সমাজতন্ত্রের প্রকারভেদ
সমাজতন্ত্রবাদের বিভিন্ন রূপ বর্তমান। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রবাদের প্রকারভেদ পরিলক্ষিত হয়। রামসে ম্যুর এ বিষয়ে বলেছেন: “Socialism is a chameleon like creed. It changes its colour according to its environment. For the street corner and the club room, it wears the flaming scarlet of class war; for the intellectuals it is red shot with tawny; for the sentimentalists, it becomes a delicate rose pink, and in clarical circles it assumes a virgin-white, just touched with a faint flush of generous aspiration.” মূল বক্তব্য ও প্রকৃতিগত বিচারে সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে সমাজতন্ত্র বাদের দুটি ভাগের কথা বলা যায়। এই দুটি ভাগ হল:
-
মার্কসীয় বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ এবং
-
অ মার্কসীয় সমাজতন্ত্রবাদ।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ হিসাবে পরিচিত। মার্কস-এঙ্গেলসের সমাজতন্ত্রবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ হিসাবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের আবির্ভাব পরিলক্ষিত হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ কোথাও স্বীকৃত হয় এবং কোথাও অস্বীকৃত হয়। এ রকম এক পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের মধ্যে এক নতুন ধরনের সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব ঘটে। এই নতুন ধরনের সমাজতন্ত্রবাদ হল বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্রবাদ (Evolutionary Socialism)। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রবাদ সাধারণভাবে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ (Revolutionary Socialism) হিসাবে। বিবর্তনমূলক ও বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে অবহিত হওয়া আবশ্যক।
বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ
প্রথম দিককার সমাজতন্ত্রবাদীরা বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উৎপাদনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, সমাজতন্ত্রবাদ প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন হল প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বৈপ্লবিক পথে অপসারিত করা। তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন যে, এক্ষেত্রে উগ্র হিংস্রতা অবলম্বন অপরিহার্য। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের জন্য বিপ্লব হবে উগ্র হিংস্রতাযুক্ত। এ রকম বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের অন্যতম বিশিষ্ট প্রবক্তা ছিলেন অগস্ত ব্লানকুই (Auguste Blanqui)। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই ফরাসী সমাজতন্ত্রীর অভিমত অনুযায়ী নিবেদিত প্রাণ ষড়যন্ত্রীদের নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারী সমাজতন্ত্রীদের এই দল বৈপ্লবিক পথে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা প্রস্তুত করবে এবং পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িক করবে।
কাল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস প্রলেতারীয় বিপ্লবের কথা বলেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস ষড়যন্ত্রমূলক উগ্র হিংস্রতার কথা বলেন নি। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী শ্রেণিসচেতন শ্রমিক সাধারণ সংগঠিতভাবে পুঁজিবাদকে বাতিল করে দেবে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই পুঁজিবাদ অপসারিত হবে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯১৭ সালে প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই সময় লেনিনের নেতৃত্বে একদল সুশৃঙ্খল নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করে। রাশিয়ার এই বলশেভিক বিপ্লব পরবর্তী কালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সফল মডেল হিসাবে পরিগণিত হয়।
সমাজতন্ত্রীদের কাছে বিপ্লব হল একটি কৌশল, একটি পথ। কিন্তু এটাই সব নয়। সমাজতন্ত্রীরা বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের কাছে রাষ্ট্র হল শ্রেণিশোষণের একটি উপায় বিশেষ। পুঁজির স্বার্থে এবং শ্রমিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র শোষণ-পীড়ন কায়েম করে। মার্কসবাদীদের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক ক্ষমতার মাধ্যমে শ্রেণিস্বার্থসমূহের অভিব্যক্তি ঘটে। রাষ্ট্র সব সময়েই পুঁজির পক্ষ অবলম্বন করে। এই রাষ্ট্র হল বুর্জোয়া রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিক বিপ্লবের মাধ্যমে এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে উৎপাটিত করতে হবে। এই বৈপ্লবিক দায়িত্ব পালন করবে শ্রেণিসচেতন প্রলেতারিয়েতরা। মার্কসের মতানুসারে প্রলেতারিয়েতদের এই সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সাময়িককালের জন্য কায়েম হবে ‘সর্বহারাদের একনায়কত্ব’ (‘dictatorship of the proletariat’)। কারণ এই সময় ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়ারা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা করবে। এই প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সুরক্ষিত করবে সর্বহারাদের একনায়কত্ব।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে উন্নয়নশীল দুনিয়ার সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে বিপ্লবী পন্থাপদ্ধতির প্রতি বিশেষ আস্থা ও বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে ফ্রানজ ফ্যানন (Frantz Fanon) নামে এক ফরাসী বিপ্লববাদী তাত্ত্বিকের অভিমত বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি তাঁর The Wretched of the Earth শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামে সহিংস ও সশস্ত্র বিদ্রোহ একাধারে একটি রাজনীতিক প্রয়োজন এবং মনস্তাত্ত্বিক বিচারে একটি অভিপ্রেত বৈশিষ্ট্য। ফ্যাননের ব্যাখ্যা অনুসারে দীর্ঘকালীন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পরিণামে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে হীনম্মন্যতা ও দুর্বলচিত্ততা দৃঢ়মূল হয়ে গেছে। আফ্রিকার এই কৃষ্ণকায় জনসম্প্রদায়গুলিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। তারজন্য বিপ্লব-বিদ্রোহ ও রক্তক্ষয়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়া-আফ্রিকার উন্নয়নশীল দুনিয়ার দেশগুলিতে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সশস্ত্র বিপ্লবের সাফল্যের সুবাদে পূর্বতন রাজনীতিক ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ অনায়াসে অপসারিত করা সম্ভব হয়। অতঃপর একেবারে নতুন এক আর্থ সামাজিক ও রাজনীতিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। এই সব ক্ষেত্রে স্তালিনের আমলে সমাজতন্ত্র সাধারণত সোভিয়েত মডেলের অনুগামী হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই সোভিয়েত মডেলটি হল রাষ্ট্রীয় সমষ্টিবাদী মডেল। বিপ্লবোত্তর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রাজনীতিক পীড়নমূলক প্রবণতা ও একনায়কতান্ত্রিক ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক শাসকরা বলপ্রয়োগটিকে সরকারী নীতির বৈধ হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করেন। ক্ষমতা দখল করার পর বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলগুলি সাধারণত সামরিক ধাঁচের সাংগঠনিক কাঠামো গ্রহণ করে। শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং কঠোর শৃঙ্খলার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। পূর্বতন ব্যবস্থার অদৃশ্যপ্রায় যাবতীয় চিহ্নকে মুছে ফেলা হয়। সকল বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করা হয়। সামগ্রিকতাবাদী একনায়কতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য সহায়ক পরিবেশ-পরিমণ্ডল গড়ে তোলা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের উদ্দেশ্যে অনেক ক্ষেত্রেই ‘জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’ সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সমকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্থির নিশ্চিত হয়ে যান যে, আলাপ-আলোচনা ও নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকদের অপসারিত করা যাবে না। স্বভাবতই এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সশস্ত্র বিপ্লব-বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই ১৯৪৯ সালের চীনের বিপ্লবের কথা বলা দরকার। মাও জেদং (Mao Zedong) -এর নেতৃত্বে জাপান এবং ‘কুয়োমিনটাং’ Kuomintang) নামে পরিচিত জাতীয়তাবাদী চীনাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন সামরিক প্রচার পরিচালিত হয়। ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লবের সাফল্য এশিয়ার সমাজতন্ত্রীদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করে।
ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধ সুদীর্ঘকাল ধরে চলেছে। প্রথমে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে, পরবর্তী কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের ঐক্যসাধন সম্পন্ন হয়।
বিশিষ্ট আর্জেন্টেনীয় বিপ্লবী চে গুয়েভারা (Che Guevara) দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। ১৯৫৯ সালের কিউবার বিপ্লবের সময় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় গুয়েভারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। চূড়ান্তভাবে মার্কিন মদতপুষ্ট বাতিস্তা সরকার অপসারিত হয় এবং ফিদেল কাস্ত্রো (Fidel Castro) ক্ষমতাসীন হন।
১৯৮৯-‘৯১ সালে প্রতিবিপ্লবী প্রক্রিয়ার পরিণামে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। এই ঘটনার প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অবক্ষয় ঘটে। বর্তমানে বিপ্লববাদী সমাজতন্ত্রবাদ টিকে আছে গুটি কয়েক ছোট্ট পকেটে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পেরু এবং নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহীদের কার্যকলাপের কথা বলা যায়। যাইহোক পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার আকৃতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। ১৯১৭ সালের সফল সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। অতঃপর সমাজতন্ত্রবাদ শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়।
Leave a comment