ধারণাগত অস্পষ্টতা: সামাজিক ন্যায়ের ধারণাটি স্পষ্ট করে সংক্ষেপে বলা সহজ নয়। সামাজিক ন্যায় কাকে বলে এবং রাষ্ট্রের মধ্যে কীভাবে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও আর্থনীতিক মতবাদ বর্তমান। তা ছাড়া উদারনীতিক ও মার্কসবাদী চিন্তাবিদ্ ও আইনবিদরা এ ক্ষেত্রে পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। স্বভাবতই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রাত্যহিক জীবনে অনেককেই সামাজিক ন্যায়ের কথা বড় গলায় বলতে শোনা যায়। অথচ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কী চান তা সম্যকভাবে অনুধাবন করা দুরূহ ব্যাপার। অনেকে সম্পদের বণ্টন বা পুনর্বণ্টনকেই সামাজিক ন্যায় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। অনেকে আবার সুযোগ-সুবিধার সমতার কথা বলেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে জন্মগত কারণে গুণগত যোগ্যতা বা সম্ভাবনার ক্ষেত্রে পার্থক্য বর্তমান। সুতরাং সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। এই কারণে সামাজিক ন্যায় সম্পর্কিত ধারণাসমূহ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য: সামাজিক ন্যায় হল একটি আদর্শমূলক ধারণা। এই ধারণা অনুসারে জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের কথা বলা হয়। এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের কথা বলা হয়। জোহারী তাঁর Con temporary Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “….the ideal of social justice enviages to promote the welfare of the people by securing and developing a just social order.” সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে ব্যক্তির অধিকার এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এইভাবে বিদ্যমান আইন ও সমাজব্যবস্থার মধ্যেই ব্যক্তিবর্গের আইনসঙ্গত প্রয়োজনের পরিতৃপ্তি সাধন করা সম্ভব হবে। এই ব্যবস্থার একদিকে ব্যক্তির কল্যাণ সুনিশ্চিত হবে এবং অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে। সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে সর্বসাধারণের স্বার্থে ব্যক্তি মানুষের কিছু অধিকার পরিত্যাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। বৃহত্তর অর্থে সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বার্থ এবং জনসম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থের মধ্যে যথার্থ সামঞ্জস্য সাধনের কথা বলা হয়। তবে যদি এই দুই স্বার্থের মধ্যে বিরোধ বাধে, তা হলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে জনসম্প্রদায়ের সামগ্রিক ও বৃহত্তর স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং জনসম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থের মধ্যে সহযোগিতা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থানের উপর সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ নির্ভরশীল। জোহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…the rights of an individual should be reasonably restricted in the wider interests of his community so that the ends of social justice are properly achieved.”

সকলের জন্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা: সকল মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সুযোগ-সুবিধার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য কতকগুলি সামাজিক অবস্থার অস্তিত্ব অপরিহার্য। এই সমস্ত সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে কাউকেই বঞ্চিত করা যায় না। জনসম্প্রদায়ের মধ্যে এই সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতি ও অস্তিত্ব সামাজিক ন্যায়ের অস্তিত্বকে প্রতিপন্ন করে। সামাজিক ন্যায়ের স্বার্থে সমাজে মানুষের উপর মানুষের শোষণের অবসান আবশ্যক। সামাজিক সাম্য ও সামাজিক অধিকারের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের ধারণা সম্পর্কযুক্ত। শোষণ-পীড়ন ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এই কারণে সাধারণভাবে সামাজিক ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণাও এসে পড়ে। সমাজজীবনের বস্তুগত ও নীতিগত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন। সামাজিক পরিকল্পনাসমূহের এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ না থাকে, সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে যেন থাকে। এই উদ্দেশ্যে সমাজব্যবস্থার বিন্যাসের প্রয়োজন হতে পারে। ব্যাপক অর্থে সামাজিক ন্যায়ের মধ্যে সাম্য, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের এক সঙ্গত সহাবস্থানের কথা বলা হয়।

ব্যাপক অর্থে সামাজিক ন্যায়: প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক ন্যায় ধারণাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবকিছুই এই ধারণার অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক ন্যায় বলতে সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণকে যেমন বোঝায়, তেমনি আবার অশিক্ষা, নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণকেও বোঝায়। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, আইনের সমান সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রভৃতি সামাজিক ন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়ের এই ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অপরদিকে প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সামাজিক ন্যায় বলতে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অনাহার, অস্বাস্থ্য, অনগ্রসরতা প্রভৃতির অবসানকে বোঝায়। এদিক থেকে বিচার করলে বহু ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা সংকটের অবসানের মধ্যেই সামাজিক ন্যায়ের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর পশ্চাদপদ দেশগুলিতে সামাজিক ন্যায় বলতে সমাজের দারিদ্র্য পীড়িত, দুর্বল ও অনগ্রসর অংশের অবস্থার উন্নতি সাধনকে বোঝায়। এবং সামাজিক ন্যায়ের দাবি অনুসারে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। সমাজজীবন থেকে কায়েমী স্বার্থের অবসান আবশ্যক। কারণ এই কায়েমী স্বার্থই সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের পথে প্রতিবন্ধকতা করে। সুতরাং কায়েমী স্বার্থের অবসান ব্যতিরেকে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সমাজের সকলের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য যাবতীয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ আয়োজনই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সহায়ক বলে প্রতিপন্ন হয়।