সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা: মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। পূর্বতন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রই হল আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রথম দৃষ্টান্ত। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতিক ব্যবস্থা অভিন্ন বা সমাজতন্ত্রের মৌলিক আদর্শগুলি সমানভাবে অনুসৃত হয়, তা বলা যায় না। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ছাড়াও মাও-সে-তুং-এর চিন্তাধারার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আবার পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির রাজনীতিক ব্যবস্থা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতির পুরোপুরি অনুগামী নয়। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির নাম হল উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, কিউবা প্রভৃতি। তবে বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। এখন বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। এই তিনটি দেশ হলঃ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, ভিয়েতনাম এবং কিউবা। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা বলতে মূলত কমিউনিস্ট দেশগুলির রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়। তবে বর্তমানে কতকগুলি দেশ গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সমাজতন্ত্রের মৌলিক আদর্শগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের (democratic socialism) ধারণাও উল্লেখযোগ্য।

পশ্চিমী লেখকদের মতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা সমগোত্রীয়: আপাতদৃষ্টিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সর্বাত্মক ব্যবস্থার কিছু সাদৃশ্য প্রতিপন্ন হয়। যে সকল দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী বা নাৎসীবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থার সমগোত্রীয় বলা হয়ে থাকে সেগুলি হল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি রাজনীতিক দল, একটি মতাদর্শের অস্তিত্ব ও তার প্রাধান্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক দলটির সর্বময় কর্তৃত্ব, ব্যক্তিস্বার্থ এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বার্থের অভিন্নতা প্রভৃতি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমী গণতন্ত্রের সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থার পর্যায়ভুক্ত করার পক্ষপাতী। এ প্রসঙ্গে স্যামুয়েল ফাইনার, অ্যালান বল প্রমুখ লেখকের নাম উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমী দুনিয়ার এই শ্রেণীর লেখকদের মতানুসারে বিশেষত মার্কিনী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে, ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণ প্রজাতন্ত্রী চীন প্রভৃতি দেশের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। আবার পশ্চিমী দুনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কারও কারও মতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে বটে, তবে সেই পার্থক্য নেহাতই নামমাত্র। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Most of the regimes generally described as totalitarian would seem to share one important characteristic, namely that their official ideology is essentially socialist, e.g. the Soviet Union, China, Vietnam, Cuba, North Korea and the states of Eastern Europe.” বল আরও মন্তব্য করেছেন: “…..the term ‘socialist’ would be a far more useful description of this type of regime that the term totalitarian. The term ‘socialist’ would certainly offer a clear contrast with liberal democracy.”

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সর্বাত্মক ব্যবস্থা এক নয়: পশ্চিমী লেখকদের উপরিউক্ত আলোচনা এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সর্বাত্মক ব্যবস্থাকে সমার্থক প্রতিপন্ন করার প্রয়াস সমর্থন করা যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি পক্ষপাতদুষ্ট এবং সংকীর্ণ। এই শ্রেণীর লেখকগণ উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামোতে রাষ্ট্রের ভূমিকার মৌলিক পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেননি। ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অগণতান্ত্রিক, মানবতাবিরোধী; উগ্রজাতীয়তাবাদী এবং আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর আরোপ করা যায় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল এর ঠিক বিপরীত। তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিপন্ন করা বিভ্রান্তিকর। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি আলাদা করে ব্যাখ্যা করা দরকার।