গতানুগতিকতা বর্জিত বৃহত্তর সমাজ পটভূমিতে মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গলকাব্য’টি রচিত। কাব্যো যে চরিত্রগুলি বর্ণিত হয়েছে তা সমাজ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চরিত্রগুলির মধ্যে যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, কপটতা ঘনীভূত হয়েছে তা সমাজের বৈষম্যকে প্রকটিত করেছে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে সমসাময়িক বাঙালী জীবনের বিভিন্ন ধারাগুলি পৃথক পৃথকভাবে ফুটে উঠেছে। প্রাত্যাহিক জীবনের সুখদুঃখ, আশা-নিরাশা, ব্যথা-বেদনা এবং প্রচলিত জীবনের সামগ্রিক কাহিনির পরিচয় মেলে।
মানুষের জীবন চর্চায় মধ্যযুগীয় বর্ণভেদ ও জাতিভেদ ব্যবস্থার ব্যাপারকে আমল দেননি মুকুন্দরাম। তা নাহলে গুজরাট নগরে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ গোপ-ধীবরদের সঙ্গে মুসলমানদের সমন্বয় সাধন করতেন না কবি-
‘ছেলেমানি মালা করে যপে পীরে পেগাম্বারে
পীরের মোকাম দেয় সাঁঝ।।”
এর সাথে সাথে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন বুলান মণ্ডলের সঙ্গে কালকেতুর কথোপকথনে—
“শুন ভাই বুলান মণ্ডল।
আমার নগরে বৈস যত ইচ্ছা চাষ চষ
তিনসন বহি দিত্ত কর।।”
মঙ্গলকাব্যে দেব-দেবীর কাহিনি বর্ণনা করে অলৌকিতাকে প্রকাশ করলেও মুকুন্দরামের উদ্দেশ্য সামাজিক অবস্থাকে পরিস্ফুটন করা। কুলীন ঘরে আট বৎসরের কন্যার বিবাহের জন্য দুঃশ্চিন্তা, বয়স্ক কুলীন বরের সাথে জাত কূল রক্ষার্থে নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেওয়া—এই সব কাহিনি তৎকালীন বাঙালী সমাজের আলেখ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তারপর শিবের ঘরজামাই থাকা, মা মেনকা ও মেয়ে পার্বতীর সঙ্গে সাংসারিক কলহ এগুলিতো বাস্তব চিত্র। হরগৌরীর সংসারে নিত্য দারিদ্র্য দুঃখ-দীর্ণ সাংসারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
কিছু কিছু কাহিনি কৌতুকরসে মিশ্রিত হলেও তাতে সমাজচিত্রের পূর্ণরূপ প্রকাশিত। মুকুন্দরাম ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ অংশে বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—
তৈল বিনা কৈল স্নান করিনু উদক পান
শিশু কাঁদে ওদনের তরে।
কালকেতুর কাহিনিতে আমরা তৎকালীন নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমাজব্যবস্থার সুন্দর পরিচয় পাই। ব্যাধ জাতি কি ভাবে ভয়কে তুচ্ছ করে বনে জঙ্গলে ঘুরেঘুরে পশু শিকার করে, পশু শিকার না হলে কি কষ্ট সহ্য করতে হয়, ক্ষুধাকে তুচ্ছ মনে করতে হয় তার জ্বলন্ত ছবিও পাওয়া গেছে। ব্যাধ গৃহিণীরাও দুঃখ দারিদ্র্যকে এড়াতে পসরা নিয়ে হাটে গিয়ে সাংসারিক জীবনকে কিছুটা স্বচ্ছলতা দিতে কুণ্ঠা বোধ যে করেনি তা প্রকাশিত।
কালকেতু ব্যাধ সস্তান হয়েও জন্ম থেকে বিবাহ পর্যন্ত আচার অনুষ্ঠানে প্রাগাধুনিক বাঙালী জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ আচার-আচরণকে ফুটিয়ে তুলেছে। তারপর পিতা মাতাকে কাশীধামে পাঠান ব্যাপারটা উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজকে অনুকরণ করে রচিত। একটা আদর্শবান কর্মঠ সন্তানের কাছ থেকে বৃদ্ধা পিতামাতা যা যা স্বাচ্ছল্য আশা করে তাই তাই এ কাহিনিতে বর্ণিত। ফুল্লরার বারমাস্যাতে ব্যাধ সমাজ জীবনের বেশ কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। বৈশাখ ও কার্তিক মাস ছিল নিয়ম সেবার মাস-গৃহস্থরা এই সময় নিরামিষ আহার করেন, আশ্বিন মাসে ঘরে ঘরে অম্বিকা পূজা হতো, প্রসাদ ঘরে ঘরে পশু বলি হত এবং বিলিও হত। বর্ষায় গৃহস্থঘরের খাদ্যাভাব দেখা দিত। শীতে দরিদ্রের সম্বল ছিল— ‘জানু-ভান-কৃশানু’ এবং সম্পন্ন গৃহস্থের ‘তৈল-তুলা-তনুনপাৎ-তাম্বুল-তপন’।
মঙ্গলকাব্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে এর দেব-মাহাত্ম্য-এর অন্তরালে সামাজিক সুখ দুঃখের জীবন মেলে। হাস্য, করুণা, বীরত্বের রসঘন কাহিনির মধ্যদিয়ে কবি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যেমন রক্ত-মাংস হাড়কে বাদদিলে মানবদেহের কোনও অস্তিত্ব থাকে না ঠিক তেমনিই সমাজকে বাদ দিয়ে নায়ক-নায়িকা, রস-অভিজ্ঞতা, আচার আচরণ কাহিনিধারা প্রাধান্য পেতে পারে না। তাই বলা হয় মুকুন্দরাম একালে জন্মালে একজন সার্থক ঔপন্যাসিক হয়ে পাঠক সমক্ষে হাজির হতেন।
Leave a comment