সমস্যামূলক পরিস্থিতি হল এমন এক অন্তরায়, যা লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌছােতে বাধা দেয়। এই সমস্যা সম্পর্কে জানার পর মানুষ নতুন আচরণ বা কৌশল অবলম্বন করে, যার মাধ্যমে সমস্যাসমাধানমূলক শিখন ঘটে। এই শিখন কতকগুলি কৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

সমস্যাসমাধানমূলক শিখন কৌশল সাধারণত দুই রকমের হয়— 

  • প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখন : অনেকের মতে, শিক্ষার্থীরা প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে সমস্যাসমাধান করে। ভুল প্রচেষ্টাগুলি বাদ দেয় ও সঠিক প্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট করে।
  • অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে শিখন : অনেক মনােবিদ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা সমস্যাসমাধান করে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে। অর্থাৎ সমস্যাটি নিজের মনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই সমাধান হয়ে যায়।

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের পরীক্ষা

প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের প্রবক্তা হিসেবে আমেরিকার মনােবিদ এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেন, প্রাণী যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন সমাধানের জন্য বারবার প্রচেষ্টা করে এবং ভুল করে। একসময় উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সঠিক সংযােগসাধনের মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধান করে ফেলে। এইভাবে প্রাণীর শিখন সম্ভব হয়। থর্নডাইক তার শিখনের এই কৌশলকে নির্বাচন (Selection) ও  সংযােজন (Connection) বলেছেন। থর্নডাইক তার এই তত্ত্বের সপক্ষে বিড়াল, মুরগি, কুকুর, মানুষ প্রভৃতি প্রাণী নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এক্ষেত্রে বিড়ালের পরীক্ষাটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি তার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা করেছেন তিনটি সূত্রের দ্বারা, যথা一

  • (1) প্রস্তুতির সূত্র (Law of Readiness), 
  • (2) অনুশীলনের সূত্র (Law of Exercise) 
  • (3) ফললাভের সূত্র।

(A) পরীক্ষার উপকরণ: থর্নডাইক তার শিখন কৌশলের পরীক্ষার জন্য উপকরণ হিসেবে একটি বিড়াল, বিশেষভাবে প্রস্তুত পাজল বক্স, খাদ্যবস্তু হিসেবে কিছু মাছ এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ নিয়েছিলেন।

(B) পাজল বক্স: বিশেষ যান্ত্রিক কৌশলে পাজল বাক্সটি তৈরি। এই | বাক্সের একটিমাত্র গলিপথ থাকে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য, যা ছিটকানি দিয়ে আটকানাে থাকে। ছিটকানির সঙ্গে মেঝেতে একটি বােতামের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে বােতামে চাপ পড়লে বাক্সের দরজা খুলে যায়।

(C) পরীক্ষা :

  • প্রথমে থনডাইক একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে পাজল বক্সের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ছিটকানি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং বাইরে খাদ্যবস্তু হিসেবে কিছু মাছ রাখলেন। এরপর থাইকবিড়ালটির আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। দেখলেন, বাক্সের ভিতর থেকে বিড়ালটি বেরিয়ে বাইরে রাখা বাক্সের মাছ খাওয়ার জন্য বাক্সের মধ্যে এলােপাতাড়ি আচরণ করছে। এক্ষেত্রে চাহিদা ও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে বাধা হয়ে আছে পাজল বক্সের দরজা। কিন্তু বিড়ালটি ক্রমাগত এলােপাতাড়ি ছােটাছুটি করতে করতে হঠাৎ শরীরের কোনাে অংশের দ্বারা। বােতামে চাপ পড়ে বাক্সের দরজা খুলে যায় এবং বিড়ালটি বেরিয়ে। এসে খাদ্যবস্তু খেয়ে ফেলে।
  • বিড়ালটি প্রথমবার বেরিয়ে আসার পর পুনরাবৃত্তিমূলক পরীক্ষার জন্য ক্ষুধার্ত বিড়ালটিকে আবার পাজল বক্সের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। এক্ষেত্রে দেখা গেল, বিড়ালটি আর বিক্ষিপ্তভাবে দৌড়াদৌড়ি করছেনা। বিড়ালটি উদ্দেশ্যমুখী হয়ে গলিপথ খোঁজার। চেষ্টা করছে বেরিয়ে আসার জন্য। আরও দেখা গেল, বিড়ালটি পূর্বের ভুল আচরণগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে। পুনরাবৃত্তি করছে না এবং পূর্বের থেকে অনেক কম সময়ে বক্স থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে। এভাবে বারবার পুনরাবৃত্তিতে লক্ষ করা গেল, বিড়ালটি ক্রমশ নিজের ভুল প্রচেষ্টাগুলি পরিত্যাগ করছে এবং নির্ভুল প্রচেষ্টাগুলিকে সমস্যাসমাধানের পথ হিসেবে আচরণের স্থায়ী রূপে গ্রহণ করছে।
  • পরবর্তী পর্যায়ের পুনরাবৃত্তির পরীক্ষায় দেখা গেল, বিড়ালটির পাজল বক্স থেকে বেরিয়ে আসার আচরণ সম্পাদন করতে ক্রমশ সময়ের পরিমাণ কমে আসছিল। অর্থাৎ পুনরাবৃত্তির সংখ্যা যত বেড়েছে, সময়ের পরিমাণ তত কমেছে। এক্ষেত্রে থনড়াইক পুনরাবৃত্তির সংখ্যার সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক বােঝাতে একটি টাইম | কার্ভনামে লেখচিত্র ব্যবহার করেন। লেখচিত্রটি নীচে দেওয়া হল ー

(D) টাইম কার্ভ: থাইক মােট ২৪ বার পরীক্ষাটি করেছিলেন। প্রথমবার সময় লেগেছিল ১৬০ সেকেন্ড এবং ২৪ তম বারে সময় লেগেছিল মাত্র ৭ সেকেন্ড।

(E) সিদ্ধান্ত: থাইক তার পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্তে আসেন যে, উদ্দীপক ও তার উপযােগী সঠিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যথাযথ সংযােগ স্থাপন করতে পারলে শিখন সম্ভব। যেমন- বিড়ালটি পাজল বক্স থেকে যথাযথ প্রতিক্রিয়া করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। সমগ্র পরীক্ষায় বিড়ালটির যে সমস্ত আচরণ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌছােন তা নিম্নে দেওয়া হলー

তিনি তার পরীক্ষা থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন— (1) প্রাণী সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষভাবে সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে শেখে। (2) পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শিখনের স্থায়ীকরণ হয়। (3) আত্মসক্রিয়তা শিখনের মূল ভিত্তি।