অথবা, মূল্যবােধের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।
ভূমিকাঃ সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রতিটি সমাজ, ধর্ম, জাতির কতকগুলাে বিধি বা নিয়মের অধীনে চলতে হয়। যেখানে মূল্যবােধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সমাজে মূল্যবােধ পরিমাপের কোনাে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। বিষয়ভেদে মূল্যবােধ ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকার হতে পারে। তবে যে আঙ্গিকেই বিচার করা হােক না কেন এটিকে সমাজের অলিখিত সামাজিক সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।
সামাজিক মূল্যবােধের বৈশিষ্ট্যঃ সমাজ কাঠামাের অন্যতম উপাদান হিসেবে মূল্যবােধের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখতে পাওয়া যায়। যথা-
(১) পরিবর্তনশীল ধারাঃ মানুষ সমাজে বসবাস করে। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে অনেক মূল্যবােধের মুখখামুখি হতে হয়, আর এ মূল্যবোেধ মূলত পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে মানুষ মূল্যবােধের পরিবর্তনশীল ধারার সাথে খাপখাওয়ায়। যেমন- অতীতে সতীদাহ প্রথা সমাজে ইতিবাচক মূল্যবােধ হিসেবে বিবেচিত হতাে। কিন্তু বর্তমানে এটি নেতিবাচক মূল্যবােধ হিসেবে বিবেচিত।
(২) মূল্যায়নের মাত্রাঃ সমাজে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবােধের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে বা উপযােগী মূল্যবােধ গ্রহণ করতে বিচার শক্তির দরকার হয়। তাই মানুষ সমাজ এবং নিজের জন্য উপযােগী মূল্যবােধকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ণ করে গ্রহণ করে। যা তার ভালাে-মন্দ বাছাইয়ের পরিচায়ক হিসেবে প্রকাশ পায় ।
(৩) পছন্দক্রম বা নির্বাচনমুখিতাঃ সামাজিক মূল্যবােধের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলাে এর নির্বাচনমুখিতা। যেখানে অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে থেকে সহজলভ্য বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে গুণগত ধারা বা পছন্দক্রম একটা যৌক্তিক মাত্রায় হয়ে থাকে।
(৪) আদর্শ ও বিশ্বাস নির্ভরতাঃ একটা সমাজে কোনাে মূল্যবােধ গড়ে ওঠে সব মানুষের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবােধের মাধ্যমে। যেখানে ব্যক্তির মূল্যবােধগুলাে সমাজের সকল সদস্যের মূল্যবােধের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
(৫) সামাজিক অংশীদার ভিত্তিকঃ সমাজে মানুষ একত্রে বসবাস করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সহযােগিতা বা সম্পৃক্ততা গড়ে তােলে। আর মূল্যবােধের ভিত্তি রচিত হতে হলে সেখানে সামাজিক অংশিদার ভিত্তিক ব্যবস্থা চাল থাকতে হয়। কেননা সমাজের সকলের ইচ্ছার প্রতিফলন হয় সমাজের মূল্যবােধকে সমুন্নত রাখার মাধ্যমে।
(৬) আপেক্ষিকতাঃ সামাজিক মূল্যবােধ সমাজের একটি বিশেষ দিককে নির্দেশ করে। যেখানে সমাজ ভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এ কারণে মূল্যবােধ একটি আপেক্ষিক বিষয় হিসেবে কাজ করে। যেমন- আমাদের দেশে অতিথিদের মদ পরিবেশন করা নেতিবাচক মূল্যবােধ হলেও পশ্চিমা দেশগুলাের জন্য এটি ইতিবাচক মূল্যবােধ।
(৭) সমাজের দর্পণঃ সামাজিক মূল্যবােধ জাতীয় সত্ত্বার বিকাশে পরিপূর্ণতা আনয়নের সহায়ক শক্তি। একটি সমাজের মানুষেরা তাদের নিজেদেরকে এক করে ভাবে তখন যখন সমাজের মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মূল্যবােধগুলাে উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। সামাজিক মূল্যবােধ ব্যতিত কোনাে দেশ, জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মর্যাদা বিকশিত হতে পারে না। তাই এটি সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে।
(৮) সামাজিক বিধানঃ কোনাে সমাজের মধ্যে মূল্যবােধগুলাে লিখিত ভাবে থাকে না। তবুও মানুষ সামাজিক জীবন পালন করতে গিয়ে এগুলাে সুচারুরূপে পালন করতে চেষ্টা করে। আর মানুষ যখন তার মনােভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে তখন তা মূল্যবােধের রূপ নেয়। এটি সমাজে অলিখিত সামাজিক বিধান হিসেবে কাজ করে।
(৯) অপরিমাপ যােগ্যঃ সামাজিক মূল্যবােধ মানুষ তার সমাজ থেকে অর্জন করে। এটি মানুষের কোনাে সহজাত বিষয় নয়। আর এটি পরিমাপযােগ্যও নয়। সমাজের মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন সুশৃঙ্খল আদর্শভিত্তিক বিষয়গুলাে যাচাই করে মানুষ যেটি গ্রহণ করে এবং সমাজে তার প্রতিফলন ঘটায় তা মূল্যবােধ হিসেবে পরিচিতি পায়।
(১০) মূল্যবােধ অর্জনীয়ঃ যেহেতু মূল্যবােধ মানুষের কোনাে সহজাত বিষয় নয় তাই এটি সমাজ থেকে অর্জন করতে হয়। পরিবার হলাে সামাজিক মূল্যবােধ শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি প্রভৃতি মূল্যবােধ শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
(১১) একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাঃ ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির রীতি-নীতি, মনােভাব, বিশ্বাস, আদর্শ, এবং সমাজ অনুমােদিত আচার-আচরণের সমন্বয়ে মূল্যবােধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলে ব্যক্তিগত মূল্যবােধ যেমন প্রভাবিত হয় ঠিক তেমনি সামাজিক ও দলীয় মূল্যবােধ একত্রে কাজ করে। সমাজে যখন একটি মূল্যবােধ সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে তখন সেই সমাজের আদর্শভিত্তিক ধারা উন্নয়নে অবদান রাখে।
(১২) সামাজিক মানদণ্ডঃ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে গতিশীলতা আনতে এবং সমাজের মধ্যে একটা নৈতিক ভিত্তি দাড় করাতে মূল্যবােধ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কেননা, সমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় বিচারের মানদণ্ড সামাজিক মূল্যবােধের দ্বারা নির্ণীত হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক মূল্যবােধ সমাজের এমন একটি অদৃশ্য শক্তি, যা আদর্শের মাপকাঠিতে সমাজের মূল্যবােধগুলাের একটা পরিগ্রহ সৃষ্টি করে। যেখানে সমাজের মানুষ সেগুলাে দ্বারা চালিত হয়। ফলে সমাজে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থায়ী হয়ে গড়ে ওঠে।
Leave a comment