অথবা, সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহ সংক্ষেপে লিখ।
ভূমিকাঃ সামাজিক ইতিহাস পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং সামাজিক মূল্যবােধের পরিবর্তন ধারা নিয়ে আলােচনা করে। সামাজিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে মানুষের অতীত জীবনের প্রতিচ্ছবি বর্তমানে মূর্ত হয়ে ওঠে। মানব সমাজের উষালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, আর্থ-সামাজিক সংগঠন প্রভৃতির মূর্ত প্রতিচ্ছবি সামাজিক ইতিহাসে ফুটে ওঠে। পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং সামাজিক মূল্যবােধের ধারাকে কেন্দ্র করেই সামাজিক ইতিহাস গড়ে ওঠে।
সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহঃ নিম্নে সামাজিক ইতিহাসের প্রধান উৎসসমূহ সংক্ষেপে আলােচনা করা হলােঃ
(১) স্মৃতিস্তম্ভ এবং অট্টালিকাঃ প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ এবং অট্টালিকাসমূহের ধ্বংসাবশেষ হলাে সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান উৎস ও উপাদান। এই স্মৃতিস্তম্ভ এবং অট্টালিকা একদিকে যেমন আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় বহন করে অন্যদিকে তা স্থাপত্য শিল্পের মান অনুধাবনে সাহায্য করে। যেমনঃ ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা ও ইতিহাসের উৎস উপাদান খুঁজতে ঐতিহাসিকেরা পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন।
(২) লিপির আবিষ্কারঃ কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ তার নিজের প্রয়ােজনীয় কথা লিপির মাধ্যমে পাথরের বুকে, তামার পাত্রে কিংবা পর্বতগাত্রে খােদিত করে রাখতাে। এ লিপিসমূহে সাধারণত শাসনসংক্রান্ত ঘােষণা, দানপত্র, ব্যক্তিগত দানপত্র, অনুশাসন ইত্যাদির বিবরণ খােদাই করে রাখা হতাে।
(৩) মুদ্রাঃ অনেক প্রাপ্ত মুদ্রা- যেগুলাে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য হতে উদ্ধারকৃত সেগুলাে সামাজিক ইতিহাস রচনার অপরিহার্য উৎস। মুদ্রা একদিকে যেমন ধাতব শিল্পের উৎকর্ষতার পরিচায়ক তেমনি অন্যদিকে মুদ্রার গায়ে লিখিত সন, তারিখ ও মুদ্রিত ছবি থেকে রাজ্যের সময়কাল, পরিসীমা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি, শাসক ও শাসকের ধর্মীয় অনুরাগ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
(8) হাতিয়ার ও আসবাবপত্রঃ ব্যবহারিক আসবাবপত্র ও হাতিয়ার দেখে সেগুলাে কোন যুগের তা সহজে চিহ্নিত করা যায়। যেমনঃ লৌহযুগ, ব্রোঞ্জযুগ, তাম্রযুগ, প্রস্তরযুগ ইত্যাদি।
(৫) এপিটাফঃ মানব জীবনের বিভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় এপিটাফের মাধ্যমে। এই জন্য ইতিহাসবিদগণ ইতিহাসের উৎস হিসেবে এপিটাফের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। ব্রাউন এর মতে, “এপিটাফ জীবনধারার সাক্ষী। এপিটাফ সমাজ চিত্রের দর্শন এবং এপিটাফের মাধ্যমেই একটি অঞ্চলে কোন কোন পেশার লােক বাস করতাে তার একটি ধারণা লাভ করা যায়।”
(৬) প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলীঃ প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলী সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রীতিনীতি, জীবনধারা সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়; যা সামাজিক ইতিহাস রচনার অন্যতম উৎস।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ গতিশীলতার মধ্য দিয়ে অতীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আজকের ঘটনা আগামীকাল ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। তাই অতীত সমাজকে অজানা রেখে তথা সামাজিক ইতিহাসের জ্ঞান অর্জন না করে আমরা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে পারবাে না। সামাজিক ইতিহাস সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি তুলে ধরে। তাই বলা যায় সামাজিক ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম।
Leave a comment