হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিওর নেতৃত্বে তার অনুগামী (ডিরােজিয়ান)রা অর্থাৎ নব্যবঙ্গ গােষ্ঠী বা ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্যরা সমাজসংস্কারে উদ্যোগী হয়।

[1] সমাজের রক্ষণশীলতার বিরােধিতা: ডিরােজিওর নেতৃত্বে ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্যরা সমাজের রক্ষণশীলতার বিরােধিতা করেন। আবেগপ্রবণ হয়ে তাঁরা প্রথাগত ধর্মবিশ্বাস বা খাদ্যাভাসের বিরােধিতা করেন। তাই ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিনে তাদের সম্পর্কে লেখা হয় তারা শূকর ও গােরুর মাংসের মধ্য দিয়ে নিজেদের পথ করে নেয় এবং তাদের উদারনীতিবাদ পৌঁছায় বিয়ারের পাত্রে। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় কোনাে ব্রাক্ষ্মণ দেখতে পেলেই এই গােষ্ঠীর সদস্যরা চেঁচিয়ে বলতেন তাঁরা গাে-মাংস খান। কালীঘাটে দেবীর মূর্তির উদ্দেশ্য তাঁরা বলতেন ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম’। তাই সে সময়কার কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ তাদেরকে নাস্তিক আখ্যা দেয় এবং ডিরােজিওকে ‘ভবঘুরে ফিরিঙ্গি’ বলে সমালােচনা করে। ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠির সদস্য রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রকাশ্য আদালতে চেঁচিয়ে বলেন যে, তিনি গঙ্গা নদীর পবিত্রতায় বিশ্বাস করেন না।

[2] কুসংস্কারের বিরোধিতা: ডিরােজিও ও তার অনুগামীরা সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হন। সতীদাহপ্রথা রদ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁরা আধুনিক মনের পরিচয় দেন। বিদ্যাসাগরের আগেই তারা বিধবাবিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রচার চালাতেন। বাল্যবিবাহ, কুলীন প্রথা, বহুবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তারা জনমত গড়ে তােলার চেষ্টা চালান। ডিরােজিয়ানরা ভলতেয়ার, হিউম, লক, টম পেইনের রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলির সমালােচনা শুরু করেন। ‘পার্থেনান’ পত্রিকায় এই গােষ্ঠীর সদস্যরা সামাজিক কুসংস্কারগুলির তীব্র সমালােচনা করে লেখালেখি শুরু করেন। ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্য কৃষ়মােহন বন্দোপাধ্যায় ‘দি এনকুয়েরার’ পত্রিকাতে হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরােধিতা করে লেখা প্রকাশ করেন। ‘দি এনকুয়েরার’ পত্রিকায় নব্যবঙ্গ গােষ্ঠীর তরফ থেকে লেখা হয়। “হৈ চৈ এবং বিভ্রান্তি ছাড়া কোনাে মানুষের সংস্কার সাধন সম্ভব নয়।… আমরা সেই দায়িত্বই গ্রহণ করেছি।”

[3] সমাজে যুক্তিবাদের বীজ বপন: ভারতীয় সমাজকে যুক্তিবাদের পথে পরিচালনার প্রথম কৃতিত্ব প্রাপ্য ডিরােজিও ও তাঁর অনুগামীদের। টম পেইনের এজ অব রিজন গ্রন্থ পাঠে অনুপ্রাণিত হয়ে ডিরােজিয়ানরা হিন্দু সমাজে যুক্তিবাদের বীজ বপন শুরু করেন। এঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘জ্ঞানাম্বেষণ’, ‘দি এনকুয়েরার’, ‘দ্য বেঙ্গল স্পেকটেটর’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা দেশবাসীর মনে যুক্তিবাদ বিস্তারে ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য নব্যবঙ্গীয়রা জ্ঞানার্জনী সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এককথায়, বাংলা তথা ভারতের ভাবজগতের পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে এঁদের অবদান নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য। নব্যবঙ্গীয় সদস্য রামগােপাল ঘােষ বলেন- “যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে না সে একজন গোঁড়া, যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না সে একজন নির্বোধ, এবং যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয় না সে একজন ক্রীতদাস।”

[4] বিভিন্ন বৈষম্যের বিরােধিতা: তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন বৈষম্যের অবসানে ডিরােজিয়ান বা নব্যবঙ্গীয়রা সরব হয়েছিলেন। নারী পুরুষের বৈষম্য, বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইউরােপীয়দের বিচার বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত এমনকি পুলিশি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্রিটিশের বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইয়ংবেঙ্গল সদস্যগণ।

[1] উপযুক্ত কর্মসূচীর অভাব: বৃহত্তর সমাজকে নিজেদের চিন্তায় প্রভাবিত করার মতাে কর্মসূচি ডিরােজিয়ানদের ছিল না। এঁদের অতি উচ্ছাস হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ ও আতঙ্কের সঞ্চার করে। তাই সমাজের প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল কোনাে অংশই এঁদের আচরণ মেনে নেয়নি। ডিরােজিয়ানদের তাই অনেকেই উচ্ছঙ্খল, কালাপাহাড়, সমাজ-বিচ্ছিন্ন উগ্র গােষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়।

[2] অধিক উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ: ডিরােজিয়ানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ অত্যন্ত বেশি ছিল। তাদের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব ছিল। সমাজে দ্রুত প্রতিষ্ঠালাভের তাগিদে এবং রক্ষণশীল গােষ্ঠীর বিরােধিতায় তারা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। অপরিণত বয়সি ডিরােজিয়ানরা তারুণ্যে ও ভাবাবেগে বাংলার সমাজজীবনে আলােড়ন তুললেও স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি।

[3] নগরকেন্দ্রিকতা: নব্যবঙ্গ দলের ক্রিয়াকলাপ কয়েকজন ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

[4] শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা: দেশের জনসংখ্যার মূল অংশ অর্থাৎ কৃষকশ্রেণির সমস্যা ও তার সমাধানে এঁরা অনাগ্রহী ছিলেন। ফলে কৃষকশ্রেণিও এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে দেশীয় কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটলে শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকার সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিল।

[5] সমাজের অভিজাতদের বিরােধিতা: হিন্দু সমাজের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার কোনাে চেষ্টা না করে, সবকিছু না জেনেই তার বিরােধিতা করার ফলে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ই নব্যবঙ্গীয়দের বিরুদ্ধে চলে যায়। বিশেষত, সমাজের অভিজাত ও রক্ষণশীল গােষ্ঠী জিরােজিয়ানদের তীব্র বিরােধিতা করেন। আসলে সমাজে নানা কুসংস্কার ও সমস্যা নিয়ে তারা যতটা সরব হয়েছিলেন সেগুলি সমাধানের ব্যাপারে ততটাই নীরব ছিলেন।

[6] মুসলিমদের অনাগ্রহ: মুসলিম সমাজের সংস্কার নিয়ে ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর কোনাে চিন্তাভাবনা ছিল না। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। ফলে সমাজের একটা বৃহৎ অংশই এই আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

[7] ধারাবাহিক নেতৃত্বের অভাব: ডিরােজিওর পর উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠীর অনেকেই আন্দোলন থেকে সরে আসেন। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যবসায় মনােযােগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃয় মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গােবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টার এবং কিশােরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।