১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান ড. বি আর আম্বেদকর সংবিধানসভার শেষভাষণে বলেছিলেন শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্যের প্রয়ােজন। ভারতীয় সংবিধানে যে-সমস্ত মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল সমসুযােগের অধিকার। ২৯নং ধারায় বলা হয়েছে যে, ধর্ম, জাতি ও ভাষার অজুহাতে কোনাে শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

শিক্ষায় সমসুযােগের প্রকৃত অর্থ হল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক সংগতি, স্ত্রী-পুরুষ অথবা অঞ্চল নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিজস্ব প্রবণতা ও দক্ষতা অনুসারে আত্মবিকাশের অধিকারী হওয়া। রাষ্ট্রের সাধ্যানুসারে সকলের প্রয়ােজনমতাে সর্বোত্তম শিক্ষার সুযােগ দেওয়ার জন্য ব্যয় করা শিক্ষার সমানাধিকারের মূলকথা।

সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে আর্থিক সংগতির ভিত্তিতে শিক্ষায় শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই নীতিগতভাবে হলেও সম-অধিকারের স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। আর্থিক অসাম্যের জন্য সমাজে শিক্ষায় প্রকৃত সমসুযােগ সম্ভব নয়। জনকল্যাণকর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে শিক্ষার সব দায়িত্ব থাকলেই সমতা আশা করা যায়।

আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের অধিকারের কথা প্রসঙ্গে জন্মগত অধিকারের কথা বলা নেই। শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টি করা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক লক্ষ্য। এর মাধ্যমেই পশ্চাৎপদ বা সুযােগ-বঞ্চিত শ্রেণির মানুষ নিজেদের উন্নয়নকে সফল করতে পারে। সংবিধানেও শিক্ষার জন্মগত অধিকারকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। কোঠারি কমিশনের সুপারিশে শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টির কথা তাই গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে। এই সুযােগ সৃষ্টির প্রয়ােজন হয় নানা কারণে, যেমন—

(১) গণতন্ত্রকে সার্থক করার জন্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টি করা প্রয়ােজন।

(২) সম্ভাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটার সুযােগ করে দিয়ে সমাজের উন্নতি ঘটানাের প্রয়ােজন।

(৩) শিক্ষাগত দিক থেকে বৈষম্যহীন সমাজ (egalitarian society) গড়ে তােলার অন্যতম শর্ত ও ভিত্তি হল প্রতিটি স্তরের মানুষের শিক্ষার সমসুযােগের ব্যবস্থা করা।

(৪) রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য প্রত্যেকের শিক্ষার সমসুযোেগ প্রয়ােজন।

(৫) অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে উন্নত ও দুর্বলশ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষার ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টির প্রয়ােজন।

(৬) দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়ােজন শিক্ষার সমসুযােগ সৃষ্টি।

(৭) উৎপাদনশীল ও দক্ষ নাগরিক তৈরি করার জন্য শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টির প্রয়ােজন।

(৮) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ধারাকে সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য প্রয়ােজন শিক্ষার সমসুযােগ।

(৯) ব্যক্তিবিশেষই হল গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই প্রত্যেক ব্যক্তি যেন তার ক্ষমতা, প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে এবং নিজের প্রয়ােজন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের নিরিখে ইচ্ছা, ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষালাভ করতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখে শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টির প্রয়ােজন।

বর্তমানের প্রতিযােগিতামূলক, জীবিকাভিত্তিক সমাজের উচ্চাশা পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সমসুযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না , তবে কিছু ব্যবস্থাপনার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সমসুযােগ আনয়ন করা যেতে পারে। সেগুলি হল—

(১) শিক্ষার মানােন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের উৎসাহদানের জন্য রাজ্যভিত্তিক এবং জাতীয় স্তরভিত্তিক ছাত্রবৃত্তি, ঋণবৃত্তি প্রদান করা।

(২) শিক্ষায় উৎসাহী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যাদের গৃহপরিবেশ শিক্ষার উপযােগী নয় তাদের শিক্ষামূলক উন্নয়নের জন্য ‘Day Centre’ -এর ব্যবস্থাকরণ।

(৩) শিক্ষায় সমসুযােগের জন্য ‘Earn while you learn’ স্কিম গ্রহণ করা যেতে পারে।

(৪) শিশুশ্রমিক প্রথা বন্ধ করা উচিত এবং সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য নিয়ে যেতে হবে।

(৫) শিক্ষায় সমসুযােগ আনার জন্য জাতীয় সংহতি বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৬) তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতিদের বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করে সমসুযােগে নিয়ে আসতে হবে। যেমন—বৃত্তিদান, ছাত্রাবাস, নিজস্ব ভাষায় শিক্ষাদান।

(৭) সংখ্যালঘুদের শিক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সমসুযােগ তৈরি করা। যেমন তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক রচনা ইত্যাদি।

(৮) বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে সমসুযােগকে কার্যকরী‌ করা।

(৯) নির্দেশাত্মক নীতির ৪৬নং ধারা কার্যকরীভাবে প্রয়ােগ করে সামাজিক অবিচার ও অত্যাচারের হাত থেকে তপশিলি জাতি ও উপজাতি-সহ দুর্বল শ্রেণির মানুষদের আর্থিক ও শিক্ষামূলক উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

(১০) মুক্ত বিদ্যালয় ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক এবং চাহিদামতাে পরিচালনা করতে হবে।

(১১) সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উৎপাদনশীল ও দক্ষ নাগরিক তৈরি করার জন্য শিক্ষায় সমসুযােগ কার্যকরী করা।

(১২) শিক্ষায় সমসুযােগ দানের উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমী শিশুদের শিক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন— ব্যতিক্রমী শিশুদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন, অতিরিক্ত সুযােগসুবিধা প্রদান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

শুধুমাত্র নীতি নির্ধারণ ও কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে এর সুরাহা হবে না। এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষাই আনে সচেতনতা, তার জন্য চাই সকলের শিক্ষা।