‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে অগ্রগতির সূচনা তা পরবর্তী পর্বেও অব্যাহত ছিল। এই পর্যায়ের সাময়িক পত্রগুলি সাহিত্য-দর্শন ইতিহাস-বিজ্ঞান ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে যেমন সজ্জিত হয়েছিল, তেমনি আন্তর্জাতিক ভাবনার সংবাদদানে পাঠক মনের জ্ঞানসীমানা বৃদ্ধি করেছিল। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা, পাশ্চাত্য সাহিত্যের আলোচনা বা অনুবাদকর্মের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ পরিবেশন, সামাজিক বাস্তবতার অসঙ্কোচ প্রকাশ, নব নব ভাবনা ও রীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কথ্যভাষানুগ গদ্য ব্যবহার ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহ নব্যতর আধুনিকতা রূপে এই পর্যায়ে দেখা দিয়েছিল।

সম্পাদক-পরিচয়: পূর্ববর্তী পর্যায়ের সাময়িক পত্রগুলির তুলনায় এই দ্বিতীয় পর্যায়ের সাময়িক পত্রে নবীন-প্রবীণ পুরুষ এবং মহিলা সম্পাদিকার আবির্ভাব দেখা যায়। অনেক সাময়িক পত্রের একাধিক সম্পাদকও দেখা যায়। বস্তুত, সম্পাদনার, সারথ্যেই এই দ্বিতীয় পর্যায়ের পত্রিকাগুলি প্রথা ও প্রগতি, বিনয় ও বিক্ষোভে, নীতিবাদিতা ও প্রাণোন্মাদনার দ্বন্দ্বে সমুন্নত হয়ে উঠেছিল।

‘বঙ্গদর্শনে’ বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনীয় যুগান্তকারী না হলেও একাধিক প্রতিভাবান সম্পাদক এই সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখা দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন(নবপর্যায়) ‘বঙ্গদর্শনে’র সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এবং পরবর্তীকালে মোহিতলাল মজুমদার, ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পাক্ষিক সমালোচক’ পত্রিকার সম্পাদক ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়, সাপ্তাহিক ‘সাধারণী’ ও মাসিক ‘নবজীবন’ পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ত্রৈমাসিক ‘ঐতিহাসিক চিত্রে’র সম্পাদক অক্ষয়কুমার মৈত্র, ‘বান্ধব’-এর কালীপ্রসন্ন ঘোষ, ‘পঞ্চানন্দ’ পত্রিকার ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গবাসী’র যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু, ‘ভ্রমর’-এর সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘অবোধবন্ধু’র বিহারীলাল চক্রবর্তী, আজীবন নেহার’-এর মীর মশাররফ হোসেন, ‘প্রবাহিণী’র অমরেন্দ্রনাথ রায়, ‘অর্চনা’র কেশবচন্দ্র গুপ্ত, ‘অনাথিনী’ পত্রিকার থাক্‌নি দেবী, ‘ভারতী’র সম্পাদকীয় দায়িত্বে দ্বিজেন্দ্রনাথ-স্বর্ণকুমারী-রবীন্দ্রনাথ-সরলাদেবী-হিরণ্ময়ী দেবী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘হিতবাদী’র কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, ‘সাধনা’য় প্রথমে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে রবীন্দ্রনাথ, ‘দাসী প্রদীপ-প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘সন্ধ্যা’র ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ‘ভারতবর্ষে’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও জলধর সেন, উপেন্দ্ৰকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘সবুজপত্রে’ প্রমথ চৌধুরী, ‘নারায়ণ’-এ চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, ‘বিচিত্রা’য় উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাস প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ।

১২৭৯ বঙ্গাব্দের (১৮৭২ খ্ৰীঃ) ১লা বৈশাখ বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার আদর্শে নানাবিধ মৌলিকভাব ও চিন্তাসহ প্রকাশিত হয় বেশ কিছু সাময়িক পত্রিকা। বলা বাহুল্য, কেবলমাত্র সাহিত্যসৃষ্টির সচেতন অভিপ্রায় এর প্রেরণা‌ ছিল না। কোনটির উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক-সমাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কিত, কোনটি ছিল‌ মঠ বা মিশনের মুখপত্ররূপে ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত, কোনটি বা ছিল সাহিত্যসৃষ্টি ও সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত। তবে সামগ্রিকভাবে দেশ ও সমাজের মঙ্গলচিন্তা থেকে কেউই তেমন বিরত ছিলেন না। আবার অনেক সময় দেখা গেছে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ বা কোন সাহিত্যরচনাকে উপলক্ষ করে বাদ-প্রতিবাদ মূলক চিন্তাভাবনা। দৃষ্টিভঙ্গীতে কোনটি প্রগতিশীল, কোনটি প্রাচীনপন্থী। রচনারীতির দিক থেকে অধিকাংশ পত্রিকারই অবলম্বন ছিল সাধু গদ্যরীতি। তবে ‘সবুজপত্রে’ দেখা গিয়েছিল চলিত গদ্যরীতি।

‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক অক্ষয়চন্দ্র সরকার ১২৮০-১২৯২ বঙ্গাব্দের মধ্যে সম্পাদনা করেছিলেন সাপ্তাহিক ‘সাধারণী’ এবং ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে মাসিক ‘নবজীবন’ পত্রিকা। ‘সাধারণী’ পত্রিকা সম্পাদনার মূলে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সম্পাদক নিজেই এ সম্পর্কে বলেছিলেন : “বঙ্কিমবাবুর বঙ্গদর্শনের গুণে বাঙ্গালী বাবু সক্ করিয়া বাঙ্গালা পড়িতে শিক্ষা করেন।” (‘বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৪)।

অক্ষয়চন্দ্রের রাজনীতি ও ধর্মীয় লেখাগুলি ছিল জাতীয়তাবোধ ও সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি আবেগে উচ্ছ্বসিত। এখানে ভাব-গম্ভীর এবং লঘু রসাত্মক উভয়বিধ প্রবন্ধই প্রকাশিত হয়। আবার ১৮৭৪-১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘আর্য্যদর্শন’, পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ বীরপূজার ব্রত নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সমকালের আটজন স্মরণীয় বাঙালীর সংক্ষিপ্ত জীবনকথা, ‘ঐতিহাসিক জীবনীবৃত্ত’ জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তাঁর রচনাসমূহ বিশেষভাবে স্বদেশকর্মীদের মনে প্রেরণা সঞ্চার করে। ১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা থেকে কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রকাশ করেছিলেন ‘বান্ধব’ পত্রিকা। বঙ্গদর্শনের সহযোগী এই পত্রিকাটি বুদ্ধি-নির্ভর সমাজনৈতিক রচনায় পরিপূর্ণ ছিল। কার্লাইল ও এমার্সনের গুণমুগ্ধ কালীপ্রসন্ন তাঁর রচনা ও সম্পাদনার গুণে ‘পূর্ব্ববঙ্গের বিদ্যাসাগর’ নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর ‘নারীজাতি বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘সমাজশোধনী’ প্রভৃতি রচনাগুলি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর গদ্যের আবেগাত্মক রচনারীতি অনেক তরুণ লেখককে উদ্দীপিত করেছিল।

ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কয়েকটি সাময়িক পত্র প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় হিন্দুধর্মের মহত্ত্ব-বিষয়ক ‘প্রচার’ (১৮৮৪) পত্রিকা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর ‘বঙ্গবাসী’ (১৮৮১), শশধর তর্কচূড়ামণির ‘বেদব্যাস’, শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মধর্মের মত ও আদর্শ সম্পর্কিত পত্রিকা ‘সমালোচক’, কেশবচন্দ্র সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার’ (১৮৭০), ‘নববিধান’ (১৮৮০), ‘বালকবন্ধু’ রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্র ‘‘উদ্বোধন’ প্রভৃতি। ‘প্রচার’ পত্রিকায় ৰঙ্কিম স্বয়ং ‘ধর্ম এবং সাহিত্য’ (১২৯২, পৌষ), ‘কাম’ (১২৯২, আষাঢ়) ইত্যাদি বেশ কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের অবতারণা করেন; যেমন “সমস্ত বৃত্তিগুলির উচিৎ অনুশীলন পরিণতিরই ধর্ম্ম। তাহা আপনার জন্যও করিবে না, পরের জন্যও করিবে না। ধৰ্ম্ম বলিয়াই করিবে” (“কাম’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ গ্রন্থর্ভুক্ত) এই পত্রিকায় তাঁর শেষ জীবনের দুটি অসমাপ্ত রচনা দেবতত্ত্ব-বিষয়ক ধারাবাহিক প্রবন্ধ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবতগীতা’র ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়।

‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকাকে অবলম্বন করে শশধর তর্কচূড়ামণি হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে তার স্বপক্ষে যুগ সমর্থন খুঁজেছিলেন। তাঁর প্রধান প্রচার-সহায় ছিল ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা। এই বঙ্গবাসী প্রেস থেকে তাঁর বিতর্কিত গ্রন্থ ‘ধর্মব্যাখ্যা’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘বেদব্যাস’ পত্রিকাও এই উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র তর্কচূড়ামণির সঙ্গে পরিচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে সমর্থন করতে পারেননি : “তর্কচূড়ামণি মহাশয় ব্রাহ্মণপণ্ডিত। তিনি এখনও বুঝিতে পারেন নাই যে নানা সূত্রে প্রাপ্ত নূতন শিক্ষার ফলে দেশ এখন উহা অপেক্ষা উচ্চ ধৰ্ম্ম চায়” (দ্রষ্টব্যঃ ‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’, পৃষ্ঠা ৯২)। শিবনাথ শাস্ত্রী এবং কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মধর্মের আদর্শ এবং সমাজভাবনাকে তুলে ধরেন স্ব-সম্পাদিত পত্রিকায়। প্রচারের জন্য ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকাটি স্বল্প মূল্যে, এমন কি কিছুদিনের জন্য বিনামূল্যে বিতরণ করা হত। উদ্বোধন’ পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মত ও পথের আলোচনা থাকলেও তা স্বামী বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য’, ‘ভাববার কথা’, ‘পরিব্রাজক’সহ সমাজ ও ধর্ম-সম্পর্কিত বিবিধ রচনা প্রকাশ করে পত্রিকার মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি করে। কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে এ পত্রিকা আজও দীপ্তিমান।

বিভিন্ন বিষয়-নির্ভর পত্রিকা :

১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দে) ‘ভারতী’ প্রথমে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পরে স্বর্ণকুমারী রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুরবাড়ির বংশধরদের মধ্যেই এই সম্পাদনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধসমূহ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এক তরুণ লেখক গোষ্ঠী। যেমন— সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, অসিতকুমার হালদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, চারুচন্দ্র রায়, কিরণধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা সকলেই ছিলেন রবীন্দ্র গোষ্ঠীভুক্ত। এঁরা ব্যতীত এই পত্রিকার আসর উজ্জ্বল করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। এছাড়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে ‘বালক’, ১৮৮৭-তে ‘সপ্তাহ’ এবং ১৯০৫-এ ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ এই তিনটি পত্রিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘হেঁয়ালি নাট্য’, দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘রেখাক্ষর বর্ণমালা’, ‘ভাণ্ডারে’ প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত স্বদেশী সঙ্গীতগুচ্ছ।

১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ পত্রিকা। সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে রবীন্দ্র বিরোধিতা এই পত্রিকায় বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির পর এর সম্পাদক হন পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। দু’টি পত্রিকা—কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য সম্পাদিত হিতবাদী’ এবং সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই পত্রিকার পাতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প রচনার সূত্রপাত। তবে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করলেও একসময় পরিচালক মণ্ডলী রবীন্দ্র-গল্প প্রকাশে অসম্মত হন (দ্রষ্টব্যঃ সুজিতকুমার সেনগুপ্ত, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১-২২)।

কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের পর কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব (১৮৯৪-১৯০৭ খ্রীঃ) নিয়ে পত্রিকাটির আর্থিক স্বাচ্ছল্য ও প্রচার বৃদ্ধি করেন। তিনি পত্রিকাটিকে রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রের রূপ দেন, ‘দৈনিক হিতবাদী’ বের করলেন। সেটিরও দারুণ কাটতি। আর সাপ্তাহিকটির প্রচার সংখ্যা তথা বিক্রি এতই বেড়ে গেল যে, কিছুদিনের মধ্যে অবস্থা দাঁড়ায়–বাংলা সাময়িক পত্র সংবাদপত্র মানেই শুধু ‘হিতবাদী’। কাব্যবিশারদ তারপরে হিন্দী ভাষায় এক সাপ্তাহিক বার করেন “হিতবার্তা” (‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯)।

‘হিতবাদী’র পর ‘সাধনা’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেন। এই পত্রিকায় চতুর্থ এবং শেষ বৎসর রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেন। ড. সুকুমার সেনের মতে, “বঙ্কিমোত্তর বাংলা সাহিত্যধারার গঙ্গাবতরণ রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’য়।…. রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ সাম্প্রতিক সাহিত্যের উদ্যোগপর্ব’” (“বাঙ্গালা সাহিত্যের ‘ইতিহাস’, চতুর্থ খণ্ড, ১৯৬৩, পৃ. ১১)। সুতরাং এই পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম।

১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে প্রকাশিত হয় গবেষণামূলক ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’। রবীন্দ্রনাথের ছড়া-সংগ্রহ, বাংলা লোকসাহিত্যের আলোচনা এবং ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে প্রবন্ধগুলি এখানে প্রকাশিত হয়। এই সময় বন্ধুজনের অনুরোধে সম্মত হয়ে রবীন্দ্রনাথ নবপর্যায় ‘বঙ্গদর্শনে’র সম্পাদনা ভার গ্রহণ করেন। এখানে তিনি “বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শকে উপযুক্তভাবে প্রতিফলিত” করতে চেয়েছিলেন। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং একাধিক নিবন্ধ রচনা। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে সেই সময়ের অগ্রগণ্য চিন্তাবিদ্রা এই পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ভাষায় “বঙ্গদর্শন নবজীবন লাভ করিয়াই যুগধর্মের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন” (বঙ্গদর্শন, ১৩০৮ ভাদ্র)। এই সময় প্রকাশিত হয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা প্রবাসী’ (১৯০১)। সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ‘প্রবাসী’র আগে ‘দাসী’, ‘প্রদীপ’ প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ‘প্রবাসী’র প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী বোঝা যায় রামানন্দের সম্পাদকীয় বক্তব্যে“চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রেই দেখিয়েছেন, অস্তিত্ব। নদীগর্ভে দাঁড়াইয়া উত্তরীয়ের প্রাচীর উত্তোলন করিয়া, কিংবা ব্যাকরণ অলঙ্কার শাস্ত্রের বাঁধ বাঁধিয়া এই বন্যা আটকাইতে যাওয়া সুবুদ্ধির কাজ কিনা, সহজেই বুঝা যায়। যতটা সম্ভব, বন্যার জলকে সুপথে সুক্ষেত্রে চালাইয়া কাজে লাগানো ভাল” (‘প্রবাসী’ ১৩২৩ আশ্বিন)।

এই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস এবং অধিকাংশ সুপরিচিত কবিতাসমূহ। এই পত্রিকায় চিত্রশিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত, সাহিত্য, রাজনীতি, নারীজীবন ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ, ফিচার, সংবাদ, এমন কি বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা রঙিন চিত্র পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়। এই প্রসঙ্গে দু-তিনটি রচনার নামোল্লেখ করা যায়; যেমন ‘বঙ্গের নবীন চিত্রকর সম্প্রদায়’, ‘ভারতের স্থাপত্য’, ‘আমেরিকার ভাস্কর্যে প্রাচ্যভাব’, ‘ওস্তাদ মৌলা বক্স’, ‘আবেস্তা প্রসঙ্গ’, ‘বার্ধক্য ও পরমায়’, ‘বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী’, ‘কৃত্রিম রক্ত’, ‘শতবর্ষ পূর্বে নারীদের আত্মহত্যা’, ‘আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের নাটক’ ইত্যাদি। আচার্য সুনীতিকুমারের স্মৃতিচারণায় “…কলেজে পড়িবার কালে এবং তাহার পরে বহু বৎসর ধরিয়া বাঙ্গালা ভাষায় শ্রেষ্ঠ চিন্তা ও ভাব যাহা পাওয়া যাইতে পারে তাহা আমরা ‘প্রবাসী’র মাধ্যমেই পাইতাম” (“রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতি’, ‘প্রবাসী’ রামানন্দ শতবর্ষ-স্মারক সংখ্যা)।

পরবর্তীকালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আদর্শে ওমনিবাস জাতীয় পত্রিকা আরও কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘যমুনা’ নামে সাহিত্য পত্রিকা। শরৎচন্দ্র ছিলেন এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। বস্তুত, এই ‘যমুনা’ পত্রিকা এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্পাদিত (তার মৃত্যুর পর অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ এবং জলধর সেনের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত) ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়; যেসব যমুনা তে বেরিয়েছিল ‘নিষ্কৃতি’ (প্রথমে নাম ছিল ‘ঘরভাঙা’, ১৩২১, বৈশাখ), ‘পরিণীতা’ (১৩২০, ফাল্গুন)। ‘ভারতবর্ষে’ ছাপা হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বিরাজ বৌ’ (১৩২০, পৌষ ও মাঘ সংখ্যা), ‘দেবদাস’, ‘দেনাপাওনা’, ‘দত্তা’ প্রভৃতি উপন্যাসসমূহ।

এই সময়ে আরও কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়; যেমন— ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দে অমরেন্দ্রনাথ রায়ের সহযোগিতায় ‘প্রবাহিণী’ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সম্পাদনায় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা। ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ এবং চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় ‘নারায়ণ’ পত্রিকা। প্রথমটিতে রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রগতিপন্থী তরুণ লেখকদল, দ্বিতীয়টি চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, সত্যেন্দ্ৰকৃষ্ণ গুপ্ত প্রমুখ লেখকেরা সমালোচনা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মধ্য দিয়ে রক্ষণশীল চিন্তাধারার পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্র বিদূষণ এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল না। বাংলা কবিতার যে ধারা চণ্ডীদাস থেকে কৃষ্ণকমল গোস্বামী এবং রামপ্রসাদ-কমলাকাস্ত‌ থেকে শিবচন্দ্র-কৃষ্ণানন্দ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে প্রচলিত ছিল, তার সঙ্গে আত্মবিস্মৃত বাঙালি‌ পাঠকের পরিচয় ঘটানোর চেষ্টাও ছিল। ‘নারায়ণ’ পত্রিকা লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যাদবেশ্বর তর্করত্ন, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, দীনেশচন্দ্র সেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ। ‘নারায়ণ’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে, আর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে এর প্রকাশ বন্ধ হয়।

‘সবুজপত্র’ প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। এই পত্রিকার ‘মুখপত্রে’ প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেনঃ “বাঙালীর মন যাতে আর বেশি ঘুমিয়ে না পড়ে তার চেষ্টা আমাদের আয়াধীন। মানুষকে ঝাকিয়ে দেবার ক্ষমতা অল্পবিস্তর সকলের হাতেই আছে।” এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সবুজের অভিযান’ কবিতা, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস এবং ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’ প্রভৃতি গল্প। আধুনিক ভাবনার মুখপত্ররূপে সজীব চলিত ভাষা, যুক্তিঋদ্ধ শৈথিল্যবিহীন রচনারীতি, মননপ্রবণতা এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যভাবনা প্রকাশ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী বাদে এই পত্রিকার অন্যান্য লেখকেরা ছিলেন প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, কিরণশঙ্কর রায়, বরদাচরণ গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বীরেশ্বর সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলের হালখাতা’সহ অধিকাংশ প্রবন্ধ এখানে প্রকাশিত হয়।

বঙ্গদর্শন-পরবর্তী সাময়িক পত্রিকা: বাদ-প্রতিবাদ :

বঙ্গদর্শন’-পরবর্তী সাময়িক পত্রগুলির মধ্যে কয়েকটি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিদ্বন্দ্বের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। বলা বাহুল্য, এই দ্বন্দ্বের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রভক্ত ও রবীন্দ্র সাহিত্যের সমালোচনা। অন্যপক্ষে বিরোধীদের সনাতনী ভাবনা, নীতিবাদী মনোভাব ও সংরক্ষণশীলতা। অবশ্য এই বাদ-প্রতিবাদের প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল ‘বঙ্গদর্শনে’র সমকালেই ১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হওয়ার ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ২রা বৈশাখ মনোমোহন বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গদর্শন’ বিরোধী মুখপত্র ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকা। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধের বিপরীতে প্রকাশিত হয় “বঙ্গদেশের কৃষক—বঙ্গদর্শনের উক্তি সম্বন্ধে উক্তি” প্রবন্ধ। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে বিতর্ক হয়েছিল ‘ভারতী’ সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও হয়েছিল ভারতীতে প্রকাশিত “একটি পুরাতন কথা” প্রবন্ধ রচনার কারণে। ‘প্রচারে’ বঙ্কিম তার উত্তর দিয়েছিলেন। এছাড়া চন্দ্রনাথ বসুর এবং অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘নবজীবনে’ “ভাই হাততালি” প্রবন্ধের মধ্যেও তার পরিচয় আছে। কিন্তু সেই বিরোধ বিদ্বেষ বা উগ্রতা তেমন ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে ‘হিতবাদী’ সম্পাদক কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ ‘মিঠে কড়া’, অমরেন্দ্রনাথ রায়ের ‘হেঁয়ালী’ বা ‘রবিয়ানা’ গ্রন্থে ব্যক্তি বিদ্বেষ প্রধান হয়ে উঠেছিল। তাই ভাবনা সংক্রামিত হয়েছিল অনতি-পরবর্তী কালের ‘সবুজপত্র’ ও ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় রবিভক্ত ও রবি বিদ্বেষীর দ্বন্দ্বমূলক বাদ-প্রতিবাদী রচনায়। যেমন— ‘স্ত্রীর পত্র’-র বিপরীতে বিপিনচন্দ্র পালের ‘মৃণালের পত্র’, ‘একটি মোকদ্দমার রায়, চলতি ভাষা ‘সাহিত্য’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি পত্রিকায় যেমন রবি বিরোধী লেখকেরা দেখা দিয়েছিলেন, তেমনি ‘ভারতী’র তরুণ লেখকেরা কবির প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন।

সমালোচকের মতে, “এই সনাতনীদের আক্রমণে যে সমগ্র প্রগতিপন্থী তরুণ লেখক সমাজ আহত হয়েছিলেন, তাঁদের আত্মরক্ষার উদ্‌যোগ দেখে তাকিয়ে যে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া কমে। পাল্টা আক্রমণ কিংবা প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাই তুলনায় কম, প্রবল প্রতিবাদে যাঁরা উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তারা হলেন ক্রমানুসারে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রিয়নাথ সেন, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি। আরো পরবর্তীকালে যখন রবীন্দ্রনাথ আর তরুণপক্ষীয় নন, তখন সেই পরবর্তী তরুণদের বিরুদ্ধে তার দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করেছিলেন তরুণবয়স্ক দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী”

তবে এই রবি-বিরোধী সমালোচনায় অনেক সময় সম্পাদকীয় সাহিত্য প্রতিভা’ প্রকাশ পেত। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন : “সাহিত্য পত্রিকার প্রায় সূচনা হইতে রবীন্দ্রনাথের রচনারই প্রতিকূল সমালোচনা সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির নিত্যকর্ম হইয়া উঠিয়াছে। এইসব সমালোচনার মধ্যে সম্পাদকের সাহিত্য-প্রতিভা প্রকাশ পাইত।” বিপরীতভাবে ‘সবুজপত্র’ ও ‘নারায়ণ’ পত্রিকার মধ্যে বক্তব্য ও আদর্শগত বিরোধের কি প্রয়োজন ছিল তা বোঝা যায় এই উক্তিতে : “নারায়ণ উঠে গেলে আন্দামান জেল থেকে সুভাষচন্দ্র বসু দাদা শরৎচন্দ্রকে লিখেছিলেন, সবুজপত্রের antidote হিসেবে ‘নারায়ণ’ থাকার দরকার ছিল” (দ্রষ্টব্য : নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ‘স্বভাবত ও স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯)।

বাস্তবিক, রবীন্দ্র সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতা ও স্বগত ভাবনার প্রতিক্রিয়ায় যেন বাস্তবতা ও স্বাভাবিকতার চর্চা দেখা গিয়েছিল ‘নারায়ণে’র লেখক সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তের নিম্নজীবনের পরিচয়বাহী উপন্যাস রচনায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের যৌন-বাস্তবতার অকপট উদ্ঘাটনে যা পরবর্তীকালে ‘কল্লোল’ পত্রিকার কথা সাহিত্যিকদের প্রেরণা যুগিয়েছিল। ‘নারায়ণে’ প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর প্রথম রচনা ‘‘যাত্রী’ (১৩২৮, ফাল্গুন)। সুতরাং সেইদিক থেকেও সাহিত্যের দ্বন্দ্বময় রূপ ও সত্য উদ্‌ঘাটনে সাময়িক পত্রে এই বাদ-প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়।

এই বাদ-প্রতিবাদের পাশাপাশি তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ নিয়ে দেখা দিয়েছিল শনিবারের চিঠি’, যার প্রকাশবর্ষ ১৯২৭ খ্রীঃ, সম্পাদক–সজনীকান্ত দাস। এর কিছুকাল আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালি-কলম’ (১৯২৬) এবং পরে ‘প্রগতি’ (১৯৩৭) পত্রিকা। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, মনীশ ঘটক প্রমুখ লেখকেরা ছিলেন এইসব পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন প্রবীণ মোহিতলাল মজুমদার এবং নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। এঁদের রচনায় দেহাতুরতা দেখে সজনীকান্ত দাস তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কল্লোলীয়দের মধ্যে “লালসার অসংযম ও দারিদ্র্যের আস্ফালনে।”

অন্যদিকে নব্যপক্ষীয়রাও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন ‘প্রবাসী-বিচিত্রা-কল্লোল বঙ্গবাণী’র পাতায়। কিন্তু শুধু বাদ-প্রতিবাদেই মুখরিত হয়নি পত্রিকা জগৎ, এর মধ্যেই বেরিয়েছিল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় সুস্থ সুশোভন ‘বিচিত্রা’ (১৯২৭), যেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণের মতো আধুনিকমনা সৃষ্টিশীল উপন্যাসিকেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পরবর্তী সাময়িক পত্রের পরিচয় তাই অগৌরবের কালিমায় নয়, স্বমহিমায় স্বাতন্ত্রাদী।