সমাজতান্ত্রিক সমাজের পরিচয়

সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল পুঁজিবাদী সমাজ ও সাম্যবাদী সমাজের অন্তর্বর্তীকালীন একটি সমাজব্যবস্থা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার পরে এবং সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার আগে গড়ে উঠে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এ হল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যবর্তী পর্যায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি হয় পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভ থেকেই। স্বভাবতই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য এই সমাজে থেকে যায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদের পরাজয় ঘটেছে, কিন্তু পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়নি। আবার এখানে সাম্যবাদের জন্ম হয়েছে, কিন্তু সাম্যবাদ পরিণত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল মরণাপন্ন পুঁজিবাদ এবং উদীয়মান সাম্যবাদের এক সংঘাতপূর্ণ অবস্থা। তেমনি আবার সমাজতন্ত্রকে সাম্যবাদের প্রথম পর্যায় হিসাবেও অভিহিত করা যায়। সমাজতন্ত্রে অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হবে এক অন্তর্বর্তীকালীন সমাজব্যবস্থার। সমাজতন্ত্র হল এক নতুন আর্থ-সামাজিক বিন্যাস। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে। অতীতের অন্যান্য সমাজব্যবস্থার মত সমাজতান্ত্রিক সমাজেও একটি রাষ্ট্র থাকে। এও হল একটি শ্রেণী-রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র-যন্ত্রের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর শাসন বা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী পুঁজিবাদী সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি অল্পবিস্তর এখানেও থাকে। তবে এই সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতিকূল প্রভাব থেকে সত্বর মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন থাকে। এই কারণে সমাজতন্ত্রকে তত্ত্বগতভাবে একটি আন্দোলন হিসাবে গণ্য করা যায়।

চারটি মূল লক্ষ্য: সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল এক রাজনীতিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার পর্যায়। সাম্যবাদী সমাজের যাবতীয় পূর্ব শর্ত সৃষ্টি করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজই সর্বহারার বিপ্লব এবং সর্বহারা শ্রেণীকে শাসকের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ সর্বহারার একনায়কত্বের পথকে প্রশস্ত করবে। তা ছাড়া সমাজতন্ত্রই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উদ্দেশ্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে মূল চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। সমাজতন্ত্রের চারটি মূল উদ্দেশ্য হল: 

  • (ক) সর্বহারার একনায়কত্ব সফল করা, 

  • (খ) আর্থনীতিক ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তর সাধন, 

  • (গ) প্রলেতারীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা এবং 

  • (ঘ) সমাজতান্ত্রিক সমাজ সংস্কৃতির বিকাশ সাধন।

(ক) সর্বহারার একনায়কত্বকে সফল ও সার্থক করে তোলা:

সমাজতান্ত্রিক সমাজের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বহু ও বিভিন্ন। এই সমস্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একনায়কত্ব একান্তভাবে আবশ্যক। মানবসমাজের ক্রমবিকাশেরএই অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের প্রথম ও প্রধান কাজ হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎসাদন। পুঁজিবাদের এই উৎসাদন প্রক্রিয়ায় একমাত্র প্রলেতারিয়েতই সফল হতে পারে। এই কারণে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বকে সামগ্রিক ও সঠিকভাবে সংগঠিত করা দরকার। এবং এটাই সমাজতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে অধিকতর সুসংহত ও উন্নত করতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় অভিযানকে অব্যাহত রাখতে হবে। ক্ষমতাচ্যুত পুঁজি ও প্রতি-বিপ্লবী শক্তির জোরে প্রত্যাঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এই প্রত্যাঘাত প্রতিহত করা দরকার। প্রলেতারিয়েতকেই তা প্রতিহত করতে হয়। সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের পথে বহু ও বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি বর্তমান। সমাজতন্ত্রের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ে এই সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করতে হবে। তারজন্য দরকার কঠিন কঠোর সংগ্রাম। সর্বহারা শ্রেণী এই সংগ্রামের সামিল হবে। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সর্বহারা শ্রেণী অঙ্গীকারবদ্ধ। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে সংশোধনবাদী, সুবিধাবাদী ও পাতি-বুর্জোয়াদের প্রতি-বিপ্লবী কার্যকলাপ প্রতিহত হবে এবং সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য অব্যাহত থাকবে।

পূর্ববর্তী পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শক্তি-সামর্থ্য ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম সর্বহারার একনায়কত্বে পরিচালিত হয়। এই সংগ্রাম সহিংস। এর মধ্যেও দমন-পীড়ন বর্তমান। কিন্তু দমন-পীড়ন শোষক শ্রেণীর নয়। সর্বহারা শ্রেণী শোষক শ্রেণী নয়। সর্বহারা শ্রেণী পরিচালিত হয় জনগণের ইচ্ছা অনুসারে। জনগণের অভিপ্রায়ই এই শ্রেণীর মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করে। প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বহারা শ্রেণীর যাবতীয় শক্তির ব্যাপক সামাজিক ভিত্তি বর্তমান। সর্বহারার একনায়কত্বে প্রশাসনের প্রকৃত শক্তির মূল উৎস হল জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই শক্তি জনগণের আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। জনগণের আস্থার ভিত্তিতে এই শক্তির অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে এবং অধিকতর সুসংহত হয়। সর্বহারার একনায়কত্বে পরিচালিত হয় সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ। এই পর্যায়ের প্রশাসন শোষণমূলক নয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি সর্বহারার একনায়কত্বের অপরিহার্যতা অব্যাহত থাকবে।

(খ) আর্থনীতিক ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তরসাধন করা—

সমাজতান্ত্রিক সমাজের আর্থিক পুনর্গঠন: সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল সমকালীন আর্থনীতিক ব্যবস্থার সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন। সর্বহারা শ্রেণী সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করার পর রাজনীতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন করে। এই রাজনীতিক কর্তৃত্বকে আর্থনীতিক ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তর ও সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ও সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সামাজিক সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা। এই উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী বৃহৎ সম্পত্তিকে জাতীয়করণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ব্যাঙ্ক, বীমা ও পরিবহণ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বৃহদায়তনবিশিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের কথা বলা যায়। বৃহৎ পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠানসমূহের জাতীয়করণ এবং এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও বিকাশের উপর সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক পুনর্গঠনের মান ও সাফল্য নির্ভরশীল। অন্তর্বর্তীকালীন এই সমাজের আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হল শোষণমূলক পুঁজিবাদী অর্থনীতির নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করা এবং সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা। সমাজতান্ত্রিক জাতীয়করণের একাধিক উদ্দেশ্য বর্তমান। এই সমস্ত উদ্দেশ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পুঁজিবাদী আর্থনীতিক শক্তিকে ক্ষমতাহীন করা, নতুন উৎপাদন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা, জাতীয় আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর সর্বহারাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা প্রভৃতি। তবে এই সমস্ত আর্থনীতিক কার্যপ্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হল মুষ্টিমেয় মানুষের পরিবর্তে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ।

সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ: সমাজতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সমাজের আর্থনীতিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আর একটি উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য হল সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সম্প্রসারণ। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রসার সাধন বলতে সমাজতান্ত্রিক জাতীয় অর্থনীতিকে সমগ্র দেশে সম্প্রসারিত করাকে বোঝায়। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পরিকল্পিত পথে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালনা। উৎপাদনের ব্যাপারে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে সমাজ। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সম্প্রসারণের সঠিক উপায়-পদ্ধতি হিসাবে বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ, কৃষি-সমবায় প্রভৃতির কথা বলা হয়।

শিল্পের সমাজতান্ত্রিক বিকাশ: সমাজতান্ত্রিক জাতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করা দরকার। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। অর্থাৎ শিল্পের সমাজতান্ত্রিক বিকাশ সাধন হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থনীতিক দায়িত্ব। সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থনীতিক সুফল পাওয়া যাবে। এই সমস্ত সুফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নত যান্ত্রিক ও কারিগরী পদ্ধতির প্রয়োগ, উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তিগত উন্নতি, জাতীয় অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন, পুঁজিবাদী উৎপাদনের শোষণমূলক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ, আর্থিক ক্ষেত্রে দেশের স্বাধীনতাকে সুস্থির করা প্রভৃতি।

সামাজিক শ্রম: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রমের ব্যক্তিগত রূপকে সামাজিক শ্রমে রূপান্তরিত করার কথা বলা হয়। একে বলা হয় সমাজতান্ত্রিক শ্রম। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর সামাজিক মালিকানা কায়েম হয়। এই অবস্থায় উৎপাদকদের সমবায় গঠিত হয়। এইভাবে ব্যক্তিগত শ্রম সামাজিক শ্রমে রূপান্তরিত হয়। সমাজতন্ত্রে সামাজিক শ্রমের মাধ্যমে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা হয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সহায়ক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : শ্রমিক সাধারণের মধ্যে সমবায় ও সহযোগিতামূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, শ্রমশক্তির সঠিক ও সম্যক ব্যবহার, উৎপাদনের প্রকৌশলগত উন্নতি সাধন, শ্রম-সময় হ্রাস প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক সমাজের উদ্দেশ্য হল একটি সহায়ক পরিবেশ প্রস্তুত করা। এই অনুকূল অবস্থায় শ্রমের সহায়ক পরিবেশ পাওয়া যাবে এবং শ্রমিক শ্রমের সম্যক পারিতোষিক লাভ করবে। তা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক শ্রমের আর্থিক নিরাপত্তা নিরাপদ হবে। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য বেকারত্ব দূরীভূত করে যাবতীয় আর্থনীতিক সংকটের সমাধান করতে হবে। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজে জাতীয় অর্থনীতিকে সুসংগঠিত করার কথা বলা হয়।

পরিকল্পিত উৎপাদন: অন্তর্বর্তীকালীন এই সমাজে সমাজতন্ত্রের আর্থনীতিক লক্ষ্য হল জাতীয় অর্থনীতির পরিকল্পিত পথে উন্নয়ন ও সমানুপাতিক বিকাশ। পরিকল্পিত অর্থনীতির উদ্দেশ্য হল জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতিসাধন। এ ধরনের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থা পরিকল্পিত পথে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিকল্পিত উৎপাদনের একটি দিক হল উৎপাদনের উন্নত উপায়সমূহ উৎপাদন এবং আর একটি দিক হল ভোগ্য দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন। প্রথম শ্রেণীর উৎপাদনের মধ্যে পড়ে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর উৎপাদনের মধ্যে পড়ে খাদ্যসামগ্রী, পরিধেয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন হল সামাজিক উৎপাদন। এবং সামাজিক উৎপন্নের মালিক হল সমাজ। এই উৎপাদনের উদ্দেশ্য হল জনসাধারণের ভোগ। এই উৎপাদনের ভোগ্য দ্রব্যসামগ্রী জনসাধারণের ভোগের জন্য বরাদ্দকৃত। উদ্বৃত্ত উৎপাদন বা মুনাফার প্রশ্ন এখানে অনুপস্থিত।

(গ) প্রলেতারীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা:

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্বর্তী অধ্যায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হল প্রলেতারীয় গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা। সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অবসান ঘটে, মুষ্টিমেয় প্রাধান্যকারীদের আধিপত্যের অবসান ঘটে। মেহনতী মানুষের জয় প্রলেতারীয় গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে । প্রলেতারীয় গণতন্ত্র হল প্রকৃত গণতন্ত্র। এ হল শ্রমজীবী জনতার গণতন্ত্র। সর্বহারার একনায়কত্বে এ ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ গণতন্ত্র আগেকার বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে আলাদা এক নতুন গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্রে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্র বর্তমান। এ হল সমাজতন্ত্র-বিরোধীদের উপর একনায়কতন্ত্র এবং শ্রমজীবী জনতার জন্য গণতন্ত্র। আগেকার বুর্জোয়া গণতন্ত্র ছিল শাসক গোষ্ঠীর মুষ্টিমেয়ের গণতন্ত্র। কিন্তু এই প্রলেতারীয় গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র পরিচালিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে। প্রলেতারীয় গণতন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে এবং সর্বহারাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করে।

জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ: প্রলেতারীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করবে। তার ফলে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। জনসাধারণের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রলেতারীয় গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবে এবং এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হবে। এই অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক পরিচালনার নীতি হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি। জনসাধারণের উদ্যম-উদ্যোগ এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মানুবর্তিতার সংযোগের ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি গড়ে উঠে। প্রলেতারীয় গণতন্ত্রে বুর্জোয়া শাসন শোষণের অবসান ঘটবে। জাতি, ধর্ম, বংশ, স্ত্রী-পুরুষ, শিক্ষা, সম্পত্তি প্রভৃতির ভিত্তিতে আগেকার যাবতীয় বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। প্রলেতারীয় গণতন্ত্র থেকে মেহনতী জনতা তাদের পুরো প্রাপ্য পাবে। প্রলেতারীয় একনায়কত্ব ও প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিবাচক ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

(ঘ) সমাজতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ সাধন:

সমাজতন্ত্রের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের কথা বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রলেতারীয় গণতন্ত্রকে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করার কথা বলা হয়। এবং এর জন্য সহায়ক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক পরিবেশ গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে মেহনতী মানুষের স্বার্থের সহায়ক সামাজিক-সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার কথা বলা হয়। রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রসঙ্গেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল একক পরিপূর্ণ সমাজ। এই সমাজে মানুষ মানবিকতাবোধ, প্রথর চেতনা ও আত্মশক্তির অধিকারী হয়। এই সমাজে আগেকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটে এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। জনসাধারণের মধ্যে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ দেখা দেয়। এই সমাজ থেকেই মানুষ পায় পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠার শিক্ষা। এই সমাজেই সামাজিক নৈতিকতার বিকাশ সাধিত। সমাজতান্ত্রিক সমাজে সমাজতান্ত্রিক সমাজিকীকরণের উপর জোর দেওয়া হয় এবং জনমতের প্রাধান্যকে স্বীকার করা হয়। এই সমাজের উদ্দেশ্য হল শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী সকলের সাংস্কৃতিক মানকে অধিকতর বিকশিত করা। এই সমাজ মানুষের যাবতীয় সৃষ্টিশীল কার্যাবলীর পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।

উপসংহার: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হল এক অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। একে কোন স্থায়ী সমাজব্যবস্থা বলা যায় না। এই সমাজে শ্রেণী পার্থক্য ও শ্রমবিভাগ বর্তমান। সমাজতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক মানুষ তার কাজ অনুযায়ী মজুরী পায়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের গতি হল এই সমাজতান্ত্রিক সমাজ থেকে সাম্যবাদী সমাজের দিকে। সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণী পার্থক্য অনুপস্থিত। এখানে প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরী পায়। এ ধরনের সমাজে জীবনের প্রধান চাহিদা বলতে শ্রমকেই বোঝায়। মানুষ এখানে তার সামর্থ্য বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়ে থাকে। এই সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের একটি ধাপ হল সমাজতান্ত্রিক সমাজ।