প্রশ্নঃ সমাজজীবনে প্রযুক্তির ভূমিকা আলােচনা কর।

অথবা, সমাজ জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রযুক্তির কল্যাণে আজ মানবসমাজ উন্নতির চরম শিখরে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা মানবসভ্যতাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। আবার প্রযুক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে নানাভাবে। তাই প্রযুক্তির সমন্বয়ে মানবসমাজ এবং মানবজীবন আজ হয়ে ওঠেছে কল্যাণমুখী। ফলে আধুনিকমনস্ক মানুষের চেতনায় প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।

সমাজজীবনে প্রযুক্তির প্রভাব/ভূমিকাঃ আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার অগ্রসারমান ধারায় সমাজের প্রতিটি উন্নয়নের সিঁড়িতে যে সত্তাটি চরম উৎকর্ষতা অর্জনে সাহায্য করে সেটি হলাে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে করেছে সহজবােধ্য, গতিশীল এবং স্বাচ্ছন্দ্যময়। সমাজজীবনে প্রযুক্তির প্রভাবকে দুই দিক থেকে আলােচনা করা যায়। যথাঃ ইতিবাচক দিক ও নৈতিবাচক দিক। নিম্নে এ দু’টির আলােকে সমাজজীবনে প্রযুক্তির প্রভাব তুলে ধরা হলাে-

ইতিবাচক দিকঃ সমাজজীবনে প্রযুক্তির ব্যবহারের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। যথা-

(১) অর্থনৈতিক অগ্রগতিঃ প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যেখানে অনেক ভঙ্গুর অর্থ ব্যবস্থায় টেকসই ভিত্তি তৈরি হয়েছে। মূলত প্রযুক্তির ব্যবহার অর্থনীতিকে করেছে গতিশীল ও কল্যাণকর।

(২) উৎপাদন বৃদ্ধিঃ মানুষের জীবনধারণের জন্য কোনাে না কোনাে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে হয়। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে কৃষি খামার হতে বৃহদায়তন শিল্প পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। আর এ কৃষি, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানও হয়েছে যথেষ্ট উন্নত।

(৩) কর্মসংস্থান সৃষ্টিঃ প্রযুক্তির বিশেষ কল্যাণে আজ সমগ্র বিশ্বব্যাপি গড়ে ওঠেছে শিল্প, কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। যেখানে মানুষ নিজেকে সম্পৃক্ত করছে নানাভাবে। ফলে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে বেকারত্বের হার অনেক কমে আসছে।

(৪) শ্রম বিভাজনঃ প্রযুক্তির একটা অন্যতম ফলাফল হলাে কর্মক্ষেত্রে শ্রম বিভাজন। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। বর্তমানে শিল্প কারখানায় একজন মানুষ সমগ্র পণ্য উৎপাদনের সাথে নিয়ােজিত থাকে না। যে ব্যক্তি যে কাজে পারদর্শী তাকে সেটিই পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এভাবে শ্রম বিভাজনের দ্বারা উৎপাদন সম্পন্ন হয়।

(৫) শ্রমের গতিশীলতাঃ প্রযুক্তির উত্তরণের ফলে আজ সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে বহুমুখী পেশা। ফলে শ্রমিক তার ইচ্ছামতাে পেশার পরিবর্তন করে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রাখছে। যা শ্রমের মানকে যেমন সমৃদ্ধ করছে তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনছে।

(৬) যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ প্রযুক্তি যােগাযোেগ ক্ষেত্রে এনেছে একটা চরম বিস্ময়। আজ মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অপর প্রান্তের খবর নেয় অনায়াসে। যেখানে প্রযুক্তির অভাবনীয় আবিষ্কার রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট,ই-মেইল, ফ্যাক্স, মােবাইল, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে সার্থক।

(৭) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণঃ কোনাে দেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা সম্পদ এবং অভিশাপ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। বর্তমানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটা অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে প্রযুক্তির আবিষ্কৃত বিষয়গুলাে এখানে সুফল বয়ে আনছে। যেমন জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি, লাইগেশন, কনডম ইত্যাদি। আর জনসংখ্যা কম থাকায় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

(৮) সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামােগত পরিবর্তনঃ প্রযুক্তির ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলাের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফলে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে গিয়ে একক পরিবার প্রথা গড়ে উঠছে। বিবাহের ক্ষেত্রেও ছেলে মেয়েদের মতামতের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া মানুষ যৌক্তিকভাবে ধর্মকে বুঝতে শিখছে।

(৯) ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশঃ প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পূর্বের অনেক ভ্রান্ত ধারণা বা কুসংস্কার দূরীভূত হয়েছে এবং যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন নতুন সংস্কৃতি প্রযুক্তির কল্যাণের কারণে বিশ্ব সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের লেনদেন শুরু হয়েছে।

(১০) সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তনঃ সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা মান মর্যাদার দিক থেকে অনেক উপরে। আর প্রযুক্তির বিভিন্ন আবিষ্কারসমূহ তাদের কল্যাণে ব্যবহার করছে। ফলে সমাজের সকল মানুষ থেকে তাদের অবস্থান এবং মর্যাদা ভিন্নভাবে তৈরি হয়। মূলত প্রযুক্তি সামাজিক মর্যাদায় পরিবর্তন আনে।

(১১) কল্যাণকর আবিষ্কারসমূহঃ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার অন্যতম ফলাফল হচ্ছে এর আবিষ্কারসমূহ। যেখানে শুধু সাধারণ মানুষ নয় বরং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য চলাচলের যন্ত্র, তাদের শিক্ষামূলক বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্ভাবনসমূহ জীবনকে করছে নানাভাবে প্রভাবিত। মূলত এসব কল্যাণকর আবিষ্কারসমূহ মানুষের জীবনকে করছে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক আছে তবুও আজকের দিনে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া মানবজীবনকে কল্পনা করা যায় না। আজ মানুষ প্রযুক্তির উদ্ভাবক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রযুক্তির দ্বারা সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রের কল্যাণে নিবেদিত। যেখানে আধুনিকতার বার্তাগুলাে প্রযুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।