ইংরেজি ‘ফিউডালিজম’ (Feudalism) কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হল সামন্ততন্ত্র বা সামন্তপ্রথা। ‘ফিউডালিজম’ কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘ফিওডালিস (Feodalis) এবং ফরাসি শব্দ ফেডালিতে’ (Feodalite) থেকে। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায় তা বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন一
[1] সাধারণ অর্থ: সাধারণভাবে সামন্ততন্ত্র বলতে এক বিশেষ ধরনের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে বােঝায় যেখানে কেন্দ্রীর শক্তির অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ ঘটে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পরিবর্তে স্থানীয় ভূস্বামীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, ভূমি মালিকানা ও ভূমি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক বিশেষ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাই হল সামন্ততন্ত্র।
[2] বােলাডিয়ের-এর অভিমত: বােলাভিয়ের (Boulain-villiers)-এর মতে, “সামন্ততন্ত্র হল সার্বভৌম অধিকারের বিভাজন যেখানে প্রশাসনকে খণ্ডিত ও বিকেন্দ্রীভূত করে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
[3] কার্ল মার্কসের অভিমত: কার্ল মার্কসের মতে, “স্বাধীনতাহীন শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে কৃষি ও হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করার ব্যবস্থাই হল সামন্তব্যবস্থা।
[4] পি ডি মায়ার্স-এর অভিমত: পি ভি মায়ার্স-এর মতে, সামন্ততন্ত্র হল এক বিশেষ সমাজ ও সরকার-পরিচালনা ব্যবস্থা যা বিশেষভাবে অনুশীলিত এক ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেটি মধ্যযুগের শেষ পর্বে ইউরােপে বিকাশ লাভ করেছিল এবং যা একাদশ, দ্বাদশ, ও ত্রয়ােদশ শতকে ইউরােপে বিরাজ করছিল।
[5] এ কে নাজমুল করিম এর অভিমত: অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিম সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, “সামন্তপ্রথা বলতে এমন একটি সমাজ ও সংস্কৃতিকে বােঝায় যেখানে ভূমিই হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরােপে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামাে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইউরোপের কাঠামাের মতাে না হলেও প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন। ভারতে সামন্তপ্রথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন一
[1] স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবন: সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম্যজীবন। অর্থাৎ গ্রামে বসবাসকারী সকলের প্রয়ােজনীয় সামগ্রী গ্রামেই উৎপাদিত হত। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগে এদেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবনের অস্তিত্ব ছিল।
[2] নগরায়ণের অভাব: কৃষি উৎপাদনের জন্য গ্রাম, কৃষক, খামারবাড়ি প্রভৃতি অপরিহার্য। নগরের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার সামন্ততন্ত্রের বিরােধী। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগেও গ্রামগুলির বিকাশ ঘটে এবং নগরায়ণের বিকাশ ব্যাহত হয়।
[3] কৃধিভিত্তিক সমাজ: ভারতীয় সামন্তপ্রথায় সমাজ ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। সমাজের নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে দেশের গােটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হত। দেশে শিল্প ও বাণিজ্য ছিল গৌণ। শিল্প ও বাণিজ্য যেটুকু ছিল তা মূলত কৃষিপ্রসূত।
[4] ভূমি ও মানুষের সম্পর্ক: ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উপকরণ ছিল ভূমি। ভূমিকে কেন্দ্র করেই সমগ্র কৃষিকাজ চলত। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
[5] জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব: জমিতে কৃষক উৎপাদকের কাজে নিযুক্ত থাকলেও সেই জমিতে কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। জমির প্রকৃত মালিক ছিল ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভু এবং চূড়ান্ত মালিক ছিল রাষ্ট্র।
[6] সেচ ব্যবস্থায় রাস্ত্রীয় নিয়ন্ত্রণ: কৃষিকাজের জন্য কৃষকের জমিতে জলসেচের প্রয়ােজন ছিল। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে এই সেচ ব্যবস্থায় কৃষকের ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না। তা রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।
[7] প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব: ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে কৃষিজমির মালিকানা ছিল সামন্তপ্রভুর হাতে। তাই উৎপাদন ব্যবস্থা তথা সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামােতে স্বাভাবিকভাবেই প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
Leave a comment