আধুনিক-পূর্ব যুগে চিঠিপত্রে এবং দলিল দস্তাবেজে বাংলা গদ্যের নিদর্শন পাওয়া গেলেও তাকে কোনক্রমেই সাহিত্যিক গদ্য বলা চলে না। আর সে-যুগের যাবতীয় সাহিত্যই তাে পদ্যে রচিত। বাংলা গদ্য একান্তভাবেই একালের সামগ্রী। ১৮০০ খ্রীঃ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হবার পর কেরী সাহেবের প্রবর্তনায় কলেজের পণ্ডিতদের দ্বারা বাঙলা গদ্য সাহিত্যের সৃষ্টি, যদিও গদ্য-রীতির বিষয়ে আমরা একটা ধারণা পেয়েছি মধ্যযুগের পদ্য সাহিত্যেই। সাধু ভাষার গদ্য রীতির সঙ্গে মধ্যযুগের পদ্য সাহিত্যের ভাষার পার্থক্য ছিল শুধু পদবিন্যাসেই।
কাব্যে ব্যবহৃত মধ্যযুগের বাঙলা থেকেই আধুনিক সাধু ভাষার ক্রমিক উত্তরণ ঘটেছে। এই মধ্য বাঙলা-আশ্রিত সাধু আদর্শের উপর প্রধানতঃ রাঢ়ী উপভাষার এবং অংশতঃ বঙ্গালী ও বরেন্দ্রী উপভাষার প্রভাবেই কালক্রমে বাঙলা সাধু রীতির উদ্ভব ঘটে। এই উদ্ভব যুগে সংস্কৃত ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিতগণই কার্যতঃ গদ্য সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন বলে সাধু ভাষায় সংস্কৃত-সুলভ সমাসবাহুল্য, জটিল বাক্য এবং তৎসম শব্দবাহুল্য দেখা দিয়েছিল। অবশ্য চরমপন্থী গদ্যের পাশাপাশি সাধুভাষার একটা আদর্শও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ভাষা-শিল্পী বিদ্যাসাগরের রচনায় এই সাধু ভাষা যে বিশেষ প্রাঞ্জলতা ও শিল্পসম্মত রূপ লাভ করে, এটিকেই বাঙলা সাধু ভাষার আদর্শ রূপ বলে গ্রহণ করা হয়। আবার এই সাধু ভাষার পাশাপাশি একেবারেই কথ্যভাষায় তার অশিষ্টতাসহ রচিত হলাে আরাে একটি গদ্যভাষার সাহিত্য— যে ভাষাকে ‘আলালী ভাষা’ ‘হতােমী ভাষা’ বলা হয়। এই ভাষার ছিল গতিময়তা বা প্রাণ, কিন্তু সমাজে এই ভাষা মান পেলাে না বলে এই কথ্যরীতির অনুসরণ ঘটেনি। মাইকেল মধুসুদন এই ভাষাকে মেছুনীদের ভাষা’ বলে নিন্দা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরী ভাষা এবং আলালী ভাষার মধ্যপথ অবলম্বন করে যে গদ্যভাষার প্রবর্তন করেন, বস্তুতঃ ঐ রীতিটিই এক পর্যন্ত আদর্শ সাধু ভাষারূপে পরিগণিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র-প্রবর্তিত এই সাধু ভাষাই সুদীর্ঘকাল বাঙলা গদ্য সাহিত্যের মূল বাহনবূপে প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাথও তার অধিকাংশ রচনা এই সাধু ভাষাতে লিখলেও পরে তার মনােভাবের পরিবর্তন ঘটেছিল। তিনি লিখেছেনঃ “বাঙলা বাক্যাধিপেরও আছে দুই রাণী—একটাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা, আর একটাকে কথ্যভাষা; কেউ বলে চলতি ভাষা; আমার কোন কোন লেখায় আমি বলেছি প্রাকৃত বাঙলা। সাধুভাষা মাজা ঘষা, সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার করা অলঙ্কারে সাজিয়ে তােলা। চলতি ভাষার আটপৌরে সাজে নিজের চরকায় কাটা সুতাে দিয়ে বােনা।” সাধু ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রবণতা থেকে সৃষ্টি হলাে ‘চলিত ভাষা’। এই ‘চলিত ভাষা’র কথাটা একটু স্পষ্ট করে বােঝানাে আবশ্যক। আমরা সদাসর্বদা কথা বলার যে কথ্যভাষা ব্যবহার করি, তার সঙ্গে চলিত ভাষার পার্থক্য রয়েছে। কথ্যভাষা সব সময় পরিবর্তনশীল, অঞ্চল ভেদে তার পার্থক্য রয়েছে। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত কথ্যভাষারই একটা মার্জিত সাহিত্যিক রূপ, এটি শিষ্টজনসম্মত ‘স্বীকৃত কথ্যভাষা’ বা ‘প্রমিত ভাষা’ (Standard Colloquial Language)। মুখের ভাষা তথা খাঁটি কথ্যভাষায় কখনাে সাহিত্য রচিত হয় না। এমন কি নাটকাদিতে কিংবা কথােপকথনের সূত্রে তার সীমাবদ্ধ প্রয়ােগ থাকলেও তাকে কখনাে লেখকের মনােভাব প্রকাশের বাহন-রূপে গ্রহণ করা চলে না। অতএব বাঙলা ভাষায় সাহিত্য-সৃষ্টিতে দুটি ভাষারীতি প্রচলিত আছে—একটি সাধু ভাষার রীতি, অপরটি চলিত ভাষা তথা ‘স্বীকৃত কথ্যভাষার’ রীতি। মৌখিক কথ্যভাষার সঙ্গে সাধু ভাষার যথেষ্ট ব্যবধান থাকলেও চলিত ভাষার সঙ্গে তার সাদৃশ্যই প্রকট হয়ে থাকে।
সাধু ভাষার সঙ্গে চলিত ভাষার পার্থক্য প্রধানতঃ শব্দগত; বাক্যের গঠন কিংবা পদবিন্যাসের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। নিম্নে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ: থেকে সাধুভাষা ও চলিত ভাষার দুটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হলাে।
“সাধু ভাষা—এক ব্যক্তির দুইটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র পিতাকে বলিল (বা কহিল), পিতঃ, আপনার সম্পত্তির মধ্যে আমার প্রাপ্য অংশ আমাকে দিউন (বা দিন)। তাহাতে তাহাদিগের (বা তাহাদের) পিতা নিজ সম্পত্তি তাহাদিগের মধ্যে বিভাগ করিয়া দিলেন।”
“চলিত ভাষা—একজন লােকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছােটোটি বাপকে বললে, ‘বাবা, আপনার বিষয়ের মধ্যে যে অংশ আমি পাবাে, তা আমাকে দিন।’ তাতে তাদের বাপ নিজের বিষয়-আশয় তাদের মধ্যে ভাগ-করে (বেঁটে) দিলেন।”
উপরে সাধু ভাষা এবং চলিত ভাষার যে দুটি নিদর্শন উদ্ধৃত হলাে, তুলনামূলক আলােচনায় তাদের পার্থক্যটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। দেখা যাচ্ছে সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের আধিক্য, চলিত ভাষায় তৎ-পরিবর্তে তদ্ভব ও দেশি শব্দের ব্যবহার বেশি; সাধুভাষায় ক্রিয়ার রূপ পূর্ণরূপে প্রকাশিত, চলিত ভাষায় তার আকার সংক্ষিপ্ত; এবং সাধু ভাষায় সর্বনামেরও পূর্ণরূপ রয়েছে, পক্ষান্তরে চলিত ভাষার সর্বনামও সংক্ষিপ্ততা লাভ করেছে। বস্তুতঃ সাধু ভাষা এবং চলিত ভাষার প্রধান পার্থক্য এই তিনটে ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে মৌখিক কথ্যভাষার রূপ জেলা ভেদে পৃথক তাে বটেই এমন কি এক জেলাতেও ভাষার একাধিক রূপ প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে পারস্পরিক বাচনভঙ্গির পার্থক্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
মূলতঃ বাঙলা গদ্যভাষা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণই অগ্রণী হয়েছিলেন বলে তাঁরা প্রধানতঃ সংস্কৃতকে আদর্শ ধরেই সাধুভাষা রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই তাঁরা অত্যধিক সংস্কৃত তৎসম ও আভিধানিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, কথ্যভাষা ও উপভাষার শব্দ বর্জন করেছেন এবং সর্বনাম ও ক্রিয়া পদের পূর্ণ রূপটিকেই গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে চলিত ভাষার সমর্থকগণ সাহিত্যের ভাষাকে মৌখিক ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসবার জন্য তৎসম শব্দ ব্যবহারে কিছুটা দাসীন্য প্রকাশ করেছেন এবং ভাব-প্রকাশের উপযােগী তদ্ভব, অর্ধতৎসম, দেশি ও বিদেশি শব্দ যথেচ্ছ ব্যবহার করে থাকেন। ভাষার ক্রমিক বিবর্তনে মধ্যযুগের অপিনিহিতি একালেও শিষ্ট ভাষায় সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়েছে এবং অভিশ্রুতি ও স্বরসঙ্গতি ভাষায় পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে, ফলতঃ চলিত ভাষায়ও এদের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। তাই সাধু ভাষায় ‘হাঁটিয়া, হাটুয়া, আজি, করিয়া প্রভৃতির অপিনিহিতি রূপ হাইট্যা, হাউট্যা, আইজ, কইরা’- স্থলে অভিশ্রুতি রূপ হেঁটে, হেটো, আজ, করে রূপ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয় এবং ‘পূজা, নিরামিষ’- প্রভৃতি স্থলে স্বরসঙ্গতি-জনিত রূপ ‘পুজো, নিরিমিষ’ প্রভৃতি চলিত ভাষায় ঠাই পেয়ে থাকে। ঐতিহাসিক কারণে ভাষার যে সকল ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধিত হয়, সেই সকল পরিবর্তিত রূপগুলি একমাত্র চলিত ভাষাতেই প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। সাধুভাষায় যেমন অপিনিহিতির ব্যবহার নেই, তেমনি অভিশ্রুতি এবং স্বরসঙ্গতিও প্রায় অব্যবহার্য বিবেচিত হয়।
বাঙলা ভাষার দ্ব্যক্ষর-প্রবণতার জন্য সাধু ভাষায় ‘করিব, যাইতেছি, গামােছা’ প্রভূতি শব্দ চলিত ভাষায় ‘করবাে, যাচ্ছি, গামছা’ প্রভৃতি রূপে ব্যবহৃত হয়। পদমধ্যস্থ ‘হ’- কারের লােপ- প্রবণতা চলিত ভাষার অপর বৈশিষ্ট্যঃ- ফলাহার>ফলার, চাহি চাই, তাহার>তার। স্বরভক্তির ফলে ‘শ্রী>ছিরি, স্নান>সিনান প্রভৃতি, সমীভবনের ফলে ‘এতদিন>অ্যাদ্দিন, তর্ক>তক্কো’ প্রভৃতি, স্বরাগমের ফলে ‘স্টেশন>ইষ্টিশন, বর্ণদ্বিত্ত্বর ফলে ‘বড়>বড্ড’ প্রভৃতি রূপ কখনাে সাধুভাষায় স্থান পায় না, কিন্তু চলিত ভাষায় এগুলি বর্জনীয় নয়।
সাধু ভাষার সঙ্গে চলিত ভাষার প্রধান এবং আবশ্যিক পার্থক্য বিধান করা হয় প্রধানতঃ ক্রিয়াপদ এবং সর্বনামের ক্ষেত্রে; সাধু ভাষায় ক্রিয়ার পূর্ণরূপ ব্যবহার আবশ্যিক, চলিত ভাষার ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপই শুধু ব্যবহার্য। চলিত ভাষায় ক্রিয়া পদগুলিকে সাধারণত দ্বিমাত্রক কিংবা দুই-য়ের গুণিতক মাত্রাতেই নিয়ে আসা হয়। ফলে— ‘করিতেছি>করছি, কচ্ছি, করিয়াছি>করেছি, করিলাম>করলাম’ প্রভৃতি রূপে ব্যবহৃত হয়। অসমাপিকা ক্রিয়াও এরূপ সংক্ষিপ্ত আকার ধারণ করে, যথা- করিতে>করতে, করিয়া>করে, করিলে>করলে প্রভৃতি। সাধুভাষায় সর্বনামের পূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয়, চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয় তার সংক্ষিপ্ত রূপ। যেমন-তাহার>তার, যাহাদিগকে>যাদের, ইহা>এ/এটা। এছাড়াও যৌগিক ক্রিয়ার ব্যবহার চলিত ভাষায় কম, যেমন— ‘শ্রবণ করিয়া>শুনে’, ‘লপ্রদান>লাফানাে’, ‘গমন করত>গিয়ে’ প্রভৃতি। অনেক সময় সাধু ভাষা এবং চলিত ভাষার ক্ষেত্রে শুধু ক্রিয়ারূপ ও সর্বনাম পদের পূর্ণতা ও সংক্ষিপ্ততা-জনিত পার্থক্যই বজায় রাখা হয়, অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে কোন বেলক্ষণ্য সৃষ্ট হয় না। চলিত ভাষার অন্যতম প্রবর্তক ও শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা প্রমথনাথ চৌধুরীর (বীরবলের) রচনাতেও এর নিদর্শন পাওয়া যাবে। ভারি ভারি তৎসম শব্দের ব্যবহার তাঁর রচনায় যথেষ্টই পাওয়া যায়।
বর্তমানে সাধু ভাষা সরল হাতে হতে এবং চলিত ভাষা প্রসারিত হতে হতে এমন এক স্থানে এসে পৌঁছেছে যে উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া ও সর্বনাম ছাড়া প্রায় কোন পার্থক্য নেই।
Leave a comment