অথবা, সমাজজীবনে সাংস্কৃতিক উপাদানের ভূমিকা আলােচনা কর।
অথবা, সমাজজীবনে সাংস্কৃতিক উপাদানের অবদান বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সমাজজীবন একটা দীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে মানুষের জীবনযাত্রায় নানা ধরনের রীতিনীতি, আচার, ব্যবহার তার দৈনন্দিন জীবনের সাথে চালিত হয়। আর জীবনের প্রয়ােজনে মানুষ যা গ্রহণ করে, আবিষ্কার করে, এবং যার সাথে খাপখাওয়ায় তার সবকিছুর সমন্বয়ই সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে।
সমাজজীবনে সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রভাব/অবদানঃ
(ক) ব্যক্তি জীবনে সংস্কৃতির প্রভাবঃ ব্যক্তি জীবনের ওপর উৎপাদন কৌশল/সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। নিম্নে ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব আলােচনা করা হলাে-
(১) সংস্কৃতি নির্ভর আচার আচরণঃ সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজবদ্ধ মানুষ আচার ব্যবহারের এক নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা ধারা লাভ করে। সমাজজীবনে বাস্তবে বহু ও বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং অনেকক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সুস্থ সমাজ জীবনের স্বার্থে এর সন্তোষজনক মােকাবেলা প্রয়ােজন। এজন্য সর্বক্ষেত্রের বিভিন্ন পরিস্থিতি এড়িয়ে কীভাবে সংস্কৃতির মাধ্যমে এর সমাধান পাওয়া যায় তা দেখতে হবে। সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণের পদ্ধতিগত কৌশল আয়ত্ত করা সম্ভব।
(২) যথার্থ মানুষ তৈরিঃ সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজের নানা নিয়ামকের সমন্বয় ঘটে। যেখানে মানুষ তার প্রাত্যহিক প্রয়ােজন। মেটায় এ সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। সংস্কৃতি মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তােলে এবং যথার্থ সামাজিক জীবে পরিণত করে। সমাজ ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের বাইরে যদি কোনাে ব্যক্তিকে রাখা হয়, তাহলে তার পক্ষে মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব হয় না। সুস্থ সংস্কৃতির ধারা মানুষের মধ্যে একটা নৈতিক ভিত্তির বীজ বপন করে। যার ফলাফল সমাজের মধ্যেদিয়ে প্রকাশ পায়।
(৩) বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যাঃ সংস্কৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিমাত্রই তার কর্তব্য নির্ধারণ করে। একটি সমাজের বিদ্যমান সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে সেই সমাজের ঐতিহ্য, জীবনধারা এবং কুসংস্কারের মত বিভিন্ন বিষয়। তবে সংস্কৃতির আলােকে কোনাে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গেলে সেখানে দেখা যায় যে, এটা সমাজ এবং পরিবেশ ভেদে বৈচিত্র্য আনে।
(খ) গােষ্ঠী জীবনে সংস্কৃতির প্রভাবঃ গােষ্ঠী জীবনের ওপরও সংস্কৃতির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ অপরিসীম। নিম্নে গােষ্ঠী জীবনে সংস্কৃতির প্রভাব আলােচনা করা হলাে-
(১) একাত্মতাবােধঃ যেকোনাে গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সংস্কৃতি আমরা ‘বােধ’ (we fceling) এর সষ্টি হয়। গােষ্ঠীর সদস্যের সবাইকে সমাজে বসবাস করতে গিয়ে প্রেম-প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। যা সুষ্ঠ গােষ্ঠী জীবনের স্বার্থে গােষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে একটা একাত্মতাবােধ তৈরি করে। ফলে সহযােগিতা, সহমর্মিতবােধ এবং হৃদ্যতার বন্ধন তৈরি হয়। মূলত সংস্কৃতির বন্ধন মানুষের জীবনযাত্রায় এক অনন্য আদর্শবােধের ধারাকে সমনত রাখে।
(১) সামাজিক সংহতি সংরক্ষণঃ সুস্থ, সুন্দর এবং জীবনযাত্রাকে একটা ভালাে পরিবেশের মধ্যে টিকিয়ে রাখতে হলে সেই সমাজের সংহতি আশু প্রয়ােজন। সামাজিক সংহতি ছাড়া সমাজের কোনাে কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়। ফলে গােটা জীবনব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। মূলত; সংস্কৃতির ধারা কোনাে সমাজের সংহতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তাই গােষ্ঠী ও সামাজিকজীবনে সংস্কৃতির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
(৩) জ্ঞানার্জনের আগ্রহ তৈরিঃ সংস্কৃতির ধারা সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা তৈরি করে। সমাজবদ্ধ মানুষের এ আগ্রহ নিরসনের ক্ষেত্রেও সংস্কৃতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বস্তুত, গােষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিপ্রেত অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি করে। তাই ব্যক্তি, সমাজ এবং গােষ্ঠী জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংস্কৃতি জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ সৃষ্টিতে বেশি সহায়ক।
(৪) সুস্থ গােষ্ঠীজীবন সম্ভবঃ সংস্কৃতি হলাে সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবােধের ধারক-বাহক। গােষ্ঠীজীবনে ব্যক্তি মানুষের আচার-ব্যবহারকে সংস্কৃতি যুক্তিসঙ্গত ও দায়িত্বশীল করে তােলে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির অবদান অনস্বীকার্য। সংস্কৃতি গােষ্ঠীজীবনে সামাজিক সম্পর্কে ধারাকে সঠিক ও অব্যাহত রাখে। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি ব্যতিরেকে গােষ্ঠীজীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব।
(৫) মূল্যবােধের উপর প্রভাবঃ সংস্কৃতি সমাজের বিশ্বাস ও মূল্যবােধের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সংস্কৃতির কারণে মূল্যবােধের যে পরিবর্তন হয় তা এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে এক দেশ থেকে অন্যদেশে ভিন্নতর হয়। আফ্রিকার কোনাে অঞ্চলে মােটা মেয়ে সুন্দরী বলে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে যা বুঝায় তার সাথে আফ্রিকার সুন্দরের ধারণা ভিন্ন।
(৬) আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টিঃ সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তজার্তিকভাবে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময় বা আদান-প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের আন্তঃসম্পর্ক ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজজীবনের ওপর সংস্কৃতি বিশেষ করে উৎপাদন কৌশলের প্রভাব খুব বেশি। কেননা, উৎপাদন কৌশলই সমাজজীবনকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজ পরিবর্তনে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই বলা যায়, সমাজজীবনে উৎপাদন কৌশল তথা সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম।
Leave a comment