরপেক্ষ রাজনীতি বিরোধী শক্তিসমূহকে এবং রাজনীতিক অসন্তোষকে সম্যকভাবে অভিব্যক্ত করতে পারে না।

(চ) সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী উত্তর আধুনিকতাবাদ রাজনীতিক বিচারে রক্ষণশীল। এ ধরনের রাজনীতি ভিত্তিবাদ-বিরোধী (anti-foundationalist)। এই ভিত্তিবাদ-বিরোধী অবস্থানের কারণে কোন সুসংহত পটভূমি থাকে না। এ রকম একটি প্রেক্ষাপট না থাকার জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনা করা যায় না। একই কারণে বিকল্প একটি সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না।

বিশ্বায়নবাদ (Globalism): বিশ্বায়ন হল এটি অস্বচ্ছ ও ব্যাপকভাবে অর্থবহ একটি ধারণা। অনেকে বিশ্বায়ন বলতে ‘সীমারেখাহীন বিশ্ব’-এর কথা বলেন। বিশ্বায়ন মানুষের মধ্যে জাতি ও রাষ্ট্রের সীমাতিক্রান্ত সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্ত। সামাজিক আয়তনের এ এক নতুন বাহ্যিক নকশা। এর মধ্যে অঞ্চলের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংযোগ সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান পরিধি সকল রকম সীমাকে অতিক্রম করে যায় এবং আন্তমহাদেশীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। ভৌগোলিক ব্যবধান বিশেষভাবে হ্রাস পায়। তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর জাতিরাষ্ট্রসমূহের সাবেকি একচ্ছত্র অধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ আর থাকে না। বিশ্বায়ন হল বিভিন্ন দিক থেকে পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্কের এক জটিল ঢেউ। জাতি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক সীমারেখা ক্রমশঃ গুরুত্ব হারাচ্ছে। বিশ্বায়ন হল ঠাণ্ডাযুদ্ধের পরবর্তী কালের সাম্রাজাবাদী অভিব্যক্তি। এ হল ‘লগ্নী পুঁজির বিশ্বায়ন’। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটি হল সুসংহত একটিমাত্র বিশ্ববাজারের পুঁজি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও তথ্যাদির পৃথিবীব্যাপী প্রবাহসমূহের সম্প্রসারণ ও গভীরতার বৃদ্ধি সম্পর্কিত। এ হল জাতিরাষ্ট্রসমূহের রাজনীতিক সীমানাকে ছাড়িয়ে আর্থনীতিক কার্যকলাপের সম্প্রসারণ। এ হল বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোন দেশের আর্থনীতিক সংযোগ সাধন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন হল মুক্ত অর্থনীতির দ্যোতক। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে ‘ম্যাকডোনাল্ডীকরণ’ (McDonaldization) নামেও অভিহিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি অংশে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী, ধ্যান-ধারণা এবং তথ্যাদি এক বিশ্বধারার সামিল হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক কোম্পানীসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ এবং বিশ্ব-দ্রব্য সামগ্রীর উদ্ভব আংশিকভাবে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করে।

রাজনীতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের অভিব্যক্তি ঘটে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় রাজনীতিক মতাদর্শের উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিবাদের রূপান্তরের কথা বলা যায়। তা ছাড়া রাজনীতিক বিশ্বায়নের অভিব্যক্তি হিসাবে বেসরকারী সংগঠনসমূহের (NGOs) উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার; জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকাগত পরিবর্তনের কথা বলা যায়।

আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রকৃতি ও প্রকাশ রাজনীতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্কের সুবাদে ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও অস্থায়িত্বের প্রবণতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দিক থেকে বিচার করলে মতাদর্শ আগেকার দিনের সহজ সরল পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের বিষয় হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। সমকালীন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সমস্যাদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা এবং সুসংহত সমাধান সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক মতাদর্শ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজনীতিক মতাদর্শের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব প্রতিক্রিয়া তাৎপর্যপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট মতাদর্শগুলি হল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ। তবে সাধারণভাবে সকল মতাদর্শের উপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী।

রাজনীতিক মতাদর্শের উপর বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নানাভাবে পরিলক্ষিত হয়।

(১) বিশ্বায়ন বিবিধ বিরোধী শক্তির জন্ম নিয়েছে। উন্নয়নশীল দুনিয়ায় মৌলবাদ অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বিশ্বায়নকে বহুলাংশে পশ্চিমী বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি ধরন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আবার উন্নত দুনিয়ার দেশগুলিতে বিশ্বায়ন বিরোধী বা পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন দেখা দিয়েছে।

(২) জাতীয়তাবাদের উপর এবং জাতিগত ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য মতদর্শগত কর্মসূচীর উপর বিশ্বায়নের প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতি-রাষ্ট্রসমূহ ‘উত্তর-সার্বভৌম (Post-sovereign) পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে অবস্থান ও কাজ করে। এ রকম অবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সঙ্গে সংযুক্ত রাজনীতিক জাতীয়তাবাদ অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়।

(৩) বিপরীতক্রমে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কারণ রাজনীতিক আনুগত্য ও নাগরিক বিশ্বস্ততা সৃষ্টির ব্যাপারে জাতি রাষ্ট্রসমূহের সামর্থ্য হ্রাস পেতে থাকে।

(৪) বিশ্বায়নকে কোনভাবেই একটি নিরপেক্ষ মতাদর্শগত শক্তি হিসাবে গণ্য করা যায় না। বরং বলা যায় যে, বিশ্বায়ন নয়া উদারনীতিবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। কারণ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস পায়, কিন্তু বাজারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

(৫) আধুনিক উদারনীতিবাদ এবং সামাজিক গণতন্ত্রের মধ্যে সমঝোতা সম্পাদিত হয়েছে। কারণ জাতীয় আর্থনীতিক ব্যবস্থাদি পরিচালনার কৌশলসমূহ টিকে থাকার সামর্থ্য ক্রমশ হারাচ্ছে। ঐতিহ্য ও জাতীয় স্বাতন্ত্র্য হীনবল হয়ে পড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে রক্ষণশীলতাবাদ বিশ্বায়নবাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে বাধ্য হচ্ছে।

(৬) বিশ্বায়নবাদের দুটি বিকল্প রূপ বর্ণনা আছে: 

  • (ক) নয়া উদারনীতিক বিশ্বায়নবাদ (Neoliberal Globalism) এবং 

  • (খ) রাষ্ট্র-নিরাপত্তা বিশ্বায়নবাদ (State security Globalism)।

(ক) নয়া উদারনীতিক বিশ্বায়নবাদ: বাজার ভিত্তিক আর্থনীতিক কাঠামো ও মূল্যবোধের সঙ্গে নয়া উদারনীতিক বিশ্বায়নবাদ সম্পর্কিত। এ দিক থেকে বিচার করলে বিশ্বায়নের মূল কথা হল একটি বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলা। এই অর্থনীতি রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস করে, বিশেষতঃ সামাজিক কাঠামোর রূপাত্তর সাধনের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সামর্থ্যকে কমিয়ে দেয়; কিন্তু এই অর্থনীতি অতিজাতিক বা বহুজাতিক নির্গমসমূহের স্বার্থকে বিকশিত করে। এ-দিক থেকে বিচার করলে বিশ্বায়ন উদারনীতিক পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয়কে সুনিশ্চিত করে।

(খ) রাষ্ট্র-নিরাপত্তা বিশ্বায়নবাদ: বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি এবং এ ব্যাপারে সাধারণভাবে পশ্চিমী শক্তিসমূহের এবং বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জবাব—এর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্র-নিরাপত্তা বিশ্বায়নবাদ। এ হল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সীমানাহীন যুদ্ধ। রাষ্ট্র-নিরাপত্তা বিশ্বায়নবাদ হল একাধারে মানবতাবাদী আদর্শ ও উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহের প্রতিরক্ষা এবং বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ-আয়োজন। এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হল পৃথিবীর একমাত্র অবশিষ্ট অমিত শক্তিশালী রাষ্ট্র।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, রাজনীতিক মতাদর্শের উপর আক্রমণ এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। মতাদর্শের উপর প্রতিটি আক্রমণ নিজেই স্বতন্ত্র একটি মতাদর্শ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। মতাদর্শের সমাপ্তি, ইতিহাসের সমাপ্তি, উত্তর আধুনিকতাবাদ এবং বিশ্বায়নবাদ—প্রতিটি মতবাদই বিশেষ কিছু রাজনীতিক ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেছে। প্রতিটি মতবাদই নিজের বক্তব্যকে সংশ্লিষ্ট অপরাপর মতবাদের উর্দ্ধে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে এবং নিজেকে চূড়ান্ত মতবাদ হিসাবে জাহির করেছে। ইতিহাসের শিক্ষা হল এই যে, মতাদর্শের চূড়ান্ত অবসান ঘোষণা অনাবশ্যক। মতাদর্শগত বিতর্ক এখনও অব্যাহত এবং এই বিতর্ক চলছে বেশ ভালভাবেই। মতাদর্শ হল এক অবিরাম প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সমাপ্তিহীন। তবে মতাদর্শ সম্পর্কিত ইতিহাসের একটি নির্দেশমূলক প্রবণতা হল একটি মাত্র রাজনীতিক মতাদর্শকে বা রাজনীতিক বিশ্বাসকে বৈধতাযুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শটি উদারনীতিক গণতন্ত্র হতে পারে; হতে পারে সুচিন্তিত বা স্বেচ্ছাকৃত গণতন্ত্র, বিশ্ব পুঁজিবাদ হতে পারে; আবার সামাজিক সংস্কারবাদও হতে পারে।