প্রশ্নঃ সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই ইলাহী সম্পর্কে যা জান লেখ।

অথবা, সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই ইলাহী পর্যালােচনা কর।

অথবা, সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি পর্যালােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ষােড়শ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রেনেসাঁর যুগে আকবরের নতুন ধর্মনীতি প্রবর্তন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মূলত সম্রাট আকবর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর আনুগত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা নিয়ে ভারতে মুঘল শাসনের ভিত মজবুত ও সুদৃঢ় করার জন্য সব ধর্মের সারবস্তু নিয়ে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ নামে একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রবর্তন করেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- The 16th century was an age of enquiry an doubt and Akbar was its most perfect representative.

সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি পর্যালােচনাঃ

নতুন ধর্মনীতি প্রবর্তনের কারণঃ

১. পারিবারিক প্রভাবঃ ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেন, “আকবরের পিতামাতা ও পিতামহ কেউই গোঁড়া ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। তাদের ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা আকবরকে প্রভাবিত করে।”

২. গৃহশিক্ষকের প্রভাবঃ আকবরের গৃহশিক্ষক আবদুল লতিফ ছিলেন মরমীবাদে বিশ্বাসী। তার ‘সুলহে কুল’ নীতি আকবরের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। তার অভিভাবক বৈরাম খানও তাকে উদারতা শিক্ষা দেন।

৩. সুফীদের প্রভাবঃ প্রথম জীবনে কাবুলে অবস্থানকালে আকবর সুফীবাদের সংস্পর্শে আসেন। ড. ইউসুফ হাসানের মতে, “সুফীবাদের ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ মতবাদের সাথে আকবরের দ্বীন-ই ইলাহীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।”

৪. রাজপুত স্ত্রীদের প্রভাবঃ পারিবারিক জীবনে হিন্দু রাজপুত রমণীদের সাথে বিবাহের ফলে আকবর আরাে উদারপন্থী ও পরধর্ম সহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। ‘আকবরনামায়’ উল্লেখ আছে, আকবর তার হিন্দু স্ত্রীদের স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছিলেন।

৫. যুগ ধর্মের প্রভাবঃ ষােড়শ শতাব্দী ছিল ধর্মান্দোলনের যুগ। আর সে সময় ধর্ম সম্পর্কে নতুন তথ্যের আবিষ্কার ও বিভিন্ন বাড়াবাড়ি জনসাধারণকে ধর্মের ব্যাপারে সন্দিহান করে তােলে। সে যুগে কবির, নানক, শ্রীচৈতন্য, রামানন্দ প্রভৃতি ব্যক্তির ভক্তিবাদ আন্দোলন আকবরের ধর্ম চিন্তাকে প্রভাবিত করে।

৬. শিয়া সুন্নী দ্বন্দ্বঃ আকবরের দরবারে শিয়া সুন্নীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-কলহ বিদ্যমান ছিল। এতে তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিকল্প ধর্মনীতির ব্যাপারে চিন্তা করতে থাকেন।

৭. কতিপয় অসাধু আলেমের প্রভাবঃ কতিপয় অসাধু আলেম ধর্মীয় ব্যাপারে আকবরের মনে দুরভিসন্ধি সৃষ্টি করে তাকে বিপথে পরিচালিত করে। তারা নিজেদের সুবিধা ও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভ্রান্তিমূলক ফতােয়া দিয়ে সম্রাট আকবরকে প্রভাবিত করে।

৮. শেখ মুবারকের প্রভাবঃ সুপণ্ডিত, উদার মতাবলম্বী ও সহিষ্ণু মনােভাবাপন্ন শিয়া আলেম শেখ মুবারক এবং তার দুই পুত্র আবুল ফজল এবং ফৈজির পরামর্শে সম্রাট আকবর ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন ধর্মমত চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

৯. জৈন ধর্মের প্রভাবঃ ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর জৈন ধর্মগুরু হিরা বিজয় সুরীর প্রভাবে সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবারে যে কোনাে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ এবং তাদের ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে এ ধর্মের বাস্তবতা স্বীকার করেন।

১০. সহজাত সত্য অনুসন্ধানঃ সম্রাট আকবর ছিলেন সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের অনুসন্ধানী। তিনি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্ম অনুসন্ধান করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সকল ধর্মের সারবস্তু এক ও অভিন্ন। তাই সহজাত সত্য অনুসন্ধিৎসু মন তাকে নতুন ধর্মনীতি গ্রহণে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

১১. রাজনৈতিক কারণঃ রাজনৈতিক কারণেও সম্রাট আকবর সকল ধর্মমতকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সর্বজনীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “আকবর ভারতে হিন্দু মুসলিমের মিলনে এক ধর্মনীতি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।”

আকবরের ধর্মনীতিসমূহঃ

১. ইবাদতখানা নির্মাণঃ ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেন, আকবর সত্য অনুসন্ধানে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেহপুর সিক্রিতে একটি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জ্ঞানী পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান এবং সকল ধর্মের পণ্ডিতদের কথা মনােযােগ সহকারে শ্রবণ করেন। এভাবে বিভিন্ন ধর্মের মূল বাণী শ্রবণের পর তিনি একটি নতুন ধর্মমত তৈরি করেন।

২. অভ্রান্ত ও সর্বময় কর্তৃত্ব ঘােষণাঃ ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুবারকের নেতত্বে কয়েকজন সরকারি আলেম এক দলীলে ঘােষণা করেন, যেহেতু বাদশাহ সকল জ্ঞানের অধিকারী, সেহেতু তিনি মুজতাহিদ অপেক্ষাও মর্যাদাসম্পন্ন এবং জাতি ধর্ম ও প্রজার মঙ্গল সাধনের জন্য কার্যক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এতে আকবরকে সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হয়।

৩. ‘ইমামে আদেল’ উপাধি গ্রহণঃ ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে আকবর জাগতিক, পারলৌকিক উভয়বিধ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হন এবং ‘ইমামে আদেল’ উপাধি গ্রহণ করেন।

৪. ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ প্রবর্তনঃ ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বিভিন্ন ধর্মের সারবস্তু নিয়ে ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ নামক নতুন ধর্মমত ঘােষণা করেন। এতে ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মের রীতি-নীতি অল্প-বিস্তর সংযােজিত হয়েছিল।

৫. দ্বীন-ই ইলাহীর মৃলনীতিসমূহঃ ঐতিহাসিক শর্মা বলেন, দ্বীন-ই ইলাহীর অনেকগুলাে মূলনীতি ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য মূলনীতি হলাে-

ক. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলিফাতুল্লাহ;

খ. পরস্পর সাক্ষাতে ‘আল্লাহু আকবর’ এবং উত্তরে ‘জাল্লা জালালুহু’ বলতে হতাে;

গ. জন্মবার্ষিকী ও প্রীতিভােজের আয়ােজন করতে হতাে;

ঘ. যতদূর সম্ভব মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করতে হতাে;

ঙ. এ ধর্মের সদস্যদের কসাই, জেলে, ব্যাধ ও নিম্নজাতের লােকদের সাথে মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল;

চ. অগ্নিকে পবিত্র জ্ঞান করা হতাে;

ছ. সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও ছিল এ ধর্মের নীতি;

জ. এ ধর্মের অনুসারীদের মৃত্যুর পর ভােজ না দিয়ে মৃত্যুর আগেই ভােজ দিতে হতাে; এবং

ঝ. অপ্রাপ্ত বয়স্কা বালিকা ও বৃদ্ধার সাথে সহবাস নিষিদ্ধ ছিল।

৬. ইসলাম অবমাননাকর নীতি প্রবর্তনঃ দ্বীন-ই ইলাহী প্রবর্তনের মাধ্যমে ইসলামের মূলনীতির ওপর চরম আঘাত হানা হয়। দ্বীন-ই ইলাহীর ইসলাম পরিপন্থী রীতি-নীতিসমূহ ছিল- সম্রাটকে সেজদা করা, দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা; গরুর মাংস খাওয়া কমানোর নির্দেশ, নামায, রােযা, হজ্জ, আযান, কুরআন-হাদীস ইত্যাদি পাঠ এবং আরবি ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ করা। মসজিদগুলােকে আস্তাবলে রূপান্তর করা হয়। হিজরী সনের পরিবর্তে তারিখে আলফী প্রবর্তন করা হয়।

৭. মুজাদ্দিদ আলফে সানীর আন্দোলনঃ সম্রাট আকবরের ভ্রান্ত ধর্মমতের বিরুদ্ধে এবং পবিত্র ইসলাম রক্ষার উদ্দেশে হযরত শায়খ আহমদ সেরহিন্দী ওরফে মুজাদ্দিদ আলফে সানী এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তােলেন।

৮. নতুন ধর্মের অসারতাঃ ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ ও শর্মা বলেন, দ্বীন-ই ইলাহী আকবরের ভুলের স্মৃতিস্তম্ভ, জ্ঞানের নয়। এ ধর্ম বিশ্বাস হাস্যকর, অহংকার কিংবা অসংযত স্বৈরাচারের পৈশাচিক বিকাশ।

৯. দ্বীন-ই ইলাহীর পরিণতিঃ দ্বীন-ই ইলাহী জনগণের মধ্যে তেমন কোনাে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আবুল ফজলের মতে, এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ জন। হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র বীরবলই এ ধর্মে দীক্ষিত হয়। দ্বীন-ই ইলাহী আকবরের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত হওয়ার কারণে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এ ঐতিহাসিক সমালােচনা ও সম্রাট আকবর প্রবর্তিত দ্বীন-ই ইলাহীর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়।

ভি. এ. স্মিথ, উইলস হেগ, মনসেরট, এডওয়ার্ড প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন, আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ত্যাগ করে দ্বীন-ই ইলাহী নামক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন। তবে ডুবেরিক ও বটেল হাে বলেন, তর্ক বিতর্ক সত্ত্বেও আকবর পূর্বের মতােই মুসলমান ছিলেন, কিন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেন, আকবর ইসলামের অনুসারী ছিলেন না।

ড. কাফি কর বলেন- It might be that Akbar’s political dim gt establishing on all Indian Mughal Empire had some influence on his religious policy as political sectors largely influenced the religious settlement of the English contemporary Queen Elizabeth.

উপসংহারঃ সব ধর্মের সার নিয়ে সম্রাট আকবর যে ধর্মীয় মতবাদ প্রবর্তন করেন তা ছিল ধর্মীয় মতবাদের ছদ্মাবরণে একটি রাজনৈতিক মতবাদ। ফলে এই মতবাদ মানুষের মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ তৈরি করেনি। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- The success or failure of the Din-e-Elahi as a cult is not a matter of importance, politically it produced wholly beneficial results.