ল্যাটিন শব্দ ‘ফিওডালিস’ (Feodalis) এবং ফরাসি শব্দ ফোডালিতে (Feodalite) থেকে ইংরেজি ‘Feudalism কথাটি এসেছে যার বাংলা অর্থ হল ‘সামন্ততন্ত্র’। সামন্ত্রতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন অভিমত লক্ষ করা যায়।
[1] বােলাডিয়ের-এর মত: প্রথম ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ফোডালিতে’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। তবে শব্দটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন বােলভিয়ের (Boulainvilliers)। তিনি সামন্ততন্ত্র বলতে বুঝেছিলেন “সার্বভৌম অধিকারের বিভাজন, যেখানে প্রশাসনকে খতি ও বিকেন্দ্রীভূত করে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।”
[2] মন্তেস্কুর মত: মন্তেস্কু মনে করেন যে, “ওপর থেকে নীচের দিকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকা সরকারি অধিকার ও ক্ষমতার বিভাজিত কাঠামােই ছিল সামন্ততন্ত্র।”
[3] কার্ল মার্কসের মত: কার্ল মার্কসের মতে, “স্বাধীনতাহীন শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে কৃষি ও হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করার ব্যবস্থাই হল সামন্তব্যবস্থা।
[4] সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা: মােটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে ত্রয়ােদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে জমির বিশেষ ধরনের মালিকানার ওপর ভিত্তি করে একপ্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাকে সামন্ততন্ত্র বা ‘Feudalism’ বলে।
কোনাে কোনাে পণ্ডিত মনে করেন যে, প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। তবে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের উত্থান শুরু হয় খ্রিস্টীয় নবম শতকের মধ্যভাগ থেকেই।
[1] সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পটভূমি: ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে শার্লামেনের মৃত্যুর পর ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের এই দুর্বলতার সুযােগে স্থানীয় প্রভুরা অর্থাৎ বৃহৎ জমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের জমি ও জনগণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এভাবে সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পটভূমি তৈরি হয়।
[2] সামন্ততন্ত্রের বিকাশ: ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হলে বিভিন্ন প্রান্তের ও বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভুরা শীঘ্রই নিজেদের অধীনস্থ তালুকদারকে জমির বন্দোবস্ত দিতে থাকেন। এভাবে একটি ক্রমােচ্চ প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক তৈরি হয়। সর্বনিম্ন জোতদাররা সরাসরি কৃষকের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করত। এভাবে নবম শতকে ইউরোপে সামন্ততন্ত্র বিকাশ লাভ করে।
[3] সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ: খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত সময়ে ইউরােপে সামন্ততন্ত্র প্রসারের প্রক্রিয়া চললেও এর পরিপূর্ণ বিকাশের যুগ ছিল খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক।
[4] সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা: ছােটো ভূস্বামীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য তাদের উর্ধ্বতন বড়াে ভূস্বামীদের আশ্রয় গ্রহণ করে। বড়াে ভূস্বামীরা তাদের অধীনস্থ ছােটো ভূস্বামীদের সুরক্ষা দেয়। এভাবে একদিকে বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভুর মধ্যে এবং অন্যদিকে কৃষক ও সামন্তপ্রভুর মধ্যে সুরক্ষার বিনিময়ে সেবা ও আনুগত্যের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।
উপসংহার: পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশলাভের পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে এই প্রথাই হয়ে ওঠে ইউরােপের সমাজ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের সর্বোচ্চ শাসক অর্থাৎ রাজা থেকে শুরু করে ক্রমনিম্ন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে তা গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
Leave a comment