অথবা, সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যায় তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর বিভিন্নদেশে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রদানের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক চিন্তা নানাভাবে পরিপুষ্টতা ও বৈচিত্র্যতার সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্য দেশগুলােতে সমাজবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে তিনটি ঐতিহাসিক ধারা লক্ষ্য করা যায়। সমাজবিজ্ঞান ইতিহাস, দর্শন ও সামজিক প্রকৃতি বিজ্ঞানে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সমাজচিন্তা বিভিন্ন খাতে প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন মতাবলম্বি সমাজবিজ্ঞানী গােষ্ঠীর উদ্ভব হয়। সামাজিক ঘটনার ভিত্তিতে সমীক্ষা ও গবেষণা যুগের সূত্রপাত হয়।
সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদঃ সমাজবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক বিকাশের পটভূমি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় সমাজতাত্ত্বিক আলােচনা বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে দেখানাে হয়েছে। অন্যদিকে সমাজকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক উপাদানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিবিধ প্রচেষ্টার কারণে সমাজবিজ্ঞানের চারটি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদ গােষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে। তবে এগুলাে কোনােটি সুবিন্যস্ত নয়। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানের এ চারটি মতবাদ গােষ্ঠী সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হলােঃ
(ক) জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ এমতে বিশ্বাসী তাত্ত্বিকগণ সমাজকে জীবদেহের সাথে তুলনা করে তার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলােচনা করার চেষ্টা করেছেন। জৈবিক মতবাদ গােষ্ঠীর দৃষ্টিতে সমাজবিজ্ঞান মূলত জীববিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই যাত্রা শুরু করে। সমাজবিজ্ঞানী স্পেন্সার এ মতবাদ গােষ্ঠীর অন্যতম প্রবক্তা। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মধ্যদিয়েই সমাজবিজ্ঞানে জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির যাত্রা শুরু হয়। সমাজবিজ্ঞানের কতিপয় উত্তরসুরি স্পেন্সরের মতবাদকে সমর্থন করে বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়া ও জৈবিক সূত্রাবলির দিক থেকে সমাজকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
(খ) ভৌগােলিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ সমাজ সংক্রান্ত আলােচনায় যারা ভৌগােলিক উপদানের নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাবকে সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেন তাদেরকে ভৌগােলিক মতবাদ গােষ্ঠি বা দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিকগণের মধ্যে বাকলে, মন্টেঙ্কু এবং হান্টিংটন অন্যতম। তারা সমাজ বিশ্লেষণে ভৌগােলিক পরিবেশের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তাদের মতে, ভৌগােলিক পরিবেশের তারতম্যের ফলে সমাজ ও সভ্যতার মধ্যে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া ধর্ম, পরিবার এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ভৌগােলিক উপাদানের ফল।
(গ) মনস্তাত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিকগণ মনস্তাত্ত্বিক দিককে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ মতবাদ গােষ্ঠীর তাত্ত্বিকগণের মধ্যে ফ্রয়েড, এডলার প্রমুখ মনােবিজ্ঞানীর নাম সর্বাধিক পরিচিত। তাদের মতে সামাজিক, পারস্পরিক ক্রিয়া মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। সমাজবিজ্ঞানে এ মতবাদীদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ মতবাদ গােষ্ঠী ব্যক্তিত্ব বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে গিয়ে শৈশব এবং কৈশােরের অভিজ্ঞতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরােপ করেন।
(ঘ) সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যারা সর্বাধিক যশ বা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী। তারা সামাজিক পরিবেশ অর্থাৎ সামাজিক শক্তির দিক থেকে মানবিক আচরণকে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মধ্যে মানুষের কর্মধারা ও প্রতিক্রিয়া বিষয়ক সমাজ বিজ্ঞানী সামনার ও কেলার বলেছেন, নৈর্ব্যক্তিক শক্তি দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রভাবান্বিত হয়। এর অর্থ এই নয় যে, পূর্বোক্ত সকল মতবাদের কোনাে মূল্য নেই, বরং ঐ সকল মতবাদের অধিকাংশই মার্জিতরূপে সমাজতাত্ত্বিক মতবাদে গৃহিত হয়েছে। নিচে ডন মার্টিনডেল বর্ণিত সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ উল্লেখ করা হলােঃ
(১) দৃষ্টবাদী জৈববাদঃ উনিশ শতকে মানব চিন্তাধারার বিবর্তনে অগাস্ট কোঁৎ দৃষ্টবাদী দর্শন হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের স্বরূপ উদঘাটন করার চেষ্টা করেন। তিনি এবং হার্বার্ট স্পেন্সার মূলত সমাজবিজ্ঞানকে দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন।
(২) দ্বান্দ্বিক তত্ত্বঃ “দ্বন্দ্বই সমাজের চালিকাশক্তি।” এটি হচ্ছে দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এককালে দ্বন্দ্বকে সামাজিক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করা হতাে। দ্বন্দ্বই যে সমাজের চালিকা শক্তি এ ধারণা সর্বপ্রথম গ্রীক হিরাক্লিটাস থেকে সফিস্টদের সামাজিক ঘটনা ব্যাখ্যাতে পাওয়া যায়। তবে গ্লামপ্লেয়িজ যে দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন তা ইবনে খালদুনের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে।
(৩) সমাজতাত্ত্বিক আচারনিষ্ঠাবাদঃ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক ঘটনাবলির নিখুঁত পর্যালােচনা এবং ব্যাখ্যাই হলাে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মূলকথা। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণাত্মক আলােচনাই হচ্ছে সামাজিক আলােচনার প্রধান নির্ধারক। সমাজতাত্ত্বিক আচারনিষ্ঠাবাদ স্কুলটি গড়ে ওঠে জর্জ সিমেলের উদ্যোগে। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তাগুণের মধ্যে ফার্ডিন্যাণ্ড টনিস, আলফ্রেড ফিয়ারকান্ড, লিউপােল্ড, ফন ভীজে প্রমুখ অন্যতম।
(৪) সমাজতাত্ত্বিক ক্রিয়াবাদঃ সমাজতাত্ত্বিক ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিকগণ সমাজ বিশ্লেষণে সামাজিক প্রপঞ্চসমূহের ভূমিকা এবং কার্যাবলির ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করেন। এ গােষ্ঠির মতে নেহায়েৎ অস্তিত্বের তাগিদে হলেও ব্যক্তি, গােষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠান তাদের স্ব-স্ব ভূমিকা পালন করে চলে। অতএব সমাজ পর্যালােচনায় ব্যক্তি, গােষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সামাজিক প্রপঞ্চসমহের ভূমিকা ও কার্যাবলির ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করা প্রয়ােজন। সমাজতাত্ত্বিক ক্রিয়াবাদের উৎস তিনটি, এগুলাে হচ্ছে প্রাথমিক দিকের সমাজবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞানের ক্রিয়াবাদী শাখা এবং সামাজিক নৃ-বিজ্ঞান।
(৫) সামাজিক আচরণবাদঃ সামাজিক শক্তিগুলাে কীভাবে সমাজকে চালিত করে তা দেখা যায় মানুষের সামাজিক আচরণের মধ্যে। সামাজিক আচরণবাদী তাত্ত্বিকগণের মতে, সমাজতত্ত্বের আলােচ্য বিষয় হলাে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের আচরণের কাঠামােগত রূপ।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানে বিভিন্ন মতবাদে বিকাশ হয়েছে। কেননা সমাজবিজ্ঞানকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ সকল মতবাদের কোনােটিকে সুবিন্যস্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তবে সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে এ সকল মতবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
Leave a comment