ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়া হিসাবে সমাজতন্ত্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু কেবল এই বক্তব্যের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রবাদের উৎস অনুসন্ধান অসম্ভব। সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য প্রাথমিকভাবে এই মতবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করা আবশ্যক।
এবেনস্টেইন (Willium Ebenstein) -এর অভিমত অনুসারে। এবং কোথায় প্রথম সমাজতন্ত্রবাদের আবির্ভাব ঘটেছে তা বলা সহজ নয়। অনেকের অভিমত অনুসারে গ্রীক্ দার্শনিক প্লেটোর প্রজাতন্ত্রেই প্রথম সমাজতন্ত্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ প্লেটোর প্রজাতন্ত্রে শাসকশ্রেণীর নিজস্ব কোন সম্পদ ছিল না। সকলে সব কিছুরই সমান অংশীদার ছিল। অনেকে আবার সমাজতন্ত্রবাদের উৎস হিসাবে বাইবেল, বিশেষত ‘ওল্ড টেস্টামেন্টের কথা বলেন। মহাজন (V. D. Mahjan) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “During the Middle Ages, various sects and movements attacked wealth and com merce considering them to be wicked. During the Renaissance and the Reformation there was a revival of protest against inequality based on wealth. The conclusion of Ebenstein is that ‘despite all such illustrations, socialism as a major political force can property be said to have originated as a result of industrial capitalism’.”
ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গণরাজ্য: বস্তুত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনায় আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের অস্তিত্ব অনুপস্থিত। বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ এবং ‘মোজেজ-এর অনুশাসন’ (Mosaic Law)-এর মধ্যে নারী, শিশু ও শ্রমিকের সমানাধিকারের কথা আছে। অনেকের মতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রথম উল্লেখ এখানেই বর্তমান। কিন্তু আধুনিক সমাজতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্টে চিত্রিত সামাজিক অবস্থার কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে গ্রীক চিন্তাবিদ্ প্লেটোর ‘গণরাজ্য’ (The Republic) গ্রন্থটি উল্লেখ করেন। এই গ্রন্থে উল্লিখিত আদর্শ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বলে অনেকের দাবি। কিন্তু প্লেটো একমাত্র অভিভাবক শ্রেণীর জন্যই যৌথ ভোগ ব্যবস্থার (common consumption) কথা বলেছেন। তা ছাড়া প্লেটোর সমভোগবাদ অর্থনৈতিক বিষয় অপেক্ষা আধ্যাত্মিক বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। আধুনিক অর্থে একে সমাজতন্ত্র বলা যায় না।
মধ্যযুগ: মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টান ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি সম্পত্তির যৌথ মালিকানাকে অর্থনৈতিক আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। অনেকে এর মধ্যে সমাজতন্ত্রবাদের উৎস খোঁজেন। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রীষ্ট-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছে। আবার অনেকে চতুর্দশ ও ষোড়শ শতাব্দীর কৃষক বিদ্রোহগুলিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মনে করেন। ফ্রান্সের কৃষক বিদ্রোহ (১৩৫৮), ইংল্যাণ্ডের কৃষক বিদ্রোহ (১৩৮১) এবং জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহ (১৫২৫)-এর মূল দাবী ছিল সামাজিক উৎপাদনের যৌথ ও সমবণ্টন। কিন্তু এই সমস্ত আন্দোলনের নেতাদের যৌথ উৎপাদন-ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা বা সুস্পষ্ট কোন রাজনীতিক লক্ষ্য ছিল না। ঐসব কৃষক-আন্দোলন ছিল কার্যত সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান।
আধুনিক যুগ—টমাস ম্যুর: সমাজের ধনবৈষম্য সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা আরম্ভ হয় নবজাগরণ (Renaissance) ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Reformation)-এর পর। টমাস ম্যুর (Thomas Moore) – এর ইউটোপিয়া (Utopia) প্রকাশিত হয় ১৫১৬ সালে। এই গ্রন্থে ম্যুর সকল সামাজিক অশান্তির মূল কারণ হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে দায়ী করেন। তিনি সমাজের সমগ্র উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসাবে যৌথ মালিকানার কথা বলেন। তাঁর আদর্শ রাজ্যের ভিত্তি হিসাবে তিনি সাম্যবাদের কথা বলেন। ম্যুরের এই আদর্শ পরবর্তীকালে ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্র’ হিসাবে গণ্য হয়।
ফরাসী বিপ্লব ও বেবিউফ্: ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) সমাজতন্ত্রের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিহাসে এটি বুর্জোয়া বিপ্লব হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এই বিপ্লবের তিনটি মৌল আদর্শ—সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা— ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে। ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা বেবিউফ (Francois Noel Babeuf) সাম্যবাদী ছিলেন। তিনি বৈপ্লবিক উপায়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও সমাজের আমূল পরিবর্তনের কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর এই প্রগতিশীল প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাঁর প্রাণদণ্ড হয়।
কাল্পনিক সমাজতন্ত্র: ঊনবিংশ শতাব্দিতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। সমকালীন তিনজন সমাজতন্ত্রী ফ্রান্সের সেন্ট সাইমন ও চার্লস ফ্যুরিয়ার এবং ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন সমাজতন্ত্রের যে আদর্শ প্রচার করেন তা ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ’ (Utopian Socialism) হিসাবে পরিচিত। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের মতানুসারে সামাজিক সমস্যার মূল কারণ হল দারিদ্র্য এবং এই দারিদ্র্যের মূল কারণ হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সমাজের যাবতীয় অসাম্যের মূল কারণ হিসাবে তাঁরা অবাধ নীতিকে দায়ী করেছেন। কিন্তু তাঁরা শ্রেণী-দ্বন্দ্ব বা শ্রেণী-সংগ্রামের কথা বলেননি। তাঁরা সমাজের ক্ষমতা ও সম্পত্তিবান শ্রেণীর ন্যায়বোধ ও যুক্তির কাছে আবেদনের মাধ্যমেই বাঞ্ছিত পরিবর্তন ও ঈপ্সিত সমাজ গঠন সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের সমবায় সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সমাজতন্ত্রের বিকাশে তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ধনতান্ত্রিক সমাে ত্রুটিগুলি সম্পর্কে তাঁরা সম্যক অবহিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা সমাজ পরিবর্তনের মূল সূত্রগুলি অনুধাবন করতে পারেননি। এঁদের প্রচেষ্টাতেই ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম এমনকি আমেরিকাতেও সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র: ‘চ্যার্টিস্ট আন্দোলন’ (Chartist Movement) ইংল্যাণ্ডে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করে। এ হল রাজনীতিক অধিকার হরণ ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলন। ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতিক আন্দোলন হিসাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সমাজতন্ত্রবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’ (Communist Manifesto) প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও ধ্যান-ধারণার ব্যাপক বিস্তারের ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌল নীতিসমূহ ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহারে’ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। সমাজতন্ত্রবাদ এই দুই বিশ্ববন্দিত চিন্তাবিদের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
বস্তুত সমাজতন্ত্রবাদের বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে উদারনীতিবাদের মত সমাজতন্ত্রবাদেরও উৎপত্তি ঘটেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ইউরোপে শিল্প পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে বিশেষ এক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। তারই বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব হয়। উদারনীতিক বাজার সমাজব্যবস্থার সমালোচনা হিসাবে সমাজতন্ত্রবাদের সৃষ্টি। শিল্প পুঁজিবাদের বিকল্প হিসাবেই সমাজতন্ত্রবাদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অথচ সমাজতন্ত্রবাদ ও উদারনীতিবাদ এই দুই মতাদর্শের আবির্ভাবের মূল নিহিত আছে কুসংস্কারমুক্ত এক প্রবুদ্ধ পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে এবং উভয় মতাদর্শই যুক্তিবাদ ও প্রগতিমূলক নীতিসমূহে বিশ্বাসী।
শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকে শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে দারিদ্র্য ও জীবনধারায় অবনমন দেখা দেয়। এই নতুন ও উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণীর উন্নয়নের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ধারণাসমূহ সত্বর সংযুক্ত হয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘অবাধ নীতি’ (laissez-faire)-র সুবাদে কারখানায় কাজের পরিস্থিতি ও শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারণের ব্যাপারে কারখানার মালিকরা অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময় শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণীর কাজের পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মান ছিল অমানবিক। শিল্প শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি মালিক শ্রেণীর এই নিষ্ঠুর আচরণ গোড়ার দিককার সমাজতন্ত্রবাদের প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। স্বভাবতই প্রথম দিককার সমাজতন্ত্রবাদীরা শিল্প পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে র্যাডিক্যাল ও বৈপ্লবিক বিকল্পের অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। শ্রমিক শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নতি ঘটে। রাজনীতিক গণতন্ত্র বিকশিত হয়। পশ্চিম ইউরোপের উন্নত শিল্প সমাজগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনধারায় অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়। এই সমৃদ্ধ শ্রমিক শ্রেণীকে একটি বৈপ্লবিক শ্রেণী হিসাবে বিবেচনা করা যাবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। সমকালীন পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রবাদের প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। এই সময় শ্রমিক শ্রেণীও ভোটাধিকার লাভ করে। এ রকম এক পরিবর্তিত পরিমণ্ডলে গণতান্ত্রিক দলগুলি আইনমূলক ও শাসনতান্ত্রিক উপায়-পদ্ধতি অধিক মাত্রায় অবলম্বন করতে আরম্ভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। কতকগুলি সমাজতান্ত্রিক দল সংস্কারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পথে অগ্রসর হয়। অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক দলগুলি শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করে। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক দলগুলি বৈপ্লবিক পন্থাপদ্ধতির উপর ঘোষিত সাবেকি আস্থাকে অব্যাহত রাখে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক দলগুলির মধ্যে বিভাজনকে সুস্পষ্ট করে দেয়। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদীরা লেনিনের পথের অনুগামী হন। বলশেভিকরা ‘কমিউনিস্ট’ (Communist) নাম ধারণ করেন। অপরদিকে সংস্কারপন্থী সমাজতন্ত্রীরা সমাজতান্ত্রিক (Socialist) বা সামাজিক গণতান্ত্রিক (Social democrat) নামে পরিচিতি পায়।
১৯৪৫ সালের পরবর্তী কালে পূর্ব ইউরোপে বলশেভিক মডেলের কমিউনিস্ট মতাদর্শ (Communism) প্রবর্তিত হয়। ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনেও এই কমিউনিস্ট মতাদর্শ গৃহীত হয়। পরবর্তী কালে উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া এবং লাওসে এই মার্কসবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। অন্য কিছু কিছু দেশে অপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতে সুদীর্ঘকাল ধরে কংগ্রেস সরকার মধ্যপন্থী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ গ্রহণ করেছে।
১৯৫৯ সালে বিপ্লবের পর কিউবায় ক্ষমতাসীন হন কাস্ত্রো (Castro)। তিনি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে গভীর সংযোগ-সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। বস্তুত বিংশ শতাব্দীতে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। এই সমস্ত অনেক দেশেই শিল্প পুঁজিবাদের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না, অথবা অল্প কিছু অভিজ্ঞতা থাকলেও তা ছিল নিতান্তই নগণ্য। এই সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্রবাদের বিকাশ ঘটেছে শ্রেণীসংগ্রামের সুবাদে নয়; ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামের সূত্রেই। এই সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে এক ধরনের সংমিশ্রণ সম্পাদিত হয়েছিল। শ্রেণিশোষণের জায়গায় প্রাধান্য পেয়েছিল ঔপনিবেশিক পীড়ন।
আফ্রিকায় ঐতিহ্যবাদী উপজাতীয় সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বাতন্ত্র্যমূলক সমাজতন্ত্রবাদের প্রচলন ঘটেছিল। অপরদিকে ইসলাম ধর্মের নৈতিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আরবে সমাজতন্ত্রবাদের বিস্তার ঘটেছিল। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ও সত্তরের দশকে আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা সামরিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে সমাজতন্ত্র প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত রাজনীতিক শক্তির অভ্যুত্থান ঘটে। অনেকে এই পরিস্থিতিকে সমাজতন্ত্রের অবসান হিসাবে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৮৯-১৯৯১– এই সময়কালের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বিপ্লবের পরিণামে কমিউনিস্ট মতাদর্শের অবসান। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বহু সমাজতান্ত্রিক দল এমন সব নীতি, ধ্যান-ধারণা ও কর্মসূচী গ্রহণ করে যা সাধারণভাবে বহুলাংশে উদারনীতিবাদ এবং এমন কি রক্ষণশীলতাবাদের সমগোত্রীয়।
Leave a comment