“নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বার, খুলিতে বিলম্ব কত আর”–সাময়িক পত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কালপুরুষের কণ্ঠ থেকে যেন এই প্রশ্ন অব্যক্তভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। স্বর্গের অমৃত সন্ধান নয়, মর্ত্যমৃত্তিকার অহংকারই স্পৰ্দ্ধিত স্বরে আধুনিক কালের সাহিত্যে উচ্চারিত হয়। এই যুগেই লেখা হয়েছে শিক্ষার্থীর বহু-বিষয়ক পাঠ্য ও সাধারণ জ্ঞান, দেখা গেছে গভীর চিন্তা ও সুতীক্ষ্ণ যুক্তি, সরস নক্সা এবং জিজ্ঞাসু বিতর্ক, প্রাত্যহিক সংবাদ, এমন কী পরবর্তীকালে রসসাহিত্য পরিবেশন পর্যন্ত। আর এইসব কিছুর মূলে বাংলা সাময়িক পত্র এক বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়েছে।

বাংলা সাময়িক পত্রের সূচনা দিগ্‌দর্শন থেকে। তবে ঐতিহাসিক তথ্য রূপে উল্লেখ করা যায় ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত জেমস্ অগাস্টাস্ হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ ভারতের মাটিতে প্রকাশিত প্রথম সাময়িক পত্রিকা। এর পরে ১৭৮০ থেকে ১৭৯৩-এর মধ্যে ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘হরকরা’ প্রভৃতি ইংরেজ সম্পাদকদের নেতৃত্ব ইংরেজী ভাষায় একাধিক পত্রিকার প্রকাশ ঘটেছিল। ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দে এপ্রিল মাসে শ্রীরামপুর মিশনারীদের উদ্যোগে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ প্রকাশিত হয়। খ্রীস্টধর্মের প্রচারক বলে এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্মের সমালোচনা। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু জ্ঞানের বিষয় সম্বলিত রচনা প্রকাশ পায়। যেমন ‘আমেরিকার দর্শন বিষয়’, ‘বাষ্পের দ্বারা নৌকা চালানোর বিষয়’, ‘উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরিয়া ইউরোপ হইতে ভারতে আসিবার কথা’ ইত্যাদি।

শ্রীরামপুর মিশনারীদের উদ্যোগে প্রকাশিত ১৮১৮-তে আর একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হল ‘সমাচারদর্পণ’। এই পত্রিকার সম্পাদক জে. সি. মার্শম্যান হলেও, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, তারিণীচরণ শিরোমণির মত দেশীয় পণ্ডিতেরাও এর রচনাকার্যে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয়ত, খ্রীস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য অতিক্রম করে এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ভৗগোলিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ পেত। এই পত্রিকাতেই প্রথম তথাকথিত শহুরে বাবু’র খণ্ডোপাখ্যানগুলি প্রকাশিত হয়।

প্রথম বাঙালী প্রবর্তিত বাংলা সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ (১৮১৮ খ্রীঃ সাপ্তাহিক)। সম্পাদক, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। এর কোন সংখ্যা পাওয়া যায় নি, তবে এখানে রামমোহন রায়ের ‘প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

১৮১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত মাসিক ‘গপেল ম্যাগাজিন’ খ্রীস্টীয় তত্ত্ববিষয়ে প্রথম পত্রিকা। ৮২২-এ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সমাচার চন্দ্রিকা’। সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮২৩-এ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ তিমিরনাশক’ এবং ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে মাসিক ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা’ এবং ১৮৩০-এ সাপ্তাহিক ‘শাস্ত্রপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়।

উপরোক্ত পত্রিকাগুলির মধ্যে রক্ষণশীলদের প্রধান মুখপত্র রূপে ‘সমাচার চন্দ্রিকার স্থান সর্বোচ্চ। পত্রিকা সম্পাদক ভবানীচরণ এক কালের মিত্র হয়েও পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন রামমোহনের চরমতম শত্রু। এই পত্রিকায় রামমোহন-বিরোধিতা বাদে মিশনারী ও ইংরাজী শিক্ষার বিরুদ্ধেও তীব্র সমালোচনা করা হয় “অতএব বলি ইঙ্গরাজী পোষাক পরাইয়া, বালকদিগের অভ্যাসকরণের ফল কি দোষ ভিন্ন কিছুই দেখিতে পাই না যদি তাহারদিগের মতে কিছু গুণ থাকে তাহা লিখিয়া আমার থোথা মুখ ভোঁতা করিয়া দিবেন”। ভাষা এখানে মৌখিক প্রবচন প্রয়োগে সহজ সরল হয়ে উঠেছে। এই পত্রিকায় ‘বাবু উপাখ্যান’, ‘শৌকীন বাবু’, ‘বৃদ্ধের বিবাহ’, ‘বৈষ্ণব’ ও ‘বৈদ্য-সম্বাদ’ প্রভৃতি ব্যঙ্গ রচনা এবং ভবানীচরণের ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নববাবুবিলাস’ (প্রমথনাথ শৰ্মণ ছদ্মনামে), ‘নববিবিবিলাস’ (ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামে) ইত্যাদি রচনা প্রকাশিত হয়। সমকালীন কলকাতার চিত্ররূপে এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই পত্রিকায় সারাদেশে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের জন্য প্রথম থেকে দাবি করা হয়।

এই সময়ে, ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে নীলরত্ন হালদারের ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকা এবং ডব্লু. এইচ পিয়ার্স ও পাদ্রী ল’সন সম্পাদিত ‘পশ্বাবলী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রথমটিতে ধর্ম ও সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা, দ্বিতীয়টিতে বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় আলোচনা প্রকাশ পায়।

খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীদের সমালোচনার প্রত্যুত্তরে রামমোহন ১৮২১ সালে প্রকাশ করেছিলেন দ্বিভাষিক পত্রিকা ব্রাহ্মণসেবধি’ বা ‘Brahmunical Magazine: The Missionary and the Brahman’। ‘ব্রাহ্মণসেবধি’র মধ্যে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে মিশনারীদের অসঙ্গত আক্রমণের জবাব দেওয়া হয়েছিল। ১৮২৩ খ্রীস্টাব্দে প্রেস অর্ডিন্যান্স বা প্রেস শাসন জারি করা হয়। ফলে রামমোহন রায় তাঁর ‘মীরাৎ-উল-আখবার’ ফার্সী পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এই পত্রিকার শেষ সংখ্যায় প্রকাশিত রামমোহনের মন্তব্য পরবর্তী কালের ‘ভারত ইতিহাসে’র ‘অ্যারিওপ্যাজিটীকা’ বলে স্বীকৃত হয়েছে।

১৮৩১ খ্রীস্টাব্দ যুগের ইতিহাসে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। কারণ এই সময়ে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের প্রচেষ্টায় বাংলা সংবাদপত্র উন্নতির শিখরদেশ স্পর্শ করে। ঈশ্বর গুপ্তের অবদান নানাদিক থেকে স্বীকার্য– (ক) সিপাহী বিদ্রোহ: নারীশিক্ষা ইত্যাদি সমকালীন বিষয়ের উপর রচনাপ্রকাশ, (খ) প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কবিদের জীবনচরিত প্রকাশ, (গ) একদল নব্য লেখক গোষ্ঠী গঠন করা—এঁদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ অধিকারী, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, মনমোহন বসু, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ।

বস্তুত, আধুনিক ভারতবর্ষে সাহিত্য গোষ্ঠী বলতে যা বোঝায়, সম্ভবতঃ ঈশ্বর গুপ্তই তাঁর প্রথম পথনির্দেশক। এই পত্রিকার স্বদেশপ্রেম প্রচার সম্পাদকের এক অবিস্মরণীয় কীর্তিরূপে নন্দিত। এর সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলি আশ্চর্য সরল এবং সাংবাদিক সুলভ মিতভাষী।

১৮৩২ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলির মধ্যে স্মরণ করা যায় ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ রত্নাবলী’, ‘উইলসন সাহেবের ‘বিজ্ঞান সেবধি’, ‘বিজ্ঞান সারসংগ্রহ’। এছাড়া বিভিন্ন সম্পাদকের আশ্রয়ে প্রকাশিত ‘সম্বাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ (উদয়চঁাদ আঢ্য), ‘সম্বাদ ভাস্কর’ (শ্রীনাথ রায়), ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ প্রভৃতি পত্রিকা।

১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে ২৬শে আগস্ট প্রকাশিত হয় মনীষী অক্ষয়কুমার দত্তের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্ররূপেও পত্রিকাটি প্রকাশিত হলেও জ্যোতিষ, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, অ্যাম্বারক্রনে ও রীড অবলম্বনে মনোবিজ্ঞানের আলোচনায় এই পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। লেখকেরাও ছিলেন স্বনামধন্য—বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, দেবেন্দ্রনাথ, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ।

অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’, বিদ্যাসাগরের মহাভারত ও উপক্রমণিকার অনুবাদ, দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মের ব্যাখ্যা, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রচনা এর সম্পদ। সারস্বতযোগী অক্ষয়কুমার ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫ পর্যন্ত একাধিক ক্রমে বারো বছর সম্পাদক থেকে এই পত্রিকাকে শিক্ষিত বাঙালীর জ্ঞানচর্চার অন্যতম মুখপত্রে পরিণত করেন।

১৮৫১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (মাসিকপত্র) ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’। পুরাবৃত্ত, প্রাণিবিদ্যা, শিল্প সাহিত্য বিষয়ক রচনা প্রকাশে এই পত্রিকাটির অবদানও অসামান্য। যেমন— ‘কলম্বাসের জীবনচরিত’, ‘রাজা চন্দ্রগুপ্তের বিবরণ’, ‘ভরতপুরের ইতিহাস’, ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ নাটকের সমালোচনা, ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থের সারসংগ্রহ, ‘শ্যামাচরণ শর্মার বাংলা ব্যাকরণ’ ইত্যাদি।

এই সময়কালে অর্থাৎ ১৮৫০ থেকে ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকার মধ্যে সর্বশুভকরী, সোমপ্রকাশ (দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত), মাসিক পত্রিকা (প্যারীচাদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত), বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা (কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্পাদিত ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মাসিক পত্রিকার মধ্যে প্রথম স্ত্রীলোক ও সাধারণের জন্য সাহিত্যরস পরিবেশন করা হয়েছিল। এই পত্রিকার প্রথম বর্ষের সপ্তম সংখ্যা থেকে প্রকাশিত হয় টেকচঁাদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এই পত্রিকার অন্যতম সম্পদ সরল ও সর্বজনবোধ্য ভাষা। কথ্য গদ্যরীতির প্রবর্তনে এর ভূমিকা অবশ্যস্বীকার্য।

১৮৭২ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা। শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, এই পত্রিকার মাধ্যমে সমকালীন চিন্তার সঙ্গে সমকালীন সাধারণ জনের সংযোগ-সাধনের ইচ্ছা। —”I have myself projected a Bengali magazine with the object of making it the medium of communica tion and sympathy between the educated and uneducated classess”। এই পত্রিকার প্রধান লেখক ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং।

তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭২) উপন্যাস সেই সময় ‘বঙ্গদেশের ঘরে ঘরে’ দেশশুদ্ধ লোককে কিভাবে আলোড়িত করেছিল তার অনুপম বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন। উপন্যাসসহ বঙ্কিমের যাবতীয় প্রবন্ধ রচনার প্রায় অনেকটাই এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, পুস্তক সমালোচনা, ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়। বঙ্কিমচন্দ্র বাদে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ বহু খ্যাতিমান বিদ্বজ্জন এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলা সাময়িক পত্র প্রকাশনার ‘স্বর্ণযুগ’ সৃষ্টি করেছিল। এই পত্রিকার বিষয়-মহিমা অনুভব করলে মনীষী শ্রীঅরবিন্দের মত যে কোন শিক্ষিত মানুষের কথা মনে হতে পারে: “it comes of the varied mental experience of our forefathers, of the nation’s three thousand years of intellectual life.”

সাময়িক পত্র ও বাংলা গদ্য:

ইংলন্ডে সংবাদপত্র সেবীদের গদ্যাদর্শ সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে ভাববার প্রয়োজন হয়নি। প্রথম ইংরাজী দৈনিক ‘ডেইলি কুরান্ট’ প্রকাশের (১১ মার্চ ১৭০২ খ্রীঃ) আগে গদ্যরীতি ছিল পূর্বনির্ণিত এবং প্রায় একশ বছরের চর্চায় সমৃদ্ধ। টমাস মূরের ক্ল্যাসিক্যাল গদ্যরীতিতে লেখা Life of pico of Mirandda (১৫১০), ওয়লিফ টিন্ডেলের বাইবেলের অনুবাদ (১৪৮৪-১৫৮৫) বেরিয়ে গেছে, দেখা দিয়েছেন এলিজাবেথীয় যুগের স্যার ফ্রান্সিস বেকন ও রবার্ট বাটনের মতো মনস্বী ও শক্তিশালী লেখকেরা। সেক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগ্‌দর্শন’ (১৮১৮ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাস) প্রকাশের আগে পর্যন্ত বাংলা গদ্যের অবস্থা তখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে।

১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দের আগে পর্যন্ত বাংলা গদ্যের প্রত্নস্মৃতি যেটুকু পাওয়া যায়, তা মুখের ভাষায় এবং আরবী ও ফারসি শব্দে বদ্ধ দলিল-দস্তাবেজ ও চিঠির ভাষায় সীমাবদ্ধ। ষোড়শ শতকে প্রকাশিত ‘সেখশুভোদয়া’, সপ্তদশ শতকে ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’, অষ্টাদশ শতকে ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ থেকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত মুনশীদের প্রকাশিত গ্রন্থপুস্তকের মাধ্যমে বিশেষত রামরাম বসুর ১৮০১ সালে লেখা ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’ রূপায়িত বাংলা গদ্যের গঠন ও বিকাশ তখনো প্রায় অস্বচ্ছ।

ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মুসলমান আধিপত্যের ফলে আড়াই হাজার পারসি তথা তুর্কী শব্দের শাসন বাংলাভাষায় শুরু হয়ে যায়। আবার হ্যালহেড, ফর্স্টার, কেরী প্রমুখের চেষ্টায় ইসলামী প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা হয়ে পড়ে সংস্কৃত-আদর্শের শরণার্থী। তবু বাংলা সংবাদপত্রের মাধ্যমেই আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য থেকে এবং সংস্কৃত বাক্যগঠনের বন্ধন থেকে যথাসম্ভব মুক্ত হয়ে বাংলা গদ্য তার নিজস্ব স্বভাব-গড়নে ক্রমসচেতন হয়ে ওঠে। এর একটি কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজগত ও মননগত আন্দোলনের এমন কিছুই ছিল না যা সংবাদপত্র দ্বারা সৃষ্ট হয়নি। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রে যেহেতু বিষয়-বৈচিত্র্য থাকেই, তাই প্রবন্ধ বা প্রতিবেদন রচনার জন্য উপযুক্ত শব্দসম্ভার এবং পরিভাষা সে যুগের সাংবাদিকদের তৈরি করে নিতে হয়েছিল। স্বভাবতই বাংলা ভাষা হয়ে উঠেছিল স্বক্ষেত্রে সমৃদ্ধ।

অনুবাদের গদ্য:

সংবাদপত্রের বাইরে বাংলা অনুবাদের যে গ্রন্থ-নির্ভর আদর্শ সেযুগে দেখা যায় (যেমন গসপেল অফ সেন্ট ম্যাথুর অনুসরণে মতীয়ের ‘মঙ্গল সমাচার’ (১৮০০)-এ, বা ‘হিতোপদেশের’ ভাষায়) সেখানে গদ্য ছিল অবোধ্য এবং ভাষাও ছিল শব্দসজ্জায় সালঙ্করা। কিন্তু সেই প্রাথমিক পর্যায়ে সংবাদপত্রের মধ্যে প্রকাশিত খবরের অনুবাদ হয়ে উঠেছিল রীতিমত প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। ‘দিগ্‌দর্শনের’ একটি ইংরেজী সংবাদের বাংলা ভাষান্তর “নগরের মধ্যে নদীর উপরে অতিসুন্দর এক সেতু ছিল। ঐ সেতু অত্যাশ্চর্যরূপে গ্রথিত যেহেতুক নদীর নীচে বালি ছিল, তাহার খিলান শক্ত প্রস্তরেতে গ্রথিত এবং লৌহ ও সীমাদ্বারা পরস্পর বাদ সেতু গাঁথিবার পূর্ব্বে ঐ নদীকে অন্য পথে লইয়া পরে সেতু গাঁথিয়াছিল” (সেপ্টেম্বর ১৮১৮)। অথচ এরই পাশাপাশি একই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রকাশিত বাইবেল অনুবাদের নমুনা— “পরামনন কর কেননা স্বর্গরাজ্য নিকটবর্তী একথা ঘোষণা করত যোহন তুরক সে কালে য়িহুদাদ দেশের অরণ্যে আইল…” ইত্যাদি। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটির মধ্যে বাক্যগঠনে পরিচ্ছন্নতার অভাব সহজেই স্পষ্টগোচর।

মৌলিক গদ্যরচনা: শুধু খবরের তর্জমায় নয়, মৌলিক গদ্য তৈরির ক্ষেত্রেও সংবাদ পরিবেশনের কৃতিত্ব সুচিহ্নিত। ধারাবাহিক পর্যালোচনায় দেখা যায় এর পরিণতি এবং ভাষায় সাবলীল গতি।

দিগ্‌দর্শন: “ঈশ্বরের অজ্ঞাতনুসারে পৃথিবীর সৃষ্টি হইল। ঈশ্বর ছয় দিনে এই বিশ্ব সৃষ্টি করিয়া সপ্তম দিবসে আপন কৰ্ম্ম হইতে বিশ্রাম করিলেন যেহেতুক তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল” (জুন, ১৮১৮)।

সমাচার দর্পণ: “কিন্তু রহস্য ছাড়িয়া যথার্থ করিতে হইলে ডেকসিয়ানরি প্রস্তুত করার জন্য পরিশ্রম পৃথিবীর মধ্যে আর কোন কৰ্ম্মে নাই। ডেকসিয়ানরি কর্তারা বিদ্যার মজুর, তাঁহারা মাল মশলা প্রস্তুত করিয়া দেন অন্যেরা ঘর গাঁথে” (১৮ জুন, ১৮২৫)।

‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকায় প্রতিবেদন ও প্রবন্ধের যে শিরোনাম দেখা যায় তার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রাগাধুনিক রূপটি ধরা পড়ে; যেমন—‘মরণ’, ‘গৃহদাহ’, ‘আত্মঘাতী’, ‘রাজকৰ্ম্মে নিয়োগ’, ‘অগ্নিদাহ’ প্রভৃতি। সাধারণভাবে সমাচার দর্পণে’র ভাষা ছিল সংস্কৃত ও ফার্সীর প্রভাবমুক্ত এবং চলিত ভাষায় রচিত। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা সম্পাদক ভবানীচরণ ছিলেন মোটামুটিভাবে সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা গদ্যরীতির সমর্থক এবং যাবনিক শব্দের বদলে বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারে আগ্রহী। তিনি তাঁর ‘কলিকাতা কমলালয়’ গ্রন্থে ৮২টি যাবনিক শব্দ ও তার একাধিক দেশী প্রতিবেশীদের তালিকা দেন। যেসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হয় না সেগুলিকে হুবহু বাংলা ভাষায় গ্রহণ করা উচিত বলে তার অভিমত জানান। এধরনের গ্রহণযোগ্য বিদেশী শব্দসংখ্যা ছিল ১৩০টি। তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য : ছাপা, ছাড়, ছানি, ছুটি, জমিদার, ফাদ, বেচারা, বেগার ইত্যাদি।

“সমাচারদর্পণ” পত্রিকাতেও আরবী ফাসী শব্দ ব্যবহার ছিল, যদিও ব্যাপকভাবে নয়। যেমন “ও বড়লোক কহা যায় না বরং ছোটলোক বিলক্ষণ সাবুদ হয়” (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮২১) কিম্বা, “ঐ বালকের জননী জবনী হুজুরে নালিশ করাতে তজবীজের দ্বারা তাহা সপ্রমাণ হইল” (২৫ জুলাই ১৮২৯)।