প্রশ্নঃ সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলাে কী কী? সামাজিক গবেষণায় তুলনামূলক ও নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলােচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলাে কী কী? সামাজিক গবেষণায় তুলনামূলক ও নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান একটি সামাজিক বিজ্ঞান। তাই আধুনিক সমাজবিজ্ঞান সমাজ গবেষণায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানেরও কতকগুলাে বৈজ্ঞানিক স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সমাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে একটি সামান্যীকরণ করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পদ্ধতিসমূহঃ একটি সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে সুসংহত জ্ঞান অর্জনের জন্য কতকগুলাে পদ্ধতি অনুসরণ করে। পদ্ধতিগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-
(১) ঐতিহাসিক পদ্ধতি
(২) নমুনা জরিপ পদ্ধতি
(৩) পরীক্ষণ পদ্ধতি
(৪) তুলনামূলক পদ্ধতি
(৫) ঘটনা জরিপ এ পদ্ধতি
(৬) দার্শনিক পদ্ধতি
(৭) পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
(৮) পরিসংখ্যান কৌশল
(৯) জীবতাত্ত্বিক পদ্ধতি
(১০) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ পদ্ধতি
(১১) মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি
(১২) নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতি
(১৩) পরিমাপক পদ্ধতি
(১৪)কার্যক্রমগত পদ্ধতি
(১৫) সামাজিক জরিপ পদ্ধতি
(১৬) ঘটনা বিশ্লেষণ পদ্ধতি
(১৭) বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি
বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার উপযােগী পদ্ধতিঃ বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণায় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তবে একথা সত্য যে, কোনাে একক পদ্ধতির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের সমাজকাঠামাে গবেষণা সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় কোনাে পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি উপযােগী তা নিয়ে এদেশের সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশের ন্যায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনুন্নত, অশিক্ষিত ও রক্ষণশীল মনােভাবসম্পন্ন সমাজের কোনাে ঘটনা বিশ্লেষণে দার্শনিক পদ্ধতি কিংবা পরিসংখ্যান পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। কারণ এক এক ঘটনার কারণ স্থান-কাল-ভেদে একেক রকম হয়ে থাকে।
সামাজিক গবেষণায় তুলনামূলক পদ্ধতির গুরুত্বঃ বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী সমাজবিজ্ঞানীগণ সমাজ গবেষণায় সর্বপ্রথম তুলনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। সমাজের অতীত ও বর্তমান অবস্থা পর্যালােচনা করে একটা সাধারণ নীতি প্রণয়ন ও তার ভিত্তিতে একটি বিশেষ কারণঘটিত ব্যাখ্যা প্রদান করাই এ পদ্ধতির উদ্দেশ্য। The Rules of Sociological Method নামক গ্রন্থে ডুরখেইম সর্বপ্রথম এ পদ্ধতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি সমাজে আত্মহত্যার বিশ্লেষণের মাঝে আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক কারণ হিসেবে উদঘাটন করতে চেষ্টা করেছেন। এ পদ্ধতিতে মূলত বিভিন্ন সমাজের মধ্যে তুলনামূলক সমীক্ষা চালানাে হয়। একটি সমাজের ব্যক্তি, গােষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান তথা গােটা সমাজ অন্য সমাজ থেকে কতটা ভিন্নধর্মী বা কতটা সমধর্মী সে সম্পর্কে গবেষণা করতে হলে তুলনামূলক পদ্ধতির বিকল্প নেই। তুলনামূলক পদ্ধতির একটি বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, পদ্ধতিটি সমাজের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বুঝতে সাহায্য করে। অধিকন্তু সমাজভেদে মানুষের সামাজিক আচরণের মধ্যে কোনাে ধরনের তারতম্য সৃষ্টি হয় তা জানা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির গুরুত্বঃ নিম্নে বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির গুরুত্ব আলােচনা করা হলাে-
(১) প্রাচীন ঐতিহ্য জানতেঃ বাংলাদেশ প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাচীন জাতির ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিলীয়মান প্রাচীন ঐতিহ্যকে জানতে হলে নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানতে হবে।
(২) অতীত সমাজ জানতেঃ অতীতের গর্ভেই বর্তমানের বীজ নিহিত থাকে। বাংলাদেশের অতীত সমাজ তথা অতীত সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা জানার জন্য আজও তেমন কোনাে সামাজিক ইতিহাস সৃষ্টি হয়নি।
(৩) সমাজকাঠামাে বিশ্লেষণঃ বাংলাদেশের সমাজকাঠামাে বিশ্লেষণের জন্য নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গবেষণার প্রয়ােজন। ভৌগােলিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজকাঠামাে বিভিন্ন রকম। তাই বাংলাদেশের সমাজকাঠামাের স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে দীর্ঘদিনের অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সমাজ গবেষণা করতে হবে।
(৪) গ্রামীণ সমাজ জানতেঃ বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। এ দেশের আশি হাজার গ্রামকে জানতে হলে তথা আশি হাজার গ্রামের মানুষের জীবনপ্রণালি জানতে হলে নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে জানতে হবে।
(৫) সাংস্কৃতিক ধারা বিশ্লেষণেঃ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক ধারার এক বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্র্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক ধারা বিশ্লেষণ করতে হলে গবেষককে অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জীবনধারা সম্পর্কে জানতে হবে। আর এক্ষেত্রে নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতির বিকল্প নেই।
(৬) উপজাতীয় সমাজ বিশ্লেষণেঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশটিরও বেশি উপজাতি বাস করে। এসব উপজাতিদের জীবনপ্রণালি বাঙালি জীবনপ্রণালি থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র। তাই বাংলাদেশের উপজাতিদের জীবনপ্রণালী তথা সাংস্কৃতিক জীবনধারা বিশ্লেষণ করতে হলে নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা করতে হবে।
(৭) জাতিতত্ত্ব বিশ্লেষণেঃ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন জাতিসত্তার সংমিশ্রণ রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে জাতিসত্তার এ ভিন্নতার কারণে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও সাংস্কৃতিক ধারাতেও ভিন্নতা রয়েছে। তাই বাঙালি জাতিসত্তার বিশ্লেষণে নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
(৮) জীবনপ্রণালী জানতেঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে ভৌগােলিক পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে জীবনযাত্রার মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পেশাজীবী মানুষের জীবনপ্রণালি জানতে হলে ন-তাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা করতে হবে।
(৯) সামাজিক বিবর্তন বিশ্লেষণেঃ যুদ্ধ, দেশ বিভাগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, উদ্বান্ত সমস্যা, প্রাকৃতিক দয়ােগ; শিল্পায়ণ-নগরায়ণ প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের সমাজজীবন সতত বিবর্তিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন জানতে হলে নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা করতে হবে।
(১০) মানব কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণেঃ মানুষের সাথে সমাজের সম্পর্ক নিবিড়। সমাজে সবক্ষেত্রেই মানুষের সামগ্রিক পর্যালােচনাই নৃ-বিজ্ঞানের কাজ। মানুষের কর্মকাণ্ডকে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ণ করার। ক্ষেত্রে নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতি বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি পদ্ধতিই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা ও গবেষণার বিষয়বস্তুর ওপর পদ্ধতির ধরন নির্ভর করে। তবে বাংলাদেশের সমাজে গবেষণার ক্ষেত্রে তুলনামূলক পদ্ধতি ও নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
Leave a comment