মার্কস-এঙ্গেল্সের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ শেষ হয়েছে মেহনতি মানুষের কাছে এক উদাত্ত আহ্বানের মাধ্যমে: “সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ এক হও” (“WORKING MEN OF ALL COUNTRIES, UNITE!”)। ম্যানিফেস্টোর এই বাণীটির মাধ্যমেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান এবং পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির স্বার্থে সমাজতন্ত্র অপরিহার্য। সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম এবং শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা অত্যন্ত জরুরী। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সময় থেকেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা শ্রমিক শ্রেণীর হাতে একটি মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Socialism therefore has an intrinsically international character.”
পৃথিবীর সকল দেশের মেহনতি মানুষের মৌলিক স্বার্থ অভিন্ন। ধনতান্ত্রিক শাসন-শোষণের উৎপাটনই শ্রমিক শ্রেণীর মূল স্বার্থ এবং এই স্বার্থ অভিন্ন। এই অভিন্ন স্বার্থের চেতনা ও প্রেরণা পৃথিবীর শ্রমজীবী জনতাকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করবে। এই উপলব্ধি প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের বনিয়াদ রচনা করে এবং দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর কাছে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাকে অপরিহার্য প্রতিপন্ন করে। যে কোন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বকে মার্কস স্বীকার করেছেন। মার্কসের মতানুসারে প্রত্যেক দেশের প্রলেতারিয়েতরা প্রথমে নিজের দেশের বুর্জোয়াদের সঙ্গে যাবতীয় বিষয়াদির মীমাংসা করবে (‘first of all settlematters with its own bourgeoisic)। মার্কস এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম পূর্বশর্ত হল পরাধীন জাতির স্বাধীনতা। পোলিস ও আইরিশদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করতে গিয়ে কার্ল মার্কস সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ববর্তী বিষয় হিসাবে জাতীয় স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের পার্থক্য বর্তমান। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মধ্যে জাতিতে জাতিতে মিলনের পরিবর্তে সংঘাতের কথাই নিহিত আছে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাতিগত অত্যাচারের ন্যায্যতা স্বীকার করার ব্যবস্থা করা হয়। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ হল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের এক কূট কৌশল। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ হল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ও প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা হল দুটি পরস্পর বিরোধী শত্রুভাবাপন্ন ধারণা। প্রলেতারিয়েতরা একটি জাতির উপর অন্য জাতির শোষণ-পীড়নের বিরোধিতা করে এবং অন্য জাতির উপর নিজের নির্যাতনেরও বিরোধিতা করে।
শ্রমিক শ্রেণীর জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সংঘাত নেই, বরং সংযোগ আছে। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরোধী, কিন্তু বিভিন্ন জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করে থাকে। তবে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদে প্রলেতারিয়েতের মুক্তির সংগ্রামকে ও আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় সংহতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতদসত্ত্বেও প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদে জাতীয় স্বার্থকে অবহেলা করা হয় না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ অনুসারে জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষের অবসান এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থির সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত হল বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতা ও অবাধ বিকাশকে সুনিশ্চিত করা।
লেনিন নতুন যুগে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কালোপযোগী ব্যাখ্যা দেন। ‘সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ এক হও’ —মার্কস-এঙ্গেলসের এই আহ্বানকে একটু বাড়িয়ে তিনি বলেন, ‘সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও’। হেউড বলেছেন: “Not only does proletarian class solidarity inevitably cut across national borders, but, as Marx pointed out, the emergence of world markets had turned capitalism into an international system that could only be challenged by a genuinely international movement. This is why Marx helped to found the International Workingmen’s Association, the so-called First International, in 1864.”
সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদ চূড়ান্ত বিচারে সাধারণ মানবিক গুণাবলী সম্পর্কিত বিশ্বাসের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ধারণার অর্থ হল মানবজাতি কতকগুলি গুণাবলীর দ্বারা সুসংবদ্ধ থাকে। এই গুণাবলীগুলি হল পারস্পরিক সহানুভূতি, সমবেদনা ও ভাব-ভালোবাসা। এ সবের ভিত্তিতে একটি ধারণা কাজ করে। এই ধারণাটি হল কিছু বিষয় মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। আবার কিছু বিষয় মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে। প্রথমোক্ত বিষয়াদি বৃহত্তর। হেউড বলেছেন: “… humankind is bound together by mutual sympathy, compassion and love, bassd upon the belief that what human beings share with one another is greater than what divides them.”
সমাজতন্ত্রবাদীরা প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদকে সাধারণত নিজেদের লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করেন না। এর উদ্দেশ্যে হল দুনিয়ার মানুষজনের মধ্যে সম্প্রীতি-সমঝোতা ও সহাযোগিতা প্রতিষ্ঠিত করা। সমাজতন্ত্রবাদীরা যেমন জাতিগত বিচারে বিশ্বকে ভাগাভাগি করতে চান না, তেমনি শ্রেণীগত বিচার বিবেচনার ভিত্তিতেও বিশ্ববাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চান না। সমাজতন্ত্রবাদীরা আন্তর্জাতিক শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে দুনিয়া জুড়ে মানবজাতির মধ্যে সম্ভাব-সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষপাতী। সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোর মধ্যে জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকবে। কিন্তু এটাই সব নয়। এই ধারণা অধিকতর র্যাডিক্যাল এবং কতকাংশে কল্পনাশ্রয়ী। বলা হয় যে, জাতির সীমারেখা অবশেষে অপ্রসারিত হবে। বিশ্বব্যাপী বসবাস করবে একটি মানবজাতি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী চিন্তাবিদ্রা জাতীয়তাবাদকে বুর্জোয়া মতাদর্শ হিসাবে বাতিল করে দিতে পারেন। কারণ হিসাবে বলা হয় যে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারণায় সমস্ত রকম বিরোধকে চাপ দেওয়া হয়। এই সমস্ত বিরোধের উপর পুঁজিবাদী এবং অন্য সকল শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, সমাজতন্ত্রবাদীদের আরও অভিযোগ হল যে জাতীয়তাবাদ সাধারণ মানবিক গুণাবলীকে অস্বীকার করতে অনুপ্রাণিত করে।
সমালোচনা (Criticism): সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদও বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধে নয়। বিরুদ্ধবাদীরা এই মতাদর্শগত অবস্থানের বিভিন্ন বিরূপ সমালোচনা করেছেন।
(ক) সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী সামাজিক বিপ্লবের সম্ভাবনার থেকে জাতীয়তাবাদ অধিকতর শক্তিশালী। জাতীয়তাবাদীদের অন্তর্নিহিত শক্তি-সামর্থ্য সাধারণ বিচারেই অনেক বেশী জোরদার।
(খ) রাজনীতিক জাতীয়তাবাদের সহনশীলতার শক্তিকে অনুধাবন ও স্বীকার করার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রবাদ সমর্থ হয়নি। এই ব্যর্থতা সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদী ধ্যান-ধারণার ক্ষতি করেছে। জাতীয়তাবাদকে একটি কৃত্রিম ও গুরুত্বহীন শক্তি হিসাবে অবজ্ঞা করার প্রবণতা সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতা আন্তর্জাতিকতাবাদী আদর্শের আবেদনকে অতিমাত্রায় বড় করে দেখার ব্যাপারে সমাজতন্ত্রবাদীদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রলেতারিয়েতরা এবং তাদের বেশ কিছু সমাজতান্ত্রিক দল যুদ্ধের আশঙ্কা ও জাতীয় গৌরবময় ঐতিহ্যের কাছে আগ্রহ সহকারে আত্মনিবেদন করেছে। এই কারণে ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (Second International) ব্যর্থ হয়েছে।
(গ) সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদীরা বাস্তবে অভিপ্রেত আদর্শের উচ্চস্তরে নিজেদের আচার-আচরণকে উন্নীত করতে পারেন নি। জাতিগত পার্থক্যসমূহ এবং ব্যক্তিগত ও মতাদর্শগত বিরোধিতা সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। তার ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক (Internationals) সফল হতে পারে নি।
Leave a comment