ধনতান্ত্রিক সমাজের সংকট:

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের মূলধন, সঞ্চয় ও মুনাফা লুটবার লিপ্সা ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে যায়। শিল্প-সংগঠন, প্রযুক্তিবিদ্যা, উৎপাদন পদ্ধতি প্রভৃতির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থায় অধিকতর মূলধন বিনিয়োগ করা হতে থাকে। মূলধন বা পুঁজির দু’টি অংশ : অপরিবর্তনীয় অংশ (constant capital) এবং পরিবর্তনীয় অংশ (variable capital)। কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির জন্য ব্যয় হল অপরিবর্তনীয় অংশ এবং শ্রমিকের মজুরী হল পরিবর্তনীয় অংশ। এই সময় মূলধনের অপরিবর্তনীয় অংশ পরিবর্তনীয় অংশের থেকে বৃদ্ধি পায়। তার ফলে উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা হ্রাস পায়। এইভাবে ক্রমাগ্রসরমান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক সময় সংকটের সম্মুখীন হয়। মূলধন ব্যবহারের তুলনায় শ্রমিক পাওয়া যায় না এবং মুনাফার হারও হ্রাস পেতে থাকে। অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়াগের ফলে বাজারের চাহিদার তুলনায় বেশী দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদিত হয়। এই অতি-উৎপাদনের সংকটের মধ্যে ধনতন্ত্রে উৎপাদন বন্ধ ও উৎপাদন শক্তি নষ্ট করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয় এবং বেকার সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এই সময় উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়। উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হয় এবং উৎপন্ন পণ্যের দাম হ্রাস করা হয়। এই অবস্থার চাপে ছোট ও মাঝারি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক শেষ হয়ে যায়। তারা সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত হয়। অপরদিকে সংকটের হাত থেকে মুক্তির জন্য বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণী বিদেশী বাজার বা উপনিবেশের সন্ধান করতে থাকে। অর্থাৎ বিকাশের এই স্তরে বা সর্বোচ্চ স্তরে ধনতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের পথে পা বাড়ায়। এই সময় বিশ্ববাজার, পুঁজিপতিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, একচেটিয়া কারবার প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ধনতন্ত্রে উৎপাদন সামাজিক প্রকৃতি লাভ করে। লক্ষ লক্ষ কলকারখানায় অসংখ্য শ্রমিক একত্রে নিযুক্ত হয়। তার ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা সামাজিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়। এই সময় শ্রমের সামাজিকীকরণ ঘটে। অথচ উৎপাদনের উপায়ের কেন্দ্রীভবন বা উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা অব্যাহত থাকে। কিন্তু উৎপাদনের উপাদানের উপর সামাজিক মালিকানা ছাড়া উৎপাদনের সামাজিক প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অসামঞ্জস্যের জন্য ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংকটের সৃষ্টি হয়। দেখা যায় যে উৎপাদন-সম্পর্ক সমাজের উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারছে না। অর্থাৎ এক অনপনেয় অসংগতির সৃষ্টি হয়। তখন ধনতান্ত্রিক কাঠামোটি একেবারে অসংগতিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ধনতন্ত্রের বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে এই অসংগতি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট ও চরম রূপ ধারণ করে।

সমাজতন্ত্রের উদ্ভব:

এই অবস্থায় শোষিত শ্রমিক-শ্রেণী নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও সংগঠিত হতে থাকে। শোষক পুঁজিপতির এবং শোষিত শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে এবং এক সময় বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতন্ত্রের পতন ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে ধনতন্ত্রের অবলুপ্তির পরই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বীজ নিহিত থাকে। সর্বহারার বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধিত হয় এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ইতিহাসই হল শোষক পুঁজিপতি এবং শোষিত সর্বহারার দ্বন্দ্ব। পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রমিক-শ্রেণী নেতৃত্ব দেয়। বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে এই শ্রমিক শ্রেণীই হল যথার্থ প্রগতিশীল শক্তি ও বিপ্লবী শ্রেণী। বুর্জোয়াদের পুলিস ও সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণী জোর করে ক্ষমতা দখল করে। একে বলে সর্বহারার বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব:

সমাজতন্ত্র হচ্ছে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের একটি মধ্যবর্তী পর্যায় বিশেষ। এই পর্যায়ে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা এই সর্বহারা শ্রেণীর দখলে থাকে। সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীনে রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক গঠনমূলক কাজে নিযুক্ত থাকে। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে মেহনতী মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবে রূপায়িত হয়। সমাজ বিকাশের এই স্তরে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারণাসমূহকে অস্বীকার করা‌ হয়। জর্জ টমসন (George Thompson) বলেছেন : “The dictatorship of the proletariat means democracy for the people and dictatorship over the capitalists.” তখন পরিলক্ষিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভিত্তিক করা হয়। সমাজতান্ত্রিক আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ, তাদের সমাজতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক জীবনের উন্নয়ন, গণ-শিক্ষা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচীর বাস্তবায়নে রাষ্ট্র-ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। তবে এই পর্যায়েও শ্রেণী-সংঘর্ষের পরিপূর্ণ অবসান ঘটেনি। ক্ষমতাচ্যুত শোষক-শ্রেণী প্রতি-বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র-ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা করতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই প্রতি-বিপ্লব দমন করে শ্রমিক শ্রেণীর অর্জিত সুনামগুলিকে সংরক্ষণের চেষ্টা করে। সেইজন্য এই পর্বেও রাষ্ট্র-যন্ত্রের প্রয়োজন আছে। তবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শোষক বা শোষিত শ্রেণী নেই। এখানে যে যেমন কাজ করে সে তেমন উৎপন্ন সামগ্রীর ভাগ পায়। অর্থাৎ যে কাজ করবে না সে খেতেও পাবে না।

সমাজতন্ত্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য:

সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন-উপাদানগুলির উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে সমাজের সম্পদ-সামগ্রীর ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে সমষ্টির সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য। সমষ্টির স্বার্থেই উৎপাদন ব্যবস্থা ও শিল্প বাণিজ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। এখানে কোন পরশ্রমভোগী শোষক শ্রেণী থাকে না। তাই ব্যক্তিগত মুনাফার প্রশ্ন এখানে নেই। সামাজিক মুনাফা বৃদ্ধিই সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার লক্ষ্য। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি ও প্রাধান্য অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের ধন-সম্পদের ন্যায্য বণ্টন, প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, আয় ও ধনবৈষম্য হ্রাস, সর্বপ্রকার শোষণের অবলুপ্তি, এক কথায় সমাজের সামগ্রিক আর্থনীতিক উন্নয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। এইভাবে সমাজতন্ত্রে সামাজিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা সর্বহারা শ্রেণীর করায়ত্ত থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণীর ধ্বংস এবং সমাজতান্ত্রিক গঠন কার্যে নিযুক্ত থাকে।

সমাজতান্ত্রিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য:

সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। 

  • (১) সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় থাকে। 

  • (২) পূর্ববর্তী অন্যান্য সমাজব্যবস্থার মত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন পরশ্রমভোগী শ্রেণী থাকে না। এই ব্যবস্থায় বণ্টন বা সমাজ পরিচালনার নীতি হল, “যে কাজ করবে না, সে খেতেও পারে না।” 

  • (৩) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র দাস ব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত মুষ্টিমেয় শোষক শ্রেণীর পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণীর দখলে থাকে। 

  • (৪) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যে সাহায্য করে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহকে দমন করে।

  • (৫) এই ব্যবস্থায় শ্রেণী-শাসন বা শ্রেণী-শোষণ থাকে না। তবে ক্ষমতাচ্যুত পুঁজিপতি শ্রেণী প্রতি-বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে। 

  • (৬) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

  • (৭) এই ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষ সমমর্যাদাসম্পন্ন। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব থাকে না।