সমাজতন্ত্রবাদের অর্থ ও প্রকৃতি পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই মতাদর্শের কতকগুলি মৌল উপাদান স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। সমাজতন্ত্রবাদের এই মৌলিক উপাদানসমূহ নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।
এক: সমাজতন্ত্রবাদে ব্যক্তির থেকে সমাজের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মনে করা হয় যে সামগ্রিক কল্যাণের মাধ্যমেই ব্যক্তির কল্যাণ সাধন সম্ভব। ব্যক্তিজীবনের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। ফ্রেড ব্রামলে মন্তব্য করেছেন: “Socialism implies the subordination of the interests of the individual to the interests of the society.” আলফ হেল্ড এ বিষয়ে বলেছেন: “We may define as socialistic every tendency which demands the subordination of the individual’s will to the Community.”
দুই: সমাজতন্ত্রবাদ অনুসারে পুঁজিপতি শ্রেণী হল শ্রমিক শ্রেণীর স্বাভাবিক শত্রু। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ধনবৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সমাজব্যবস্থায় বিত্তবানের বিত্ত এবং দরিদ্রের দারিদ্র্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাষ্ট্র-শক্তি এখানে প্রভুত্বকারী মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীনের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়। এই কারণে সমাজতন্ত্রবাদ ধনতন্ত্রবাদের সম্পূর্ণ অবসান চায়।
তিন: সমাজতন্ত্রবাদে পুঁজিবাদের বিরোধিতা করার পিছনে কতকগুলি কারণের উপর জোর দেওয়া হয়। পুঁজিবাদে মুনাফাকেই সর্বাধিক করার কথা বলা হয়। সর্বসাধারণের কল্যাণে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হয় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টন পরিলক্ষিত হয়। সমাজতন্ত্রবাদে বলা হয় যে, সমাজের প্রয়োজন অনুসারে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে এবং বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে সামাজিক ন্যায়নীতি অনুসারে। এ সবের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রবাদে পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা হয়।
চার: সমাজতন্ত্রবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী। বস্তুত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে সমাজতন্ত্রবাদের। গ্রে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “As the words are commonly understood, socialism is ordinarily regarded as opposed to individualism.”
পাঁচ: সমাজতন্ত্রবাদে অবাধ প্রতিযোগিতার নীতিকে স্বীকার করা হয় না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অবাধ প্রতিযোগিতার অর্থ অসম প্রতিযোগিতা। এই অসম প্রতিযোগিতায় শ্রমিক শ্রেণীর শোষণ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তা ছাড়া অতি-উৎপাদন, একচেটিয়া কারবার প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ বেকারত্ব ও দুঃখ-দারিদ্র্যের শিকার হয়। হ্যাডেন গেস্ট এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Socialism is, to my mind, the substitution of cooperation for competition in local, national and international affairs.”
ছয়: সমাজতন্ত্রবাদে সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই মতবাদে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাম্য বলতে সকলের আত্মবিকাশের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভকে বোঝান হয়। তুগান বারানউস্কি (M. Taugan Baranowsky) এ বিষয়ে বলেছেন: ‘‘The ideal of equality of man must be recognised as the fundamental ethical tenet of modern socialism.”
সাত: সমাজতন্ত্রবাদে মনে করা হয় যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল শোষণের হাতিয়ার বা শোষণমূলক সমাজের ভিত্তি। তাই সমাজতন্ত্রবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির মাধ্যমে শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রবার্ট ব্লাচফোর্ড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “No man has right to call any thing his own but that which he himself has made. No man makes land. The land is not created by labour, but it is the gift of God to all. It belongs to the people. Consequently, under socialism, no citizen should be allowed to call a single inch of land his own.” এ বিষয়ে গ্রে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Socialism demands the abolition of private ownership of much (if not all) wealth, and requires that the wealth so transferred should in some way be vested in, and operated by the community as a whole.”
আট: সমাজতন্ত্রবাদ অনুসারে ব্যক্তির কল্যাণ সাধনের জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ একান্তভাবে কাম্য। তাই শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি প্রভৃতি উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
নয়: সমাজতন্ত্রবাদে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবসানের কথা বলা হয়। বলা হয় যে, পুঁজিবাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগেরও অবসান আবশ্যক। উৎপাদনের সকল উপাদান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা দরকার। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের জাতীয়করণ বা সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হবে। টম জনস্টনের মতানুসারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ হল ব্যক্তিগত সঙ্গতি (Private enterprise means private robbery.”)। এ বিষয়ে বার্নস বলেছেন: “Socialism means abolition of Private enterprise and the substitution of collective ownership and control for the benefit of the whole society, at least the principal instrument of production, distribution and exchange.”
দশ: সমাজতন্ত্রবাদকে যুক্তি প্রদানকারী শক্তি হিসাবে দেখা হয়। সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হল মেহনতী মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করা এবং জনসাধারণের কাছে অধিকারকে অর্থবহ করে তোলা। গ্রে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Socialism invariably represents itself as a liberating force; its purpose is to deliver the proletariat from his chains, to give real content to rights which may be ineffective and nominal in present conditions.”
Leave a comment