‘সমালোচনা’ শব্দটির অর্থ সম্যকরূপে আলোচনা। বলা বাহুল্য এ আলোচনা সাহিত্য সম্পর্কিত। এই সাহিত্য সমালোচনা সাহিত্য সৃষ্টির লগ্ন-পর্ব থেকেই যুক্ত। সঠিকভাবে বললে বলা যায় সাহিত্য সৃষ্টি ও সাহিত্য সমালোচনা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। কোন সৃষ্টির প্রথম সমালোচক স্রষ্টা নিজে। স্রষ্টাকে সৃষ্টির দিব্য প্রেরণায় উদ্ভাসিত হয়ে থাকলেই হয় না, তাকে প্রকরণ সাজানোর মজদুরিও করতে হয়। সেই সাজানো-গোছানোর দক্ষতা দেখানোর জন্যই স্রষ্টাকে কঠোর সমালোচক হতে হয়। শিল্পী যদি এখানে গোপন ভাঙা-গড়ার উৎসাহ নিয়ে আত্মবীক্ষণাগারে না ঢোকেন, তাহলে সার্থক সাহিত্যিকের পদ কৌলীন্য লাভে অবশ্যই ব্যাঘাত ঘটবে। তাই নিজের ভাগ্যে নিজেই ‘দ্বিতীয় এক ধূম্রলোচন’ না হলেও সব সাহিত্যিকই একজন সমালোচক এবং তাঁর সৃষ্টির প্রথম সমালোচক। আদি কবি যদি বাল্মীকি হন, তাহলে তাঁর সৃষ্টির সেই প্রথম লগ্নে ‘কিমিদং’–এ কি সৃষ্টি করলেন এই প্রশ্ন ও সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁকে আদি সমালোচকও করে তুলেছিল।

সমালোচনার উৎসমূলে সাহিত্য সৃষ্টি ও সেই সৃষ্টির ভালো-মন্দ বিচার থেকে সহজাত হলেও, পরবর্তীকালে সাহিত্য সমালোচনা বা সমালোচনা সাহিত্য সাহিত্যের এক বিশেষ শাখারূপেই পরিবর্ধিত হয়ে উঠেছে।

সমালোচক যথার্থভাবেই সৃষ্টি যজ্ঞের পুরোহিত। দেবতার নির্দেশ এবং অভিপ্রায়কে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য যেমন পুরোহিত তন্ত্রের সৃষ্টি, স্রষ্টাকে পাঠকের কাছে অন্তরঙ্গ করে তোলার জন্য তেমনিভাবে সমালোচনারও সৃষ্টি। এই পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সমালোচক স্রষ্টার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়কে পাঠকের সম্মুখে প্রকাশ করেন, এই সঙ্গে পাঠকের বিপরীতে স্রষ্টাকেও পাঠকের আস্বাদন যোগ্যতা এবং রসরুচি সম্বন্ধে পরোক্ষে সচেতন করে তোলেন।

পাঠক সমাজের সঙ্গে সংযোগকারী সত্তা হিসেবে সৃষ্টির দল মোচনের জন্য সমালোচকের চাই পরিমিত ব্যাখ্যা ও সৃষ্টির নিগূঢ় মর্মের উদ্ঘাটন। সৃষ্টিকে কেন্দ্রস্থলে রেখে এই উভয়ের ভারসাম্য রক্ষাই প্রকৃত সমালোচকের কাজ। এর মধ্য দিয়েই সাহিত্যিক ও পাঠক উভয়কেই আদর্শ সমালোচক সচেতন করে তোলেন।

সমালোচকগণ সাধারণত তিনটি ধারায় সাহিত্যের বিচার বা মূল্যায়ন করেন। ধারা তিনটি হচ্ছে ব্যাখ্যান, বিচার ও উপভোগ।

কোন রচনার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ পরিচয়ে রচনার অন্দরমহলে প্রবেশ করে তার ব্যাখ্যানমূলক প্রতিবেদন পাঠক সমাজে উপস্থাপিত করাই ব্যাখ্যানমূলক সাহিত্য-বিচারের কাজ। একটা নাটক বা গল্প, কবিতা, উপন্যাসের মূল তাৎপর্য, তার রসবৈচিত্র্য, তার কলাকৌশল, স্রষ্টার মানসিকতা ও অভিপ্রায়কে পাঠকের বোধগম্য করে তুলে তাকে বুঝিয়ে দেওয়াই ব্যাখ্যানমূলক সমালোচনার কাজ। তবে এ কাজ করতে গিয়ে সমালোচক যথাসম্ভব নিস্পৃহ থেকে বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে এমনভাবে বিচার করবেন যাতে মূল সৃষ্টি সম্পর্কে যাতে পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের প্রাথমিক পরিচয় ঘটতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়। দ্বিতীয় ধারা, বিচারমূলক সমালোচনা। এখানে সাহিত্যকে আসামীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সাহিত্য থেকে কতটুকু সামাজিক কল্যাণ হল, সাহিত্য কী পরিমাণে সংসারের উপকার করতে পারে, সাহিত্য সৃষ্টিতে পাঠককে কোনো মহৎ ধারণার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো হচ্ছে, না পাঠককে ক্ষণিক চমকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, এসব দেখা ও দেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একদিকে লেখকের ত্রুটি সম্পর্কে সজাগ, অন্যদিকে পাঠকের রুচিকে সঠিক রাখা ও উঁচুতে তুলে ধরার জন্যেও তিনি সতর্ক থাকেন। এই বিচারমূলক সমালোচনায় সমালোচক অনেকটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য এই দায়িত্ববোধের বাড়াবাড়ি অনেক সময় সমালোচকের গুণ না হয়ে দোষ হয়ে দাঁড়ায়। তৃতীয় ধারা, উপভোগ। এখানে সমালোচক তাঁর সংবেদনশীল মন নিয়ে উৎকৃষ্ট শিল্পের উপভোগ-অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করে যান। শিল্পের মধ্যে যে উৎকৃষ্ট অংশ তিনি পেলেন তাই পাঠককে উপহার দেওয়া এখানে সমালোচনার মূল লক্ষ্য। সমালোচকের ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের কথা অবশ্য বড়ো হয়ে দেখা দেয়। কোন তত্ত্ব নয়, বিচারের রায় দেওয়া নয়, শুধু উপভোগের দিকটাই এখানে প্রধান হয়ে ওঠে। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যের নিরপেক্ষ বিচার অবশ্য হয় না। তার পরিবর্তে সমালোচকের উপভোগের কথা, সমালোচকের নতুন দৃষ্টিতে সৃষ্টির সমান্তরাল আর এক জগতের আস্বাদ পাওয়া যায়।

এখন কথা হচ্ছে, এই তিন ধারার প্রেক্ষাপটে সমালোচকের আদর্শ সমালোচনার মানদণ্ড কী হবে? অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের নিরপেক্ষ বিচার, না বিচারের মানদণ্ডে সামাজিক দায়-দায়িত্বের নিরিখে সাহিত্যের বিচার, না সৃষ্টিকে শুধু উপভোগ করে নিজস্ব কল্পনার জাল বিস্তৃত করা? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সহজ নয়। তবু মনে হয়, এর যে-কোনো একটিকে নয়, ভারসাম্য রেখে এই তিনের সামঞ্জস্য করাই আদর্শ সমালোচকের প্রয়োজন। নিরপেক্ষ বিচারের সঙ্গে, সজাগ সামাজিক চেতনা, সেইসঙ্গে পাঠকের রুচির মান সম্বন্ধে সচেতনতা এবং অতিরিক্ত কল্পনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সংযম ও সতর্কতার সঙ্গে স্রষ্টার সৃষ্টিকে উপভোগ তথা স্রষ্টার মানসিকতার সহমর্মী হয়ে ওঠা ও পাঠককে তার অংশভাগী করে তোলার আদর্শই সমালোচকের আদর্শ হওয়া উচিত। —এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে ফেললেও সমালোচকের এই পথ দীর্ঘ সাধনার পথ। তাই সত্যকারের সাহিত্যিক দুর্লভ, আর সত্যকারের সমালোচক সুদুর্লভ।

সাধারণভাবে সমালোচনার তিনটি প্রধান ধারার কথা বলা হলেও সাহিত্য বিচারে অনেকগুলি পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। এর মধ্যে কোনটা গ্রহণীয় বা আদর্শ তা বলা কঠিন। সমালোচকের মানসিকতা, প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক-একটি পদ্ধতি গড়ে উঠেছে এবং সমালোচকের সক্ষমতার ওপরেই তাঁদের গৃহীত পদ্ধতির উৎকর্ষ নির্ভর করে। আর এই প্রতিটি পদ্ধতির মধ্যেই কিছু কিছু দিকদর্শী নির্দেশ রয়েছে। তাই কোন পদ্ধতিই সম্পূর্ণ বর্জনীয় নয়। আর সেই কারণেই মোটামুটিভাবে পদ্ধতিসমূহের সাধারণ পরিচয় জানা আবশ্যক। এই পদ্ধতিগুলিকে কেন্দ্র করে সমালোচকগণ সমালোচনার নানা প্রকার শ্রেণিভেদ করলেও সব কয়টিই সূক্ষ্ম সুতোর ওপর নির্ভরশীল। একটাকে স্বতন্ত্র করতে গিয়ে অন্যটাকে স্পর্শ করে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। তাই এই শ্রেণিভেদ আসলে কিছুই নয়, সমালোচকের এক-একটি গুণ সংকেতকে সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বলতর করে দেখা। শ্রেণি নিরূপণের ক্ষেত্রে সংখ্যা নিরূপণ এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এই সংখ্যা নিরূপণের কোন সুস্পষ্ট নীতি-নিয়ম নেই। সংস্কৃত অলঙ্কারিকদের হাতে অলঙ্কার আর গুণের হিসেব যেমন কমেছে বেড়েছে, তেমনিভাবে সমালোচনার শ্রেণিকরণের হিসেবও সময়ে ওঠা-নামা করেছে। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধারণা উভয় ক্ষেত্রেই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই কথাগুলি মনে রেখেই এবং বিভিন্ন মতের সামঞ্জস্য করেই প্রকৃতি ও প্রকার অনুসারে সমালোচনা মোটামুটি কয়েকটি ধরনের বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে :

(ক) ঐতিহাসিক সমালোচনা (Historical criticism) : শিল্পের অন্তরঙ্গ পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণের চেয়ে শিল্পোদ্ভাবনার পশ্চাদবর্তী বিষয় বা ঘটনাসূত্রের আবিষ্কারেই যেখানে অধিকতর উৎসাহ, সেখানেই ঐতিহাসিক সমালোচনার ভিত্তি তৈরি হয়। এই পদ্ধতিতে সমালোচকের দৃষ্টি প্রধানত ইতিহাস ও পটভূমিকার ওপর নিবন্ধ থাকে। ইতিহাস, সমাজ ও জীবন ধারার প্রভাবে সাহিত্যের বিষয়, রূপ ও রীতির পরিবর্তন হয়। এই প্রভাবকে এক কথায় ‘ইতিহাস’ বলে নির্দেশ করা যায়।

ঐতিহাসিক সমালোচনার আর একটি রূপ হল জীবন চরিতভিত্তিক সমালোচনা। এই সমালোচনার ক্ষেত্রে সমালোচক স্রষ্টার জীবনী, পত্ররাজির ওপর নির্ভর করেন। সৃষ্টির তুলনায় স্রষ্টার প্রতি অধিকতর আগ্রহী হন। কিন্তু স্রষ্টার জীবনসূত্রেই সৃষ্টির উৎস লুকিয়ে থাকে, এটা মেনে নিলে ভুল করা হবে। সাহিত্যে সৃষ্টির সূচনায় স্রষ্টার জীবন ও সমকালীন যুগ তরঙ্গের আলোচনাই সার্থক ঐতিহাসিক সমালোচনার বিষয়বস্তু‌ হতে পারে।

আধুনিককালের দ্বান্দিক জড়বাদ বা দ্বন্দ্বমূলক সমালোচনা (dialectical materialism) এই ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। এই মতে সাহিত্য একটা বিশেষ সামাজিক প্রয়োজনের সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। আর সেই সামাজিক তাড়না হচ্ছে মানুষের নিরন্তর শ্রেণি সংগ্রাম। সাহিত্য এই শ্রেণি সংগ্রামেরই হাতিয়ার। এই পদ্ধতিতে বিশ্বাসী সমালোচকগণ মনে করেন যে সাহিত্য সৃষ্টির মূলে আছে বাস্তব প্রয়োজনবোধের তাড়না। ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা এবং সমাজ সচেতন হওয়ার নির্দেশই এই মতবাদে বিশ্বাসী সমালোচকদের নির্দেশ। কিন্তু সামাজিক চেতনার বাঁধা ছকে লেখকের অনুভূতি রাজ্যের ইশারা সব সময় ধরা সম্ভব হয় কি? বস্তুবাদী দর্শনে সাহিত্য সৃষ্টিতে পরিবেশের ব্যাখ্যা হয়, সাহিত্যের রূপ ও রসোপভোগের ব্যাখ্যা হয় না। তবু মার্কসবাদীদের কালভিত্তি সমালোচনার কথা মনে রেখে স্রষ্টা ও সৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাখ্যাকে অ-মার্কসবাদীগণও প্রয়োজনমতো গ্রহণ করেন।

(খ) ধারণামূলক বা অনুভূতি গ্রাহ্য সমালোচনা (Impressionist criticism) : এই পদ্ধতিতে অনুভূতিশীল, আত্মভাবনিষ্ঠ সমালোচক সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রস তাৎপর্যকেই ধরিয়ে দেন, নিজে অভ্রান্ত বিচারক হয়ে বসেন না। সমালোচকের কাছে চরিতার্থতার একটিই মাপকাঠি, তা হচ্ছে আস্বাদনগম্যতা। সাহিত্য পাঠের পর পাঠকের মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয় এবং সেই অনুভূতির অনুষঙ্গে নানা ভাবনা এসে পড়ে তারই আকর্ষণীয় বিবরণ এই অনুভূতির মূল বিষয়। সমালোচনাকে যাঁরা পূজা বলে অভিহিত করতে চান, তাঁদের আস্বাদনব্যপ্রতা সমালোচনার মুগ্ধতা বা আরতির সীমা পর্যন্তই পৌঁছায়, এই ধরনের সমালোচনা সমালোচনার নামে মূল বিষয়কে অবলম্বন করে শিল্প কর্মের আরও একটি সৃষ্টি বা নতুন সৃষ্টি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও আছে। ব্যক্তিগত অনুভূতির আতিশয্যও বিপদ ঘটাতে পারে, হতে পারে সমালোচকের আত্মজৈবনিক অনুভবের বিকৃতি। স্রষ্টা না হলে বা সৃষ্টিযোগ্য মানসিকতা না থাকলে এই জাতীয় সমালোচনায় সার্থক হওয়া কঠিন। প্রতিভাবান সমালোচকেরাই এই জাতীয় আতিশয্যকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন। রাখতে পারেন রবীন্দ্রনাথ ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’, ‘মেঘদূত’ সমালোচনায়।

(গ) তুলনামূলক সমালোচনা (Comparative criticism) : উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দূরত্বকে অবসিত করে পৃথিবী ক্রমশই ছোটো হয়ে আসছে। দেশ-কালের সীমা সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে দেশভেদে সাহিত্যের অভিপ্রায় ও সেই অভিপ্রায়ের প্রকাশে বিশেষ তারতম্য নেই। দেশ-কাল ভেদে অখণ্ড মানবসত্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টার মধ্যেই এই সমালোচনা সাহিত্য এগিয়ে এসেছে। বহুকাল আগে ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ (কথাটি তুলনামূলক সাহিত্য বিচার অর্থেই তিনি ব্যবহার করেছিলেন) বলেছিলেন এই বিশ্বসাহিত্য বিশ্বমানবকেই অন্বেষণ করে। এই তুলনামূলক সমালোচনায় এ দেশের সাহিত্য কর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে সমমর্যাদাসম্পন্ন অন্য দেশের সাহিত্য প্রসঙ্গ এসে পড়ে। ধারণা-ভিত্তিক, ঐতিহাসিক-ভিত্তিক, সামাজিক-ভিত্তিক, সাহিত্য শাখা-ভিত্তিক, রূপ-ভিত্তিক এর যে কোনো ভিত্তি বা পদ্ধতিতেই তুলনামূলক সমালোচনা সম্ভব। এই তুলনামূলক সমালোচনার মধ্য দিয়েই আমাদের জাতীয় সাহিত্য তার দেশের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশের সাহিত্যের সঙ্গেও তুলনায় আসতে পারে। একজনের সৃষ্টির কষ্টিপাথরে অপরজনের সৃষ্টিকেও যাচাই করা যেতে পারে। যাচাই করা যেতে পারে কালিদাসের সঙ্গে শেক্সপীয়রের, শেক্সপীয়রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের। শুধু সাহিত্যের সঙ্গে সাহিত্যের কেন, কাব্যের সঙ্গে সংগীতের, কাব্যের সঙ্গে চিত্রকলার তুলনামূলক আলোচনাও সম্ভব এবং এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার সেন এবং সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পথিকৃৎ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

(ঘ) গঠনাত্মক সমালোচনা (Analysis of Structural criticism) : নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা— সাহিত্যের এই বিভিন্ন শ্রেণিভাগ রয়েছে। এই বিভিন্ন শ্রেণির স্থূল ও সূক্ষ্ম পার্থক্যকে স্বীকার করেই সাহিত্যের অন্তর্নিহিত লক্ষণ বিচার করে সমালোচক তার শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব নির্ণয়ে যত্নবান হন। এই সমালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে তুলনায় আলোচ্য গ্রন্থটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই শ্রেণিগত পার্থক্য ও তার স্থূল ও সূক্ষ্ম বিচার নিয়ে গঠনাত্মক সমালোচনা ইদানীংকালে সমালোচনা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ক্রমে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। এই পদ্ধতির সমালোচকগণ সাহিত্যে বিভিন্ন শ্রেণির কথা মনে রেখেই আলোচ্য বিশেষ শ্রেণি বা রূপের গঠনাত্মক বিশ্লেষণ করছেন। তাঁদের মতে একটি শ্রেণির সাহিত্য রূপের সঙ্গে অপর শ্রেণির সাহিত্য রূপের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য আলোচনা ছাড়াও তাঁরা বলছেন যে একই শ্রেণি বা রূপের প্রত্যেকটি সাহিত্য কর্মও পৃথক জীবনদেহের মতো স্বতন্ত্র। সেই স্বতন্ত্রকেই মৌলিক রূপক হিসেবে ধরে অর্থ ও ব্যঞ্জনার সঙ্গে তার অভিন্নতা কতখানি সেই বিচারে সমালোচকগণ অগ্রসর হয়েছেন। এই পদ্ধতিকে অবলম্বন করে সমালোচনার ক্ষেত্রে আই. এ. রিচার্ডস্-এর নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলায় এই পদ্ধতিভিত্তিক সমালোচনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটোগল্পের সীমারেখা’ বইটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

(ঙ) পাঠভিত্তিক সমালোচনা (Textual criticism): আলোচ্য গ্রন্থের শুদ্ধ পাঠ নিরূপণ করাই এখানে সমালোচকের লক্ষ্য। কি প্রাচীনকালের হাতে লেখা পুঁথি বা পরবর্তীকালের ছাপান গ্রন্থ—বিভিন্নকালে মূল গ্রন্থের পাঠান্তর ঘটে। এই পাঠান্তরের নানা বৈষম্য ও ভুলভ্রান্তিকে সংশোধন করে তাদের মূল পাঠকে ফিরিয়ে আনাই এই পাঠভিত্তিক সমালোচনার উদ্দেশ্য। প্রাসঙ্গিক টীকা-টিপ্পনির দ্বারা মূল গ্রন্থের ভাষাগত বিশুদ্ধতার কারণ ব্যাখ্যা, এর দ্বারা পরবর্তীকালে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে ভ্রান্তি ঘটেছে তা দূর করা এবং মূল গ্রন্থের পাঠকে গ্রন্থ রচয়িতার সমকালীন সীমার মধ্যে দেখিয়ে দেওয়া এখানে সমালোচকের লক্ষ্য। এর জন্য প্রয়োজন গ্রন্থ-রচয়িতার সমকালীন ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সমালোচকের ওয়াকিবহাল থাকা এবং অভিজ্ঞতা ও বিচারশীল মানসিকতা, সর্বোপরি সাহিত্যবোধ।-সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনায় সাধারণত গ্রন্থ সম্পাদক ও প্রকাশকদের এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব দেখা যায়। বিদেশে শেকস্পীয়র প্রমুখের গ্রন্থ সম্পাদনে এই পাঠান্তর নিয়ে সচেতনা কিছুদিন ধরে দেখা যায়। এদেশে বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতির গ্রন্থ সম্পাদনে সাহিত্য পরিষৎ সম্পাদিত ও প্রকাশিত গ্রন্থে মূল-পাঠকে অক্ষত রাখবার এই জাতীয় প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই।

(চ) ভারতীয় বিষয়, রূপ ও রসবাদী সমালোচনা: সাহিত্যের লক্ষ্য বা সাহিত্যিকের উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক এবং তর্ক বহু প্রাচীনকাল থেকেই বহমান। সাহিত্যে গুরুত্ব বেশি কিসের, বিষয়ের না রূপ-রীতির? সাহিত্যে গৌরব অর্জনে বিষয় অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে। প্রাচীন ব্যাস বাল্মীকি বা হোমার, শেকস্পীয়র, দাস্তে বা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তার বিষয় গৌরব নিয়ে আমাদের কাছে মহৎ শিল্পী হিসেবে স্বীকৃত। তুলনায় টেনিশন, অস্কার ওয়াইল্ড, ভারতচন্দ্র, বীরবল তাঁদের রচনার চমৎকারিত্ব সত্ত্বেও এই জাতীয় বিশাল স্বীকৃতি আনতে সক্ষম হননি। অবশ্য সাহিত্যে বিষয় গৌরব বলতে রাজা-মহারাজা বা সমতুল্য ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিষয়কেই বোঝায় না, সাধারণ মানুষের গোষ্ঠী ভাবনা, গোষ্ঠী যন্ত্রণা, সংহতি ও প্রতিবাদকে নিয়েও সেই বিষয় গৌরব গড়ে উঠতে পারে। তা যে পারে, আধুনিককালের নাটক, উপন্যাস তার স্বাক্ষর।

কিন্তু তবু, সাহিত্যে বিষয় গৌরবই মূল কথা নয়। রূপবাদী সমালোচকগণের মতে সাহিত্যের সার্থকতা নির্ভর করে তার প্রকাশভঙ্গিতে। আর এখানেই রয়েছে সাহিত্যের শিল্পগুণ। সৃষ্টিতে এই শিল্পগুণ না থাকলে যে-কোন মহৎ বিষয় ‘বিষয়’ মাত্র তা সাহিত্য নয়। আর এই গুণেই ‘বৃত্রসংহার’, রৈবতক কুরুক্ষেত্র প্রভাস বিষয় মাহাত্ম্যে তুল্যমূল্য হলেও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সাহিত্যের আসরে যেমন স্থায়ী মূল্য পেয়েছে, অন্য কাব্যগুলি তা পায়নি।

সাহিত্যে এই গুণ কী? এর সন্ধানও প্রাচীনকাল থেকেই আলঙ্কারিকগণ করে চলেছেন। এই জিজ্ঞাসার উত্তরেও নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করেছেন। তত্ত্ব চূড়ায় আরোহণ করতে গিয়ে অনুসন্ধানী দল প্রথম যে বীজটি খুঁজে পেলেন তা হল কাব্যের বাচ্যার্থ বা কথা বস্তু। এঁরা বললেন, ‘কাবাং গ্রাহামলংকরেৎ। সুন্দর শব্দ চয়নে, শব্দে শব্দে যে অনুরণন হয়, শব্দ সাম্যের সেই ঝঙ্কৃতিকেই তারা বললেন কাব্যের প্রাণ। কিন্তু তাই কি? তাহলে তো শব্দের ব্যুৎপত্তিতেই কাব্যার্থ প্রতীতি হত। শুভঙ্করের আর্যা বা খনার বচনও কাব্য হত।

আর এক ধাপ এগিয়ে চলার পথে মনে হল, সুন্দর কথাকে সুন্দর করে গুছিয়ে বলার মধ্যে রয়েছে কাব্যের কাব্যত্ব। এই গুছিয়ে বলাই হচ্ছে রচনা রীতি (Style)। ‘বিশিষ্টা পদ রচনা রীতিঃ’। বিশিষ্টভাবে পদরচনা করাই হচ্ছে রীতি। আলঙ্কারিক বামনের কথায় ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য’। কিন্তু এর মধ্যে সত্য কতখানি আছে। উৎকৃষ্ট রীতি সাহিত্য যশ প্রাপ্তির সাময়িক চাহিদা মিটতে পারে, রচনার চমৎকারিত্বে সাময়িক বিভ্রান্তি সম্ভবপর। কিন্তু হার্টের বেসাতির প্রয়োজনটুকু ছাড়া স্থায়ীকালের দরবারে তার স্থান হয় কি? বাংলা সাহিত্যে এককালের সাড়া জাগানো ‘দৃষ্টিপাত’ আজ পুরোনো এবং বিস্মৃতির বালুবেলায় চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, রবীন্দ্রনাথ, কালিদাসের নাম নাই বা করা গেল।

ধ্বন্যালোক-কারের কথায়, লাবণ্য যেমন রমণীর দেহকে জড়িয়েও তার অতিরিক্ত অন্য কিছু, তেমনি মহাকবিদের রচনায় তার শব্দ, অর্থ রচনাভঙ্গি ছাড়া অতিরিক্ত আরও কিছু আছে। এই অতিরিক্তটুকুই কাব্যের প্রাণ।

কাজেই কাব্য-প্রাণ ভ্রমরায় সন্ধানী দল বলে উঠলেন, ‘এর বাহ্য, আগে কহ আর’। এঁরা দেখলেন সুন্দর অলঙ্কার ও রচনার পরিপাঠ্য থাকা সত্ত্বেও রচনা মাত্রকেই কাব্য বলা যায় না। এসব না থাকলেও অনেক কাব্য পাঠককে ভাবের আনন্দলোকে পৌঁছে দেয়। ভূমিজ হয়েও যে কাব্যের ব্যঞ্জনা রসিক পাঠককে ভূমানন্দে পৌঁছে দেয় তাই সার্থক কাব্য। আর এই যে ব্যঞ্জনা এ শব্দের ব্যঞ্জনা নয়, অলঙ্কারেরও ব্যঞ্জনা নয়। এ হচ্ছে ভাবের ব্যঞ্জনা। এই ব্যঞ্জনাকেই এঁরা বললেন ধ্বনি। —এই ধ্বনিই হচ্ছে কাব্যের আত্মা। ‘কাব্যাত্মা ধ্বনি’। এ শব্দ-ধ্বনি নয়, অর্থ-ধ্বনি নয়, অলঙ্কারের ধ্বনিও নয়। এ হচ্ছে কাব্য পাঠজনিত রসিক পাঠক-হৃদয়-জাত ভাব ধ্বনি। রসবাদীরা একেই বলেছেন রস ধ্বনি। এই রসই হচ্ছে কাব্যের আত্মা। কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায় রসাত্মক বাক্যই হচ্ছে কাব্য। ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্।’

শিল্পে বা কাব্যে এই রস নিষ্পত্তিতে বিষয় বা শিল্পরীতি সাহায্য করে মাত্র। সাহিত্যের আনন্দ, নিজেরই আনন্দময় সংগীতের আস্বাদন রূপ একটা গ্রামার। প্রাচ্য আলঙ্কারিকদের রস বা ইউরোপীয় সমালোচকদের সৌন্দর্য—আনন্দের কারণ যাই হোক, কাব্যের বস্তুগত উপাদান ও শিল্পরূপের সমন্বয় এই রস ও সৌন্দর্য নিষ্পত্তির কারণ। আর এই বিষয়গত উপাদান বা শিল্পরীতি পৃথকভাবে পরিণামী রস নয়-এদের মিশ্রণে রসের সৃষ্টি হয়।

এ-সঙ্গে এটাও লক্ষণীয় যে রসের নিষ্পত্তি শুধু হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নয়, বুদ্ধিগত তৃপ্তিও এই রস নিষ্পত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। আধুনিককালের কবিতা, নাটক, উপন্যাসের অনেক ক্ষেত্রেই বুদ্ধি নির্ভর বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু হৃদয় নির্ভর আবেগের সাহায্যেই রচনাগুলি উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। হৃদয়ের আবেগ ও বুদ্ধির অনুভব বা দীপ্তি, এই বোধি ও বুদ্ধি, চিদ্ ও হৃদ–এই উভয়ের অবদানেই আধুনিক পাঠকের মানসিকতায় ঘটে রসানুভব বা রসনিষ্পত্তি।

(ছ) সাহিত্য, আন্দোলন এবং বিবিধ সাহিত্য মতবাদভিত্তিক সমালোচনা : পাশ্চাত্যে সাহিত্য তত্ত্বের প্রায় উৎসমুখে দাঁড়িয়ে আছেন অ্যারিস্টটল। এ নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক প্রচুর হলেও তা থেকে সুস্পষ্ট নতুন কোন মতবাদ বা ‘ইজম’ স্বীকৃতি সাহিত্যে উনিশ শতকের আগে দেখা যায়নি। পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে গত শতকের তিনটি প্রধান মতবাদ সমকালীন বা পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্যিক মতবাদকে প্রভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। সেই মতবাদ তিনটি হল, কোঁতের ধ্রুববাদ, কার্ল মার্কস-এর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ। সুচিরকালের ঐতিহ্যবাহী ভাববাদী দর্শনের ওপর এই তিনটি মতবাদই প্রবল আঘাত হেনেছে। উনিশ ও বিশ শতকে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ বিভিন্ন মতবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন। এই মতবাদগুলির মধ্যে সাহিত্য-তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য উল্লেখ্য কয়েকটি মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল। অবশ্য এই মতবাদগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচিতির প্রয়োজনকে স্বীকার করেও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে এই মতবাদগুলি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর একদেশদর্শিতা ঘটে তাহলে বিচারের ক্ষেত্রে সেই বিশেষ ঝোঁক গোঁড়ামির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং ফলে সাহিত্যের শুভ্রসত্য সেই বিশেষ মতবাদের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। সার্বিক সত্যকে খুঁজতে গিয়ে আংশিক সত্যে আমরা পথহারা হই।

(১) আইডিয়ালিজম বা ভাববাদ : ভাববাদী বা আদর্শবাদী সমালোচকদের মতে জীবন সম্পর্কে সমালোচকের আদর্শবোধ থেকেই সাহিত্য বিচার করা উচিত। শিল্প-সাহিত্যে এই আইডিয়ালিজম বা আদর্শবাদের প্রচলন দীর্ঘকালের। এই মতবাদের মৌলিক সত্যগুলি হচ্ছে-শিল্প-সাহিত্যে নৈতিক আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তা স্বীকার করতে হবে, শিল্পে তার জীবনের সেই রূপই প্রতিফলিত হবে। সাহিত্যের চরিত্র-চিত্রণ যথাযথ না করে চরিত্রের আদর্শায়ন ঘটাতে হবে এবং নৈরাশ্যবাদ গ্রাস করে মানুষকে আশাবাদী করে তোলা যায়, এমনভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে।

এই নীতিতে নিজের বাঁধা ছকের মধ্যে এনে সাহিত্য বিচারের চেষ্টা করা হয়। এই বিশেষ ঝোঁকের ফলেই প্লেটো শিল্পকে আদর্শ রাষ্ট্রের বাইরে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন।

(২) মরালিজম বা নীতিবাদ : নীতিবাদী সমালোচকগণ মনে করেন সমাজের হিতার্থে সাহিত্য নীতি প্রচারে নিয়োজিত হবে। নৈতিক জীবনের ক্ষতি হয় এমন কিছু সাহিত্যে রূপায়িত হওয়া উচিত নয়, সাহিত্যে সৌন্দর্যের স্থান আছে, কিন্তু সাহিত্যে সমাজকল্যাণকর নীতির স্থান তারও ওপরে। বিষবৃক্ষের ছবি আঁকলেও ঘরে ঘরে অমৃত ফলবার অভীপ্সাই থাকবে লেখকের। এই মতবাদী লেখক এবং সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে সংকীর্ণতার পরিচয় পরিস্ফুট। সাহিত্যের মূল লক্ষ্য যে সৌন্দর্য তা এখানে গৌণ হয়ে পড়ে।

(৩) রিয়ালিজম বা বাস্তববাদ : সাহিত্যে বাস্তবতাবাদ তথা আদর্শবাদের দ্বন্দ্ব বহুদিনের এবং সাহিত্যে এদের আপেক্ষিক স্থান নিয়ে মতের অনৈক্য এখনও বহমান। কিন্তু রিয়ালিজম বা বাস্তববাদী বলতে একটা নির্দিষ্ট সাহিত্যিক আন্দোলনকেই বোঝানো হয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসি দেশে এর উদ্ভব। ‘মাদাম বোভারী’র লেখক ফ্লবেয়ার এই ধারার প্রবর্তক। চরিত্র বা ঘটনাকে অতিরঞ্জিত বা আদর্শায়িত না করে তাদের যথাযথ উপস্থাপনা এই মতবাদের বৈশিষ্ট্য। ফরাসি দেশে ভাববাদের প্রতিক্রিয়াতেই এর উদ্ভব হয়েছিল। তবে এখানেও মতবাদের আতিশয্য দৃষ্টিভঙ্গীকে সংকীর্ণ করে তুলতে পারে। সাহিত্যে বাস্তব জীবনের যথাযথ প্রতিফলন চাইতে গিয়ে সাহিত্যের বিচারে স্রষ্টার মানসিকতা বাদ দিয়ে সমালোচকগণ নিছক দেশ-কাল-পাত্রের বিচার করতে আরম্ভ করেন।

(৪) মেটিরিয়ালিস্টিক বা বস্তুবাদী সমালোচকও স্রষ্টার মনকে বাদ দিয়ে মনকে বস্তুরই বিবর্তনজাত বলে ধরে নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির বস্তুগত পরিবেশকে ধরেই সাহিত্য-বিশ্লেষণ করতে চান। এতে সাহিত্য-উপাদান বা সাহিত্য-বস্তুর বিচার হয়। সাহিত্যের বিচার হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কি আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘মানস-সুন্দরী’র বিচার করতে পারি? অথবা ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা শেলির ‘স্কাইলার্কে’র?

(৫) সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম্ বা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা : বাস্তবতাবাদের একটা প্রধান শ্রেণি রূপে ম্যাক্সিম গোর্কি এই সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। একটা বিশিষ্ট সাহিত্যিক মতবাদরূপে শীঘ্রই তা আত্মপ্রকাশ করে। এই মতবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাচীন রীতিনীতির ক্ষতিকর প্রভাবকে সমূলে উৎপাটিত করা। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বিপ্লবী সম্ভাবনার উন্নতিসাধনই এর লক্ষ্য। একদিকে কলাকৈবল্যবাদ, অপরদিকে যথাস্থিতবাদীদের বিপক্ষে ছিল এই মতবাদের বিদ্রোহ। গতিশীল বাস্তবকে উপলব্ধি করে প্রকৃষ্ট ইতিহাস চেতনার মধ্য দিয়ে এক ধরনের আশাবাদ এঁরা প্রচার করতে চেয়েছেন। এঁদের আশা এই দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বে উপন্যাসে সচেতনভাবে এই মতবাদ প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে।

(৬) ডাইডাক্‌টিজম্ (Didactism) : সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতনতা এবং সেই অনুসারে শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস নিয়েই এই মতবাদ গড়ে উঠেছে। এই মতবাদ কলাকৈবল্যবাদ নীতির বিরোধী। এই মতবাদে মনে করা হয় যে আনন্দ বা সৌন্দর্য ছাড়াও সাহিত্য সৃষ্টির অন্য উদ্দেশ্য আছে। সাহিত্যের প্রধান উদ্দেশ্য লোকশিক্ষা ও নীতিশিক্ষা, এ কথা মনে না করলেও শিল্পের পরোক্ষ উদ্দেশ্য যে এই দুইটি এ কথা এই মতবাদের সমর্থক ও সমালোচকগণ মনে করেন।

(৭) ডাডাইজম্ (Dadaism) : এই মতবাদকে অধিবাস্তবতাবাদের পূর্বাভাষ বলা চলে। এই মতবাদের উদ্ভবকাল বিশ শতকের প্রথম দিক, উদ্ভবস্থল জুরিখ। জীবনের সমস্ত রকম মূল্যবোধকে অস্বীকার করে এই মতবাদ মানুষের অবচেতন মনকে গুরুত্ব দিয়েছে সর্বাধিক। এর ফলে কাব্য রচনায় সনাতন প্রথার প্রতি বিদ্রূপ ও কাব্য রচনায় প্রবল স্বেচ্ছাচার এই মতবাদে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই মতবাদের অন্যতম প্রধান প্রচারক জুরিখের ট্রিসটান জারার একটি মন্তব্য এই ধারণাকে স্পষ্ট করবে। তিনি বলছেন, ‘একটা সংবাদপত্র নাও এবং নাও একটা কাঁচি। যে-কোন একটা লোককে বেছে নাও, তাতে কাঁচি চালাও, তারপর কাঁচি চালাও প্রতিটি শব্দের মধ্যে। খণ্ড-বিখণ্ড সবগুলো একটা ব্যাগে পুরে ফেল, ঝাকাও……?? তাহলে কি দাঁড়াল? যা দাঁড়াল, তাই ডাডাইজম্। –স্বেচ্ছাচার, অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা এবং সম্পূর্ণ নঞর্থক দর্শন নিয়ে যে ডাডাইজম্-এর উৎপত্তি তা একটা চমক সৃষ্টি করতে পারলেও সর্বাত্মক অনাস্থাজাত এই মতবাদ স্থায়ী হতে পারেনি।

(৮) সুররিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ : ডাডাইজম্ বা ডাডাবাদের আতিশয্য থেকেই সুর রিয়ালিস্ট মতবাদের উদ্ভব। বলা যেতে পারে এই মতবাদ স্বল্পস্থায়ী ডাডাইজমেরই এক বিশেষ পরিণতি। এঁদের মতে বস্তুজগৎ, মানসিক জগৎ, চেতন ও মগ্ন চেতন, অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ—এদের পরস্পরের সীমার বন্ধনকে অস্বীকার করে এমন একটি বাস্তব অতিক্রান্ত জগৎ সাহিত্যে সৃষ্টি করতে হবে যার ফলে প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর ভাষার সাহায্যে সেই প্রাকৃতের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব নয়। প্রয়োজন স্বপ্ন প্রতীকের। স্বপ্নে মনের সচেতন ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বাস্তবের যুক্তি শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। কাজেই সুররিয়ালিস্ট বা অধিবাস্তববাদী লেখক ও সমালোচক বাইরের জগতের বস্তু— অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে বস্তুর যথার্থ স্বরূপ বোঝবার চেষ্টা করেন। এই মতবাদ বস্তু ও অতিবস্তু এই উভয়কে নিয়ে প্রাধান্য দিয়েছে এক সমগ্রতা বা অভিন্নতাকে। এই মতবাদের মধ্যে তিনজন খ্যাতনামা চিন্তাবিদের তিন ধরনের নিবিষ্ট চিন্তার মিলন দেখা যায়। ফ্রয়েডের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে অবচেতন মনের রহস্য উদ্ঘাটনের কৌশল। হেগেলের কাছ থেকে সংগৃহীত হয়েছে দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের সংস্কার। আর মার্কস থেকে সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতার আবেগ। এই মতাবলম্বী সাহিত্য সৃষ্টির একজন প্রধান অংশীদার ছিলেন আঁদ্রে ঘেঁতো। কবি জীবনানন্দ দাশের কিছু কবিতায় এই মতবাদ বেশ স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত।

ডাডাইজমের মতো এখানেও হয়তো আতিশয্য এসে গেছে। কারণ যুক্তি-শৃঙ্খলার অতিক্রান্ত মনকে ধরবার সূত্রটুকু শিল্পে থাকা প্রয়োজনীয়। এই মতবাদে অভিষিক্ত সাহিত্যিক ও সমালোচকের মধ্যে যাঁরা সেই সূত্রটুকু ধরে রাখতে পারেননি, তাঁদের সঙ্গে পাঠকের হৃদ্যযোগ গড়ে উঠতে পারে না, অথচ শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা এক সঙ্গত দাবি।

(৯) ফিউচারিজম বা ভবিষ্যবাদ: সমস্ত পুরোনো প্রথাকে বর্জন করে অনাগত ভবিষ্যৎকে আহ্বান করাই এই মতবাদের মূল কথা। বিশ শতকের প্রথমে ইতালিতে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। এতে শব্দের চূড়ান্ত স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া হয়। এক বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব এই মতবাদের সার বলে মনে হয়। প্রথানুসারী বিষয় এবং আঙ্গিক, এই দুটি ক্ষেত্রেই এই মত্রবাদী শিল্পীদের অসহিষ্ণু অনাস্থা দেখা যায়। শব্দের সঙ্গে ভাবনার অনুষঙ্গজাত প্রতীকের বিচ্ছিন্নতার ফলে অঙ্কের ফরমুলা, দ্রুতলিপির সংকেত ইত্যাদি আমদানি করে সাহিত্য সমালোচনায় স্রষ্টা ও পাঠকের মৌলিক সংযোগটুকু এতে নষ্ট করে দেয়। কাব্যে ও চিত্রে এই মতবাদের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।

(১০) একপ্রেশনিজম বা প্রকাশবাদ : ফিউচারিজম-এর প্রায় সমকালেই এই একপ্রেশনিজম্ বা প্রকাশবাদের উদ্ভব হয়। এঁরাও ভবিষ্যবাদীদের মতো শব্দের যুক্তি শৃঙ্খলা ছেড়ে বস্তুর স্বরূপ সন্ধানী হলেন। ‘চিন্তা’ ও ‘চিন্তার প্রকাশ’, সাহিত্যে ফর্ম ও কনটেস্টের মধ্যে যোগকে অস্বীকার করা হল। সাংকেতিক রীতিকে এঁরা শিল্পে সর্বাধিক মর্যাদা দিয়েছেন। যে-কোনো ভাব সংকেতের সাহায্যেই ভালোভাবে ব্যক্ত হতে পারে এবং সংকেতের সাহায্যেই তা পাঠক ও দর্শক মনে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, এই হচ্ছে এঁদের ধারণা ও বিশ্বাস। কাব্যে এবং চিত্রে এই রীতিকেই এঁরা অনুসরণ করবার চেষ্টা করেছেন।

(১১) এক্‌জিস্টেনশিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদ: এই মতবাদের উদ্ভব উনিশ শতক। এই মতবাদ আত্মবাদী (Subjective) নিশ্চয়ই কিন্তু ভাববাদের দিকেই এর প্রবণতা বেশি। এই মতবাদে বিশ্বাসী লেখক ও সমালোচকগণ মানুষের অস্তিত্বের কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাস করেন না। মানুষ শুধু সত্তায় আছে ও আবর্তিত হচ্ছে (being and becoming)। এই অস্তিত্ববাদের প্রবক্তাদের মধ্যে যাঁরা ঈশ্বরবাদী, তাঁরা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মকে ঈশ্বরমুখী করতে চান। আর শোপেন হাওয়ারের ভাবশিষ্য নীৎসে এবং জাঁ পল সাত্রের মতো যাঁরা নাস্তিক যাঁরা ঈশ্বরকে মৃত বলেছেন এবং না-ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছেন তাঁরা দুঃখভোগের মধ্যেও মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা আছে বলে বিশ্বাস করেন। —শিল্প ও সাহিত্যের মধ্যে অস্তিত্ব সর্বস্ব মানুষের শুধু যে দুঃখভোগ আছে, তাই নয়, দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কালান্তরে অগ্রসর হবার স্বপ্নও আছে। এই উপলব্ধিই শিল্পী ও সমালোচক উভয়েরই থাকা দরকার। যে সাহিত্য মানুষকে শুধু যন্ত্রণার সীমাতেই বন্ধ করে রাখে তাতে আত্মসমর্পণ না করে তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা যে শিল্পে আছে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়াই শিল্পী, লেখক ও সমালোচকদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

(১২) ইম্প্রেশনিজম বা অতিবাস্তববাদ: বাস্তবতাবাদী আন্দোলনের পরিণতি রূপ এই অতিবাস্তববাদ। পরবর্তীকালে এক দৃঢ় মতবাদ হিসেবে এই অতিবাস্তববাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বস্তুর যথাযথ রূপ এই মতবাদে বিশ্বাসী লেখক বা সমালোচকগণ সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে পরিবর্তমান বিষয়ের উপলব্ধিই এঁদের কাছে ছিল অধিক তাৎপর্যপূর্ণ, মূলত বাস্তববাদী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হয়েও বস্তুর পরিবর্তে বস্তু ধর্মের সন্ধান ছিল এঁদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

(১৩) হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ : বিভিন্ন কালে বিভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে এই হিউম্যানিজম আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে এবং সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। এই মতবাদে সাহিত্যে মানুষই পেয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব। এই মতবাদে মানুষই শেষ কথা, তা ছাড়া আর কিছু স্বীকার করা অর্থহীন। মানুষের জীবন, তার কর্মময়তা এবং ধর্ম—এ সবের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ শতকে এই আন্দোলনই নিও-হিউম্যানিজম (Neo Humanism) এই অভিধা পায়। এই নতুন মতবাদে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মূল্য ও জীবনের স্বাধীন ইচ্ছা স্বীকার করা হয়েছে, তার সঙ্গে স্বীকার করা হয়েছে সত্য-শিব-সুন্দরের সনাতন মর্যাদা। একে সূত্র ধরেই এরপরের ধাপে এসেছে র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজম (Radical Humanism)। ভারতবর্ষে এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন মানবেন্দ্র নাথ রায়।

(১৪) কিউবো-ফিউচারিজম : এই মতবাদের সমর্থকগণ সাধারণত কিউবিস্ট নামেই পরিচিত। বিশ শতকের প্রথম দিকে রাশিয়ায় এই মতবাদের উদ্ভব ঘটে। এই কিউবিস্টগণ প্রচলিত রীতি-নীতিও যেমন মানেন না, তেমনি প্রচলিত ভাব ও ভাষাকে অস্বীকার করার একটা খেয়াল এঁদের মধ্যে দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে এঁদের রীতি-নীতি কিছুটা উদ্ভট মনে হলেও এঁরা সত্যের রূপাতীত স্বরূপকে ধরবার চেষ্টা করেন।

(১৫) ইমেজিজম : সাহিত্যে পূর্বে যে সাংকেতিক আন্দোলন দেখা গিয়েছে, এই ইমেজিজম্ আন্দোলন তারই একটা নতুন দিক। এঁরা ইমেজ বা প্রতিরূপকে ভাবের বাহন হিসেবে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। সামান্য বচনকে আঙ্গিকের দিক থেকে যথাসম্ভব বর্জন করার চেষ্টা এরা করেছিলেন। এজরা পাউন্ড প্রভৃতির রচনায় এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটে।

(১৬) রিজিওনালিজম বা আঞ্চলিকতাবাদ : বাস্তব শিল্পানুকৃতির ফলে এক বিশেষ ধরনের প্রবণতা থেকে রিজিওনালিজম্ বা আঞ্চলিকতাবাদের জন্ম হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অঞ্চলের বা প্রদেশের মানুষের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভাষা, লোকব্যবহার, সেই বিশেষ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রভৃতি উপস্থাপিত করাই এই বিশিষ্ট আঞ্চলিকতাবাদী মতবাদের দাবি এবং শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই দাবি পুরণ করা এঁরা কর্তব্য বলে মনে করেন।

(১৭) ট্র্যানসেনডেন্টালিজম বা তুরীয়বাদ: এই মতবাদের প্রধান কথা ঈশ্বরের অস্তিত্বে ও দিব্য অনুভূতিতে গভীর বিশ্বাস। এককথায় বলতে গেলে বলা যায় এইটি বাস্তবতা অতিক্রমী এক ধরনের ভাববাদ, এই মতবাদে বিশ্বাসীগণ পারমার্থিক সত্তাতে গভীর আস্থা জ্ঞাপন করে বাস্তবের কঠিনতা পরিহার করেন। সাহিত্যে এই মতবাদের স্বাক্ষর ইউরোপের উনিশ শতকের এমার্সন ও বিশ শতকের গ্রে-র মধ্যে পাওয়া যায়। ভারতে তথা বাংলাদেশেও আধ্যাত্মবাদী সাহিত্যিকদের রচনায় এই ভাবনার বিশেষ চিহ্ন পরিস্ফুটিত।

(১৮) সিম্বলিজম বা প্রতীকীবাদ : এই মতবাদীদের কথায় শিল্পে ও সাহিত্যে ভাবই প্রধান কথা। রূপের পৃথক কোন মর্যাদা নেই—রূপ ভাবের সংকেত ছাড়া কিছুই নয়। উনিশ শতকের শেষে ইউরোপে সাহিত্যে এই মতবাদের উদ্ভব হয়। যাঁরা এই মতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা মনে করেন বস্তু-সত্য, এমনকি চিন্তা-সত্যকেও প্রকাশ করার জন্য ‘শব্দ’ ব্যবহার করা উচিত নয়। শব্দের ব্যবহারের একমাত্র তাৎপর্য হতে পারে মানসিক অবস্থাকে ব্যক্ত করে। শিল্প ও সাহিত্যে এই মতবাদ দ্রুত প্রসার লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের কিছু নাটকে এই ভাবনার স্বাক্ষর দেখতে পাই।

সাহিত্য-তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় নানা বৌদ্ধিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে যে নানা-মতের জটিল অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে বিশিষ্ট কিছু মতবাদীদের বক্তব্যের এখানে সংক্ষেপিত উল্লেখ করা হল। সাহিত্য সমালোচনায় এইসব মতবাদীদের অধিকাংশেরই উদ্ভব উনিশ ও বিশ শতকে। এর বাইরেও বিভিন্ন মতবাদ ডালপালা ছড়িয়ে আছে এবং যেহেতু মানুষের বৌদ্ধিক ভাবনার প্রবাহ এখনও বর্তমান, তাই যার শেষ নাই তার শেষ কথা কে বলবে?

সাহিত্যে সমালোচনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীজাত মতবাদগত যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনটাই যেমন শেষ কথা নয়, তেমনি সবারই কিছু কিছু মূল্য আছে। আর এই সবকে মিলিয়েই হয়তো গড়ে উঠছে সাহিত্য বিচারের অখণ্ড দর্শন।

কিন্তু এর পরেও কথা আছে। সাহিত্য বিচারে পদ্ধতিগত এবং মতবাদগত এই যে নানা ক্রম বা নানা ভাবনা সমালোচকগণের সাহিত্য বিচারে এরা ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি হলেও, শুধুমাত্র এই মাপকাঠির পুথিগত বিদ্যা নিয়ে, ব্যবসাদারী সমালোচনার মানসিকতা নিয়ে সাহিত্যের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা যায় না। যায় না। সাহিত্য-সত্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন। এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যকে সশ্রদ্ধায় স্মরণযোগ্য। তিনি বলছেন, ‘যেমন সাহিত্যের স্বাধীন রচনায় এক একজনের প্রতিভা সর্বকালের প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করে সর্বকালের আসন অধিকার করে, তেমনি সমালোচকের প্রতিভাও আছে। এক একজনের পরখ করবার শক্তিও স্বভাবতঃই অসামান্য হইয়া থাকে। যাহা ক্ষণিক, যাহা সংকীর্ণ, তাহা তাহাদিগকে ফাঁকি দিতে পারে না। যাহা ধ্রুব, যাহা চিরন্তন, এক মুহূর্তেই তাহা তাঁহারা চিনিতে পারেন। সাহিত্যের নিত্যবস্তুর সহিত পরিচয় লাভ করিয়া নিত্যত্বের লক্ষণগুলি তাঁহার জ্ঞাতসারে এবং অলক্ষ্যে অন্তঃকরণের সহিত মিলাইয়া লইয়াছেন—স্বভাব ও শিক্ষায় তাঁহারা সর্বকালীন বিচারকের পদ গ্রহণ করবার যোগ্য।’

সমালোচনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার সমালোচনা পদ্ধতি ও মতবাদ জানার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সত্যকার সমালোচনায় সর্বোপরি প্রয়োজন আছে সমালোচকের সহৃদয় হৃদয় সম্বাদী প্রতিভা। আর সেইখানেই সাহিত্য সমালোচনায় সত্যকারের মূল্য।