প্রশ্নঃ সমালােচনাসহ ডেকার্টের বুদ্ধিবাদ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা দর্শনে বিরাট স্থান দখল করে আছে। জ্ঞান-বিদ্যার যে প্রধান তিনটি শাখা রয়েছে বুদ্ধিবাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাপার হিসেবে বুদ্ধিবদের ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীন কালের সক্রেটিস, প্লেটো, আধুনিককালে ডেকার্ট, স্পিনােজা, লাইনিজ, ভঙ্গ ইত্যাদি বিখ্যাত মনীষীরা হলেন বুদ্ধিবাদের সমর্থক বা প্রবক্তা। পদ্ধতিগত আলােচনার ক্ষেত্রে ডেকার্টের গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ।
ডেকার্টের বুদ্ধিবাদঃ ফরাসি দার্শনিক রেনে ডেকার্টকে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয়। জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি ইন্দ্রিয় প্রাধান্যকে অস্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা সঠিক জ্ঞান পেতে পারি না। কারণ একে সন্দেহ করা যায়। তিনি সব কিছুর পাশাপাশি নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহ করা শুরু করলেন। পরবর্তীতে তিনি দেখলেন যে, সবকিছুকে সন্দেহ করা গেলেও নিজ অস্তিত্বকে সন্দেহ করা যায় না। কারণ নিজ অস্তিত্বকে সন্দেহ করার মত আর পাত্র থাকে না। সে কারণে তিনি বলেছেন যে, I think therefore I am. অর্থাৎ আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি। ডেকার্ট তার দার্শনিক আলােচনার ক্ষেত্রে গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করেন। ডেকার্ট তার মতবাদকে ব্যাখ্যা করার জন্য কতকগুলাে ধারণার কথা বলেছেন। যথাঃ
(ক) আগম্ভক ধারণাঃ যে সকল ধারণা বাইরে থেকে আমাদের মনে আসে বা আশ্রয় নেয় সে সকল ধারণাকে আগন্তুক ধারণা বলা হয়। যেমন পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ইত্যাদি হলাে আগন্তুক ধারণা।
(খ) কৃত্রিম ধারণাঃ যে সকল ধারণা আমাদের মন দ্বারা তৈরি হয় সে সকল ধারণাকে কৃত্রিম ধারণা বলে। যেমনঃ সােনার পাহাড়, সােনার হরিণ ইত্যাদি।
(গ) সহজাত ধারণাঃ সহজাত ধারণা বলতে বােঝায় এমন সব ধারণা যে জ্ঞান জন্মের সময় আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকি সেগুলাে। এ সকল জ্ঞান সর্বদা সুনিশ্চিত, সুনির্দিষ্ট ও প্রাঞ্জল হয়ে থাকে। একমাত্র সুনিশ্চিত জ্ঞান আমরা পেয়ে থাকি বুদ্ধির মাধ্যমে। সহজাত ধারণার মাধ্যমে জ্ঞান আমাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং পরবর্তীতে বুদ্ধির সাহায্যে তা প্রকাশিত হয়। কার্যকারণ সম্পর্ক, অসীমতা, বিস্তৃতি ইত্যাদি হলাে সহজাত ধারণার উদাহরণ।
ডেকার্টের বুদ্ধিবাদের সমালােচনাঃ নিম্নে ডেকার্টের বুদ্ধিবাদের সমালােচনা ব্যাখ্যা করা হলাে-
প্রথমত, ডেকার্ট বুদ্ধিবাদে অবরােহ পদ্ধতির আলােকপাত করেছেন। কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। কেননা, গাণিতিক জ্ঞান হলাে বিমূর্ত, অন্যদিকে দর্শন মূর্ত বিষয় নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, ডেকার্ট তার মতবাদকে গুরুত্বারােপ করে অভিজ্ঞতাবাদকে চরম অবহেলা করেছেন। তিনি বলেন যে, অভিজ্ঞতাবাদ কখনাে সঠিক জ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদকে অবহেলা করার কোনাে স্থান নেই।
তৃতীয়ত, ডেকার্ট তা দর্শনে বলেছেন যে, ‘আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি’ এ চিন্তন কোনাে নতুন আশার আলাে দেখাতে পারে না।
চতুর্থত, ডেকার্ট অস্তিত্ব নিয়ে যে আলােচনা করেছেন তা মােটেও যুক্তিসংগত নয়। কারণ এভাবে অন্যান্য বিষয়, যেমন- কথা বলা, খেলা করা ইত্যাদি থেকে আমাদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যেত।
পঞ্চমত, ডেকার্ট ধারণা সম্পর্কে যে বক্তব্য করেছেন সে মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ডেকার্টের বুদ্ধিবাদ নানাভাবে সমালােচনা হওয়া সত্ত্বেও দর্শনের ইতিহাসে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি দর্শনে অবরােহ বা গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। সে কারণে তাকে আধুনিক বুদ্ধিবাদের জনক বলা হয়।
Leave a comment