অথবা, কার্ল মার্কস-এর প্রধান প্রধান সমাজতাত্ত্বিক মতবাদগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, কার্ল মার্কসকে কী আমরা একজন সমাজবিজ্ঞানী বলতে পারি? সমাজবিজ্ঞান বিকাশে তার অবদান লিখ।
ভূমিকাঃ কার্ল মার্কস (১৮০৮-১৮৮৪) সমাজবিজ্ঞানী নন। তিনি কোথাও সমাজবিজ্ঞান কথাটি ব্যবহার করেননি। তবে তার লেখার ক্ষেত্রটি এমন যেখানে সমাজবিজ্ঞান বিষয়টি বাদ যায়নি। তিনি মূলত একজন দার্শনিক অর্থনীতিবিদ। তার লেখার পরিণতি বিপ্লব। তিনি বৈপ্লবিক দার্শনিক ছিলেন। কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং কর্মের মাধ্যমে সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন। কার্ল মার্কসের সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ বস্তুতপক্ষে সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। তাই তার তত্ত্ব নিঃসন্দেহে সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।
কার্ল মার্কসের বস্তুবাদঃ কার্ল মার্কস মানবসমাজকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দু’টি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। যা নিম্নে ছকের মাধ্যমে দেখানাে হলাে:
দ্বান্দ্বিক বহুবাদ (Dialectical Materialism): দান্দ্বিক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Dialectic’, এটি গ্রিক শব্দ Dialeda থেকে এসেছে যার অর্থ বিতর্ক বা আলােচনার মধ্যদিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। তবে দ্বান্দ্বিকতার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পরস্পরবিরােধী দুটি শক্তির সংঘাতজনিত প্রক্রিয়া। মার্কস-এর Dialectical materialism-এর বিকাশ ঘটে মূলত ১৮৪০-এর দশকে যখন মানবসমাজে একটা বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলন বিকাশ লাভ করে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical materialism): মার্কসবাদের দ্বিতীয় মৌলনীতি হলাে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। একে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা Materialist concept of history ও বলা হয়। স্টালিন-এর ভাষায় “সামাজিক জীবনপাঠে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়ােগই হলাে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ”। Hunt-এর মতে, “মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়ােগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়।”
বিচ্ছিন্নতাবােধের ধারণা ও মার্কস মূলত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকদের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতাবােধ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বলেছেন, বিচ্ছিন্নতাবােধ বলতে এমন একটি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে বুঝায় যার ফলে শ্রমিক তার সামাজিক অস্তিত্বের কিছু ক্ষেত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে।
বিচ্ছিন্নতাবােধের উপাদানসমূহঃ পুঁজিবাদী সমাজে চারটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলাে নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলােঃ
(১) শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদনের উদ্দেশ্য হতে বঞ্চিত হয়ঃ এ সমাজে শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদনে উদ্দেশ্য হতে বঞ্চিত হয়। কেননা, তারা নিজেদের জন্য কাজ করতে পারে না। বস্তুত তারা পুঁজিপতিদের জন্য কাজ করে যারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে জীবনধারণের জন্য পারিশ্রমিক প্রদান করে।
(২) উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত হয়ঃ এ ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদনের উদ্দেশ্য অর্থাৎ উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত হয়। তারা যা উৎপাদন করে তার সবই মালিকদের অধিকারভুক্ত হয় এবং মালিকরা ইচ্ছামতাে এটা ব্যবহার করে এবং বিক্রি করে পুঁজি সৃষ্টি করে।
(৩) পারস্পরিক সহযােগিতা থেকে বঞ্চিতঃ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই পারস্পরিক সহযােগিতার মধ্যে | দিয়ে কার্য সম্পাদন করে জীবনযাপন করতে চায়। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে এ ধরনের সহযােগিতা বিঘ্নিত হয়। তারা পাশাপাশি কাজ করে। ফলে যন্ত্র ও যন্ত্রের ব্যবহার তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে তােলে।
(৪) মনুষ্যতবােধ থেকে বিচ্ছিন্নঃ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণি মনুষ্যত্ববােধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেননা, এ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা তাদের অমানবিক যন্ত্রে পরিণত করে। অন্যান্য মানুষের প্রতি তাদের পারস্পরিক সহানুভূতির মাত্রা হ্রাস পায়।
উদ্বৃত্ত তত্ত্বঃ শ্রমিককে শােষণের মাধ্যমে মালিক শ্রেণি সম্পদের পাহাড় গড়ে তােলে। মূলত মানুষের যে চাহিদা সেই চাহিদা অনেক বেশি তারা শ্রম দিতে সক্ষম। কিন্তু এই অতিরিক্ত শ্রমের মূল্য তারা পায় না। অথচ এই অতিরিক্ত শ্রমের মাধ্যমে যে উৎপাদন সংঘটিত হয় তার মূল্যকেই Surplus Value বা উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
শ্রেণি এবং শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বঃ কার্ল মাকর্স শ্রেণি কোনাে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করেননি। মার্কস লক্ষ্য করেন যে, কেবল দাস যুগে শুধু দাসমালিক আর দাসই ছিল না কিংবা সামন্তযুগে ভূমিদাস আর সামন্তপ্রভুই ছিল না বরং অন্য শ্রেণির অবস্থানও লক্ষ্য করা যায়। তাই তিনি শ্রেণিকে আবার দুটো ভাগে ভাগ করেন। যথাঃ মৌল এবং গৌণ শ্রেণি অর্থাৎ বৈরী সমাজে যারা উৎপাদনের সাথে সরাসরি যুক্ত নয় তারাই হচ্ছে গৌণ শ্রেণি। দাস যুগে স্বাধীন কারিগর শ্রেণি কিংবা পুঁজিবাদী সমাজে কৃষককুল হচ্ছে গৌণ শ্রেণি। শ্রেণি সংগ্রামে এ শ্রেণি, শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণকারি যেকোন বৈরীমূলক শ্রেণির সহযােগিতা করে।
বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পর্কে মার্কসের ধারণাঃ আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজকে মার্কস বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি এবং সর্বহারা শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। অত্যাধিক শােষণের ফলে সমাজে শ্রেণিসগ্রাম তীব্রতর হবে। এ অবস্থায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন সর্বহারা শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এর সাথে সাথেই প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ধণতান্ত্রিক সমাজ।
ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের ধারণাঃ মার্কস বিভিন্ন সমাজের কাঠামাে বিশ্লেষণ করতে গিযে উৎপাদন পদ্ধতির পাশাপাশি ধর্মকেও বিবেচনায় রেখেছেন। ধর্মের বিষয়টিকে তিনি সমালােচকের দৃষ্টিতে দেখেছেন তবে ধর্মের ভূমিকাকে তিনি অস্বীকার করেন নি। তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন যে, শাসকবর্গ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বা ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে শােষণ করে। তাই তিনি ধর্মকে অফিসের সাথে তুলনা করেছেন।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, সমালােচনাহীন তত্ত্ব পৃথিবীতে বিরল। সে ক্ষেত্রে মার্কসও সমালােচনার উর্ধ্বে নন। সমালােচনা সত্ত্বেও সমাজবিজ্ঞানে কার্ল মাকর্স-এর অবদান অপরিসীম। যদিও মার্কস এর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়নি। কেননা পৃথিবীতে এখনও রাষ্ট্রের বিলুপ্তি হয়নি এবং সাম্যবাদও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মার্কসের সমালােচনার ওপর ভিত্তি করে অনেক সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে ওঠেছে যা সমাজ বিজ্ঞানের বিকাশের ধারা সমৃদ্ধ করেছে এতে কোনাে সন্দেহ নেই।
Leave a comment