অথবা, আধুনিক সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে এমিল ডুর্খেইম-এর অবদান মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ এমিল ডুর্খেইম সমাজবিজ্ঞানের একজন পথিকৃৎ। তিনি সমাজবিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতিগত আলােচনায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মূলত সমাজবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বিজ্ঞান বিষয় হিসাবে বিকাশ শুরু হয়েছিল ডুর্খেইম-এর সময় থেকে। অগাস্ট কোঁৎ যে ধারায় আলােচনা করেন ডুর্খেইমও সে ধারায় সমাজবিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান করার জন্য পদ্ধতির ওপর আলােচনা করেছেন। কিভাবে সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করতে হবে সেই ধারার পদ্ধতির কথা বলেছেন। তিনি সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। তাকে ক্রিয়াবাদের জনক বলা হয়।
সামাজিক ঘটনাবলীঃ ডুর্খেইম সামাজিক বিভিন্ন বিষয়াবলী ব্যাখ্যা করার জন্য সামাজিক ঘটনাবলির অবতারণা করেছেন। সামাজিক ঘটনাবলি বলতে সমাজের মধ্যে কোন জনগােষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা, প্রবণতা, রীতি-নীতি ইত্যাদিকে বুঝায়। Zeitlin-এর মতে, Social Facts are the social structures and cultural norms and values that are external to, and coercive of, actors.
ডুর্খেইম বলেন, সমাজবিজ্ঞানকে দর্শন থেকে আলাদা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের বিষয় ভিত্তিক হিসেবে সামাজিক ঘটনা আলােচনা করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, সামাজিক ঘটনাবলিকে Things হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং Emperically study করতে হবে । তিনি সমাজবিজ্ঞানকে মনােবিজ্ঞান থেকেও আলাদা করতে চেয়েছেন। তার মতে, Psychological facts were basically inherited phenomena.
মূলত ডুরখেইম সমাজবিজ্ঞানের আলােচনাকে সামাজিক বাস্তবতার ঘটনাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। তার মতে, সামাজিক ঘটনাবলীর মূল দু’টি বিষয় হলােঃ
বহিঃস্থ অবস্থান বা চাপ সামাজিক বাস্তবতার ব্যাখ্যায় Exteriority কে ডুর্খেইম গুরুত্ব দিয়েছেন। ডুর্খেইম সামাজিক ঘটনাবলির সংজ্ঞায় বলেন- “Social facts are external to individuals, constraining upon them, and diffused throughout society with a nature which goes beyond their individual manifestations.”
এখানে তিনি সামাজিক ঘটনাবলির ৩টি বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। (ক) বাহ্যিকতা (Externality) (খ) চাপ (Constraints) এবং (গ) সর্বজনীন ব্যাপ্তি (Diffusion Generality)
অর্থাৎ, সামাজিক ঘটনা ব্যক্তির কাছে বাহ্যিক এবং ব্যক্তির মনের ওপর এটির চাপমূলক প্রভাব আছে। আর সামাজিক ঘটনাগুলাে সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিরাজিত থাকে।
সমাজে শ্রম বিভাজনঃ ডুরখেইমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে সমাজের শ্রম বিভাজনের তত্ত্বটি। তিনি তার সামাজিক সংহতি যৌথ প্রতিরূপ দিয়ে সমাজের শ্রম বিভাজনকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। তিনি মুলত ব্যক্তি সত্ত্বার সাথে সমাজ সত্ত্বার সম্পর্ক আলােচনা করতে গিয়েই উক্ত তত্ত্ব হাজির করেন।
(ক) যান্ত্রিক সংহতিঃ ডুরখেইম যান্ত্রিক সংহতি বলতে এমন সংহতিকে বুঝিয়েছেন যেখানে সমাজের সভ্যদের মধ্যে এক অনন্য সাদৃশ্য বিদ্যমান। যান্ত্রিক সংহতিতে এক ব্যক্তি অপর হতে খুব কমই পৃথক থাকে অর্থাৎ সকলেই একই রকম আচার আচরণ ও চিন্তা-চেতনা এবং মূল্যবোধের অধিকারী হয়ে থাকে। সে কারণে এ সংহতিকে একটি যন্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেখানে একটি যন্ত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ নিজ নিজ কাজ করে যন্ত্রটি সচল রাখে।
(খ) জৈবিক সংহতিঃ অপরদিকে জৈবিক সংহতি হচ্ছে যেখানে সামাজিক সভ্যদের মধ্যে চিন্তায়, আচরণে কিংবা মূল্যবােধে তেমন সাদৃশ্য নেই। এ ধরণের ভাষায়, জৈবিক সংহতিতে সমাজের বিভিন্ন সভ্য বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে যেমন মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গে বিভিন্ন ক্রিয়া করে থাকে। তাই বিভিন্ন অঙ্গ পরস্পর নির্ভরশীল হয়েও আলাদা-আলাদা ক্রিয়া করে থাকে। ডুরখেইম Organic শব্দটি ব্যবহার করেন সংহতির ক্ষেত্রে।
নৈরাজ্যঃ ডুরখেইমের নিকট সার্বিক নৈতিকতার বিষয়টি ছিল প্রধান আলােচ্য বিষয়। তিনি নৈরাজ্যের আলােচনায় সার্বিক নৈতিকতার অবক্ষয়ের কথাই উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তি নৈরাজ্যের মুখােমুখি হয় তখন যখন নৈতিকতা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ কোনটি করা উচিত এবং কোনটি করা উচিত নয় বা গ্রহণযােগ্য নয় সে সম্পর্কে ধারণার অভাব দেখা দেয়। ভুরখেইম বিশ্বাস করেন যে, আধুনিক বিশ্বে ঐ সমস্যার সমাধান সম্ভবপর।
আত্মহত্যাঃ আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে কিভাবে সামাজিক সংহতি যৌথ প্রতিরূপের সাথে যুক্ত, ডুরখেইম তা একটি অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্লেষণ প্রদানের চেষ্টা করেন। ডুরখেইম আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সকল গতানুগতিক তত্ত্বকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তার Suicide পুস্তকে।
আত্মহত্যা ও সামাজিক প্রবাহঃ আত্মহতাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডুরখেইম একটি অবস্তুগত সামাজিক ঘটনা তথা আত্মহত্যাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডুরখেইম একটি বস্তুগত সামাজিক ঘটনা তথা Social current প্রত্যয় ব্যবহার করেন। তিনি তার The Rules of Sociological Method-এ ঐ প্রত্যয় সম্পর্কে আলােচনা করেন। ডুরখেইমের মতে Social Currents হচ্ছে are external’ to, and coercive of, the individual. অর্থাৎ ব্যক্তিসত্ত্বার বাইরে কিন্তু ব্যক্তিকে তা মেনে চলতে বাধ্য করে এমন ধরনের অবস্তুগত সামাজিক প্রপঞ্চ।
আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যাঃ যখন ব্যক্তি এবং গােষ্ঠির মধ্যকার বাঁধন দুর্বল হয় তখন এ ধরনের আত্মহত্যা দেখা দেয়। বােগারডাসের ভাষায়, মূল যে সমাজে সংহতি কম থাকবে সে সমাজে এ ধরনের আত্মহত্যা বেশি সংগঠিত হয়ে থকে।
পরার্থপর আত্মহত্যাঃ ব্যক্তি যখন কোনাে সামাজিক উদ্দেশ্য আত্মহত্যা করে তখন তাকে Altruistic Suicide বা পরার্থপর আত্মহত্যা বলে। এখানে ব্যক্তির আত্মহত্যা সমাজের অন্য কারাের জন্য নিবেদিত।
নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যাঃ ডুরখেইম এ ধরনের আত্মহত্যার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। তিনি মনে করেন, একটি সমাজের আর্থিক দুরাবস্থা ছাড়া আরও বিভিন্ন কারণেও যদি সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়, তাহলেও আত্মহত্যা বৃদ্ধি পায়। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন। যে, যখনই কোনাে সমাজে রীতিনীতি, মূল্যবােধ ইত্যাদি ভেঙ্গে পড়ে তখন এ ধরনের আত্মহত্যা বেশি দেখা দেয়।
ভাগ্যবাদী আত্মহত্যাঃ ডুরখেইম তার Suicide গ্রন্থের পাদটীকায় ভাগ্যবাদী আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা সেখানে বেশি দেখা দেয় যেখানে সমাজের অনুশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, পক্ষান্তরে ভাগ্যবাদী আত্মহত্যা সেখানে দেখা দেয় সেখানে সমাজের অনুশাসন অতিমাত্রায় দেখা দেয় ।
ধর্মীয় জীবনের প্রাথমিক ধরনঃ এমিল ডুরখেইমের অন্যতম বিখ্যাত রচনা হচ্ছে The Elementary Forms of Religious life. তিনি তার এ পুস্তকে ধর্মকে একটি সামাজিক বিষয় বলে চিহ্নিত করেন এবং এ সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান প্রধানত সমাজ বা গােষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে দেখা দেয়, আর তেমনি সমাজ থেকেই ধর্মের উদ্ভব হয়ে থাকে। ডুরখেইম ধর্মের উদ্ভবের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার অরুনটা উপজাতির ওপর এক গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি টেইলরের আদিম সমাজের সর্বপ্রাণবাদ ও ম্যাক্স মুলারের প্রকৃতিবাদ ব্যাখ্যাগুলাে পরীক্ষা করেন এবং সেগুলােকে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তার মতে সে সব তত্ত্ব মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখার ওপর নির্ভরশীল এবং ধর্মের অলংঘনীয় আদর্শ ও সমালােচনামূলক আদর্শের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সামাজিক সংস্কারঃ ইতোমধ্যে ডুরখেইমের অবস্তুগত সামাজিক প্রপঞ্চ যেমন নৈতিকতা, যৌথ প্রতিরূপ, যৌথ প্রতিনিধিত্ব, Social currents এবং ধর্ম সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। এগুলাে ডুরখেইমের চিন্তার মূলবিন্দু যদিও ডুরখেইম বস্তুগত সামাজিক ঘটনার গুরুত্বকে অবহেলা করেন নি কিন্তু তিনি মনে করেন যে, আলােচিত অবস্তুগত সামাজিক ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। সেগুলাে Causal priority হিসেবে অনেক অবস্তুগত সামাজিক ঘটনার জন্ম দেয় (Dynamic density)। তবুও ডুরখেইমের মতে, বস্তুগত সামাজিক ঘটনা আধুনিক সমাজে নৈতিক সমস্যার কাঠামােগত সমাধান দিয়ে থাকে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ডুরখেইম-এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজবিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানাে, যার বিষয়বস্তু হবে সামাজিক ঘটনা এবং তা হবে অন্যান্য বিজ্ঞানের সমতুল্য। সামাজিক ঘটনাসমূহকে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের জন্য নামকরণেল চেষ্টা করেছেন এবং দিভিন তাত্তিকদের মতানুযায়ী তিনি যেভাবে এগিয়েছেন তা বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি সৃষ্টি করেছে। ডুরখেইমের আলােচনায় ধারাবাহিকতা তা লক্ষণীয়। তিনি তার তথ্য সন্নিবেশনকে তাত্ত্বিক রূপ প্রদান করেছেন। আর এই ধারাবাহিকতা থেকে সমাজবিজ্ঞানের একটি কাঠামাে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Leave a comment