অথবা, “সমাজের বৈজ্ঞানিক পঠনই হলাে সমাজবিজ্ঞান” আলােচনা কর।
অথবা, “সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন”- আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয় পাশ্চাত্যের শিল্পবিপ্লব এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের যুগে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম ‘Sociology’ শব্দটি ব্যবহার করে সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতাে সমাজবিজ্ঞান সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির আলােকে সমাজকে গবেষণা করে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করেছে।
ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তিঃ প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী লেস্টার ফ্রাঙ্ক ওয়ার্ড এবং উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজের বিজ্ঞান।’ (Sociology is the science of society)। এই সংজ্ঞাটি আকৃতির দিকে দিয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও অর্থগত দিক দিয়ে ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তির ব্যাখ্যাঃ ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে এতে দু’টি প্রত্যয় পাওয়া যায়। এগুলাে হলাে Science এবং Society. নিম্নে প্রত্যয় দুটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলাে:
(১) বিজ্ঞান (Science): সহজ কথায় আমরা বলতে পারি, কোনাে বিষয় সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানই হলাে বিজ্ঞান। পরীক্ষা, প্রমাণ, যুক্তি উত্যদি দ্বারা নির্ণীত সুশৃঙ্খল জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান। অনেকে বলেছেন সুসংবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান। পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের যাচাইয়ের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয়।
‘The oxford Dictionary’-তে বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, গবেষণালব্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান। অতএব বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি, যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের ভিত্তিতে অর্জিত সুসংহত জ্ঞানই বিজ্ঞান।
(২) সমাজ (Society): সহজ কথায় আমরা বলতে পারি, সমাজ হলাে একদল লােকের সমষ্টি যারা একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ তাদের ‘Society’ গ্রন্থে বলেন, ‘Society is the system of social relationship in and through which we live’ অর্থাৎ আমরা যেসব সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনধারণ করি তাদের সংগঠিত রূপই হলাে সমাজ।
ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তির যথার্থতা ও তাৎপর্যঃ সমাজবিজ্ঞানী ওয়ার্ড ও সামনার ‘সমাজবিজ্ঞানকে সমাজের বিজ্ঞান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এ উক্তির আলােকে বলা যায় সমাজবিজ্ঞান হলাে এমন এটি বিজ্ঞান যা সামাজিক জীবন বা সমাজের কার্যাবলির সমষ্টিকে যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে থাকে। ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তির যথার্থতা ও তাৎপর্য নিম্নের আলােচনায় তুলে ধরা হলাে:
(১) সমাজবিজ্ঞানের শাব্দিক বিশ্লেষণঃ সমাজবিজ্ঞানের আভিধানিক বিশ্লেষণটাই তাদের উক্তির মধ্যে ফুটে উঠেছে। সমাজবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলাে Sociology শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Socious’ এবং গ্রিক শব্দ ‘Logos’ এর সমন্বয়ে গঠিত। ‘Socious’ শব্দের অর্থ ‘সমাজ’ এবং ‘Logos’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ বা ‘বিজ্ঞান’। এ দৃষ্টিকোণ থেকে Sociology-এর অর্থ সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান বা বিজ্ঞান। আর ওয়ার্ড ও সামনার তাদের সংজ্ঞাটিতে Sociology-এর শাব্দিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে যথার্থই বলেছেন, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজের বিজ্ঞান।’
(২) সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতঃ সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর সংজ্ঞাতে তাদের উক্তির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ
সমাজবিজ্ঞানী কোলেভকি বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে সামাজিক সংগঠন ও সামাজ পরিবর্তনের বিজ্ঞান।’
ডুখেইম-এর মতে, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিজ্ঞান’। [Sociology is the Science of social institution)
William P. Scott-এর মতে, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে মানুষের সামাজিক চরণের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ বা অধ্যয়ন।’
সমাজবিজ্ঞানী গিভিংসের মতে, সমাজবিজ্ঞান হলাে সামাজিক ঘটনাবলি বা প্রপঞ্চের বিজ্ঞান।
এভাবে দেখা যায়, প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানীই সমাজের একেকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। আর তাদের সংজ্ঞার আলােকেই ওয়ার্ড ও সামনার সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাপক অর্থে সমাজবিজ্ঞানের উপযুক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
(৩) মুল্যবােধ নিরপেক্ষতাঃ সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান। এটি সর্বদা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চায়। সমাজবিজ্ঞান যদি তার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে নিরপেক্ষতা বজায় না রাখত তাহলে তা বিজ্ঞানের মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারত না। সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধ নিরপেক্ষ থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়েই বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালােচনা করে। তাই সামনার এবং ওয়ার্ড একে ‘সমাজের বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
(৪) বিষয়বস্তুঃ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান কেবলমাত্র সমাজের একেকটি বিশেষ দিক নিয়ে আলােচনা করে। অথচ সমাজবিজ্ঞান পূর্ণাঙ্গ সমাজকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলােচনা করে থাকে। এজন্য অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশ হলেও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলাে গােটা সমাজব্যবস্থা। সমাজের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের প্রকৃতি, প্রথা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গঠন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং আলােচনা করে বলেই সমাজবিজ্ঞানকে সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়ন’ বলে অভিহিত করা হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, ওয়ার্ড ও সামনার অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে সমাজবিজ্ঞানের একটি সরল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। প্রথম দিকে অনেকে এটাকে ‘দায়সারা’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু কোনাে সমাজবিজ্ঞানীই আজ পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞানের কোনাে সর্বজনীন সংজ্ঞা দিতে পারেননি। একমাত্র ওয়ার্ড ও সামনারই সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সকল সংজ্ঞার একটি সারমর্ম তুলে ধরেন। ফলে ছােট হলেও তাদের এই সংজ্ঞাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সর্বজনীন। তাই সবশেষে বলা যায়- ‘Sociology is the scientific study of society.’
Leave a comment