সমাজ প্রকরণ কী? মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজ প্রকরণের ধারাসমূহ আলোচনা কর


প্রশ্নঃ সমাজ প্রকরণ কী? মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজ প্রকরণের ধারাসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সমাজ প্রকরণ বলতে কী বুঝ? মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজ প্রকরণের পর্যায়সমূহ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ বসবাস করে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই তাদের বসবাস নির্ভর করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করলেও তাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। আর এ বৈচিত্র্যের রূপগুলো পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মাধ্যমে। সমাজকে কেন্দ্র করে মানুষের বসতি একটা সমাজ থেকে অন্য সমাজের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরে।

সমাজঃ সমাজ হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠী যারা একটি সাধারণ ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবন প্রণালীতে অভ্যস্থ হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে। এককথায় কতিপয় সাধারণ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংগঠিত জন সমষ্টিই হলো সমাজ। আর এ কারণেই সমাজের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক সম্পর্কের জাল সৃষ্টি হয়।

সমাজ প্রকরণঃ সাধারণত সমাজ বলতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝায়। যখন কিছু লোক একই মনোভাব সম্পন্ন চেতনা ও সমজাতীয় লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয় তখন সমাজের মৌলিক কার্যাবলির উদ্দেশ্যগুলো সাধিত হয়। তবে সমাজের মধ্যে এ প্রকরণ ভিন্ন মাত্রা আনে। মূলত সমাজ প্রকরণ হলো কতকগুলো সমাজের বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টি। সমাজ প্রকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন মত উপস্থাপন করেন।

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ বিকাশের প্রকরণঃ সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং এ পরিবর্তন সাধিত হয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে। মার্কস বলেন, প্রযুক্তি মানব ইতিহাসের পর্যায় সম্পর্কে নির্দেশ করে। যেখানে সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিকের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে কার্ল মার্কস তার “Critique of political Economy” গ্রন্থে, সমাজকে ৫টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ (২) দাস সমাজ (৩) সামন্ত সমাজ (৪) পুঁজিবাদী সমাজ এবং (৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। নিম্নে সমাজ বিকাশের প্রকরণসমূহ তুলে ধরা হলো-

(১) আদিম সাম্যবাদী সমাজঃ মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আদিম সাম্যবাদী সমাজ হলো সমাজ বিকাশের প্রথম স্তর। এ স্তরে সমাজের মধ্যে কোনো বৈষম্য ছিল না। সমজের মধ্যে সাম্য ও সংহতি বজায় ছিল। আর এ কারণেই তখনকার জীবন ছিল সহযোগিতাপূর্ণ এবং সামাজের সকল সদস্য ছিল এক শ্রেণির অন্তর্গত। আদিম সাম্যবাদী সমাজের মানুষ সঞ্চয় করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। তারা মূলত খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। এ সমাজের মধ্যে সামাজিক সংঘাতও ছিল না বরং সেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতাবোধ বিদ্যমান ছিল। আর সমাজে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সাম্য অবস্থা বিরাজ করত বলে সে সমাজকে আদিম সাম্যবাদী সমাজ বলা হয়েছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজের কতকগুলো ধাপ পাওয়া যায়। যথাঃ

(ক) শিকার ও সংগ্রহ সমাজঃ মার্কস এ সমাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, শিকার ও সংগ্রহ সমাজের কৌশল ছিল অতি নিম্ন মানের। এসব হাতিয়ার নির্মিত হতো কাঠ, পাথর, হাড় এবং অন্যান্য গাছের থেকে। এ সমাজের মানুষ খাদ্যের প্রাচুর্যের সময় ভূরিভোজ করত, আবার খাদ্যের সংকটে উপবাস করত। সমাজের মানুষের খাদ্যর উৎস ছিল ভিন্ন ধরনের। জীবনযাত্রার প্রয়োজন অনুভব করে তারা শিকার ও সংগ্রহের কাজে লিপ্ত থাকত।

(খ) উদ্যান চাষ সমাজঃ মার্কসের মতে, আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে থেকে মানুষ গাছ লাগাতে শেখে। মানুষ গাছ লাগানো শেখার অনেক পর উদ্যান চাষ নির্ভর সমাজ গড়ে তোলে। প্রথম দিকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকভাবে উদ্যান চাষমূলক সমাজ ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছিল। পরবর্তীকালে দ্বীপ সমাজ ব্যবস্থাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।

(গ) পশুচারণ সমাজঃ মানবসমাজের দ্বিতীয় পর্যায় হলো পশুচারণ সমাজ। মানুষ প্রথমে পাথরের হাতিয়ার দিয়ে জীবজন্তু ও পশুপাখি শিকার করে তাদেরকে পোষ মানাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা পোষমানা জীব-জন্তুদের পুষতে থাকে। এ পর্যায়ে তাদের জীবনে যে পরিবর্তন আসে তা হলো – পশুচারণের জন্য তাদেরকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিচরণ করতে হতো। ক্রমান্বয়ে তারা তাদের গৃহপালিত পশুগুলোকে কৃষি কাজে ব্যবহার করতে থাকে।

(ঘ) কৃষি সমাজঃ পশুচারণ ও শিকার অর্থনীতির ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে মানব সমাজ কৃষি সমাজের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রথমে মানুষ উদ্যান কৃষির সূচনা করে। তারা তখন বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন বাগানে ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন করে। এরপর নদী তীরবর্তী পলিসমৃদ্ধ এলাকায় কৃষি কাজ শুরু হয় । কৃষি পর্যায়ে এসে মানবসমাজ একটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। এখানে তাদের জীবনপ্রণালিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এখানে ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি হয়। কৃষিজ পেশায় নিয়োজিত লোক তৈরি হয়। এখান থেকেই ভূমিদাস, কৃষক শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়।

(ঙ) শিল্প সমাজঃ মার্কসের মতে, সমাজ বিকাশের সর্বশেষ ধাপ হলো শিল্প সমাজ। শিল্প সমাজের যাত্রা শুরু হয় কৃষি সমাজকে কেন্দ্র করে। শিল্প সমাজ কৃষি সমাজ থেকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত। এ সমাজের উদ্ভবের ফলেই আদিম সাম্যবাদী সমাজের বিলোপ ঘটে। মানুষের বুদ্ধি বিকাশের সাথে সাথে ক্রমশ প্রযুক্তিতেও পরিবর্তন আসে। আর এ পরিবর্তন উৎপাদন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে ভিন্ন ধারণা জন্ম দেয়। ফলে আদিম সাম্যবাদী সমাজের নতুন রূপ পরিলক্ষিত হয় দাস সমাজের মধ্যে।

(২) দাস সমাজঃ শ্রেণিভিত্তিক সমাজের প্রাথমিক রূপ হলো দাস সমাজ। কৃষি সমাজের প্রসারের ফলে ভূমি দখলের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এতে সংঘর্ষ দেখা দেয়। সমাজে আসে দাসপ্রথা। আদিম সমাজের সাম্যবাদী মনোভাবের ক্ষেত্রে আসে শ্রেণি বৈষম্য। সমাজে সৃষ্টি হয় দাস ও দাস-মালিক শ্রেণি। দাসদেরকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধবন্দি এবং ঋণগ্রস্তদেরও দাসে পরিণত করা হয়। দাসের সন্তানও জন্মগতভাবে দাস। মার্ক্সের মতে, জমিতে ব্যক্তি মালিকানা সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়েই সমাজে শ্রেণি বৈষম্য শুরু হয়।

(৩) সামন্ত সমাজঃ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ্ হচ্ছে ইউরোপের মধ্যযুগের এক বিশেষ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা। ভূমিকে কেন্দ্র করে এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজে যিনি জমির মালিক তিনিই সামন্ত প্রভু। জমিতে যারা কাজ করতো তারা ক্রীতদাসদের চেয়ে কিছুটা স্বাধীন ছিল। তাদেরকে বলা হতো ভূমিদাস। সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভুদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য বণিক শ্রেণি কুটির শিল্প গড়ে তোলে। এখান থেকেই নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে। সামন্ত প্রভুরা আরামে আয়েসে অলসভাবে দিন কাটাতে থাকে। জমির উৎপাদিত ফসলই ছিল তাদের আয়ের প্রধান উৎস।

(৪) পুঁজিবাদী সমাজঃ মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদী সমাজ হচ্ছে সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামন্ত প্রভুদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বণিক শ্রেণি সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এ সমাজে যারা সম্পদের মালিক তারা হলো পুঁজিপতি। আর যাদের কোনো সম্পদ নেই তারা সর্বহারা। তাই এ সমাজ ছিল দু’টো শ্রেণিতে বিভক্ত। যথাঃ (ক) উৎপাদন যন্ত্রের মালিক শ্রেণি (খ) সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি।

(৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজঃ পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণি শোষণের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির মাধ্যমে সমাজে গড়ে ওঠে আর একটি নতুন সমাজ- সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এখানে কোনো ব্যক্তি মালিকানা থাকে না। এই সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজে বৈষম্যহীন সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী মর্গান সমাজ বিকাশের পর্যায়কে বন্য দশা, বর্বর দশা ও সভ্য দশা এই তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। তিনি আবার বন্য দশা ও বর্বর দশাকে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ এই তিনটি উপপর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। 

সমালোচিত দিকঃ মার্কসের সমাজ বিকাশের ধারাগুলো বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনাগুলো তুলে ধরা হলো-

প্রথমতঃ মার্কস প্রাচীন অর্থনৈতিক সমাজের কোনো শ্রেণিবিন্যাস করেন নি। অথচ পুঁজিবাদীরা বলে কোনো সমাজই স্তরায়ণ বিহীন নয়।

দ্বিতীয়তঃ শুধুমাত্র অর্থনেতিক কারণ নয় বরং রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি কারণও সমাজ পরিবর্তনের পেছনে কাজ করে।

তৃতীয়তঃ উৎপাদিকা শক্তি বাড়ার সাথে সাথে শ্রমিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অনেকেই এ ধারণার বিপক্ষে।

চতুর্থতঃ পুঁজিপতি শ্রেণির ক্রমবিকাশ ও শ্রমিক শ্রেণির ক্রমাবনতির চিত্রগুলো অনেকাংশে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিকাশের যে ধারা প্রকাশ পায় তা অনেকাংশে সঠিক মনে হলেও বিতর্কের ইস্যুগুলো সুস্পষ্ট। মানবসমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সমাজের যে বিবরণ দেয়া হয়েছে তা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সত্য বলে মনে হলেও মার্কসের সাম্যবাদী সমাজ এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।