ভারতবর্ষে যেসব প্রগতিশীল চিন্তানায়কেরা সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য এবং মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ গড়ে তােলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা রামমােহন রায়।ধর্মসংস্কার থেকে শুরু করে সমাজসংস্কার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করা, সহমরণ বর্জন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কারে তাঁর অবদান নীচে আলােচনা করা হল一

সমাজসংস্কারমূলক কাজ: রামমােহন বাংলা দেশে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এবং লর্ড বেন্টিঙ্কের সদিচ্ছায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। রামমােহন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা ছাড়াও বহুবিবাহ প্রথা বন্ধের জন্য এবং পণপ্রথা প্রতিরােধ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।

রামমােহন হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। উপনিষদের মূলকথা তুলে ধরার জন্য তিনি ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামমােহন বহু দেবদেবীতে এবং পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না, তাই তিনি একেশ্বরবাদ প্রচারে ব্রতী হন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ম্বর, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল। তিনি ধর্মবিরােধ দূর করার জন্য তুলনামূলক ধর্মের প্রবর্তন করেন। সর্বোপরি, ধর্মসংস্কারের। জন্য তিনি। পত্রপত্রিকা প্রকাশ, আলােচনাসভা স্থাপন এবং বিদ্যালয় স্থাপনেও সচেষ্ট হয়েছিলেন।

শিক্ষাসংস্কার: শিক্ষাক্ষেত্রে রামমােহন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট ভাবধারাকে গ্রহণ করে তার পুনরুজ্জীবন ঘটানাে এবং বাংলা ভাষার উন্নতিসাধন করার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষের যুক্তিবাদী মনের যথাযথ বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, দর্শন প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে তিনি ভারতীয় জনগণকে আধুনিকমনস্ক হতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন সংস্কৃত, আরবি বা ফারসি ভাষার মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষার্থীদের উন্নতি অসম্ভব|তাই তিনি বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব দেন। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়গুলির মধ্যে বিজ্ঞান, গণিত এবং রসায়নশাস্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। 1822 খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইঙ্গ-বৈদিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং যন্ত্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেন।

সাহিত্যে অবদান: শিক্ষার উন্নতির জন্য কেবল বিদ্যালয়‌ প্রতিষ্ঠা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, দেশীয় ছাত্রদের জন্য পুস্তক রচনায় নিজেকে নিয়ােগ করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় ভূগােল, ব্যাকরণ এবং জ্যোতির্বিদ্যার বই লেখেন। 1815 থেকে 1830 খিস্টাব্দের মধ্যে তিনি প্রায় ত্রিশটি। পুস্তক রচনা করেন, একাধিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ এবং প্রবন্ধ রচনা করেন।

স্ত্রীশিক্ষা প্রসার: স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও রামমােহনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 1822 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের ওপর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য নামক একটি বই লেখেন। এতে মহিলাদের আইনানুগ নানান অধিকার এবং তাদের শিক্ষাদানের জন্য দাবি করা হয়। এই বইতে তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করে দেখান যে অতি প্রাচীনকালেও নারীশিক্ষার প্রচলন ছিল এবং তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা পেতেন।

ওপরের সংক্ষিপ্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রাজা রামমােহন রায় ভারতীয় ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ের সংস্কারের ক্ষেত্রে ছিলেন একজন আদর্শ পথিকৃৎ।