সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের প্রারম্ভেই দেখা যায়, শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারির থমথমে রাত্রি পরিবেশ। রাতের নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি গাড়ির টহল। রাতের শহরের এরকম পরিস্থিতির মূলে রয়েছে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট তৎকালীন মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর আহ্বান। আর তারই অনিবার্য ফলশ্রুতিতে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ক্রমশ এই দাঙ্গা সারা বাংলা হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন প্রবল বিশ্বাসহীনতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, সন্দেহ আর আক্রোশ। স্বার্থসর্বস্ব, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির নির্মম নিষ্পেষণে অগণিত নিরপরাধ সাধারণ মানুষের জীবন মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত। এমনই এক মানবতাবিরোধী অন্ধকার ভূমিতে দাঁড়িয়ে ‘আদাব’-এর হিন্দু সুতা-শ্রমিক এবং মুসলমান মাঝি চরিত্র দুটি।

আলোচ্য গল্পটিতে সমরেশ বসুর লেখনী থেকে আমরা জানতে পারি, হিন্দু-মুসলমানের মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়েছে দা, সড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে। চতুর্দিকে দাঙ্গাকারীদের উল্লাস, বস্তিতে বস্তিতে আগুন আর মরণভীত নারী-শিশুদের কাতর আর্তনাদ। এমন রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে প্রাণভয়ে ভীত একটি লোক আশ্রয় নেয় দুটি গলির মধ্যবর্তী স্থানে রাখা এক ডাস্টবিনের আড়ালে। অপর পাশে তারই মতো আরেকটি লোক ভীত-সন্ত্রস্ত। স্থির চার চোখের দৃষ্টি ভয়ে, সন্দেহে, উত্তেজনায় তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। উভয়েই উভয়কে খুনি বলে মনে করে। চোখে চোখ রেখে উভয়েই অপেক্ষা করে থাকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের। দাঙ্গার বিষাক্ত পরিবেশে অবস্থান করে উভয়ের কাছেই তখন অন্যপক্ষের জাতের প্রশ্ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা হিন্দু না মুসলমান—এ প্রশ্নের উত্তর পেলেই হয়তো পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। একে অপরকে বিধর্মী বলে জানতে পারলে তখন তারা পরস্পরকে শত্রু বলে চিহ্নিত করে একে অপরের প্রাণ নেওয়ার জন্য হয়তো চরম হিংস্র ও সশস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু তখনো পর্যন্ত কোনো পরিচয় প্রকাশিত না হওয়ায় বাস্তবে কোনো আক্রমণ ঘটে না। সংশয়ে, অবিশ্বাসে এই দুই সাধারণ মানুষের মন দোলায়িত হতে থাকে। ক্রমশ পরিস্কার হয় তাদের পেশা, জানা যায় তাদের আবাসস্থল। একজন ‘নারাইনগঞ্জের’ সুতাকলের শ্রমিক, অপরজন নৌকোর মাঝি, বাড়ি ‘বুড়িগঙ্গার হেইপারে সুবইডায়’। প্রাথমিক এই পরিচয় পাওয়ার পরেও বিশ্বাসহীনতা দানা বেঁধে থাকে তাদের মনের মাঝে। অলক্ষ্যে অন্ধকারের মধ্যে দুজনে দুজনের চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করে। উভয়ে উভয়ের পোশাক-পরিচ্ছদটাও খুঁটিয়ে দেখতে চায়, যদি সেসবের মধ্য দিয়ে উভয়ের জাতকে, সম্প্রদায়কে সনাক্ত করা যায়, তাহলে তারা একে অপরের সম্পর্কে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারে। কিন্তু তাদের এই অভীষ্ট সিদ্ধির পথে বিঘ্নস্বরূপ হয়ে ওঠে অন্ধকার আর ডাস্টবিনের আড়াল। মানবতার নক্ষত্রখচিত আকাশ তখন আচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে।

তবুও সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় সুতাকলের শ্রমিক ও নৌকোর মাঝির আতঙ্ক, অবিশ্বাস ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। এসময় হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও একটা শোরগোল শোনা যায়। হিন্দু ও মুসলমান—দুপক্ষেরই উন্মত্ত, রক্তপিপাসু কণ্ঠের ধ্বনি কানে আসে তাদের; যার পরিণামে আরো কিছু মানুষের জীবনে অকালমৃত্যু নেমে আসা প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। সেসব মানুষের জীবনের মূল্য তখন সাম্প্রদায়িক হানহানির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর সমান হয়ে যায়। তারা এই মৃত্যুশীতল পরিবেশের অসহায় শিকারে পর্যবসিত, অথচ এই পরিস্থিতি তৈরির পশ্চাতে তারা বিন্দুমাত্র দায়ী নয়। তাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ তারা আক্রমণকারীর বিপরীত ধর্মাবলম্বী মানুষ। আর এই কারণেই তাদের রক্তস্নাত দেহগুলো থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়াটা কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

সোরগোল দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পর অন্ধকার গলির মধ্যে ডাস্টবিনের দুই পাশে সুতাকলের শ্রমিক আর নৌকোর মাঝি চিন্তা করে নিজেদের বিপদের কথা, ঘরের কথা, মা-বউ-ছেলে-মেয়েদের কথা। তারা আর প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারবে কিনা-এ-আশঙ্কায় তারা কম্পিত হয়। দুজনে দুঃখের সঙ্গে ভাবে, হঠাৎ বজ্রপাতের মতো দাঙ্গা নেমে আসায় চারিদিকে কেমন সন্দেহ আক্রোশের বিষ ছড়িয়ে পড়ল। এতদিন হাটে-বাজারে দোকানে কথাবার্তা-কলহাস্যে মুখরিত কত সুন্দর পরিবেশ ছিল। কিন্তু দাঙ্গার মৃত্যুহিম ছায়া নেমে আসতেই মারামারি কাটাকাটিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে লাগল। মানুষ যেন এক অভিশপ্ত জাত। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্প্রীতি নিমেষে উধাও হয়ে গিয়ে দুই জাতের মানুষ বোধ-বুদ্ধি বিচার বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে নির্মম হত্যালীলায় মেতে উঠল। এসব চিন্তা করে সুতা-শ্রমিক আর মাঝি দুঃখে-ক্ষোভে-হতাশায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। তাদের মতন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন আজ চরম সঙ্কটের সম্মুখীন।

বিড়ি খাওয়ার জন্য দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে মাঝি নিজের অজান্তেই ‘সোহান আল্লা!’ বলে ফেলে। এ-কথার মধ্য দিয়ে মাঝির মুসলমান-পরিচয় স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় সুতা-শ্রমিক সেই মুহূর্তে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তখন তার সন্দেহকালো দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মাঝির বগলের পুঁটুলিটার দিকে। ওর মধ্যে ঈদের পরব উপলক্ষে ছেলেমেয়ের জন্য দুটো জামা আর বিবির জন্য একটা শাড়ি আছে বলে মাঝি তাকে জানালেও সুতা-শ্রমিকের অবিশ্বাস দূর হতে চায় না। তারপর একসময় তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মাঝি এই দাঙ্গার কারণ জানতে চাইলে সুতা-শ্রমিক বলে—“দোষ তো তোমাগো ওই লিগওয়ালোগোই। তারাই তো লাগাইছে হেই কিয়ের সংগ্রামের নাম কইরা।’

দাঙ্গা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য কারফিউ-এর রাত্রে চারিদিকে মিলিটারি-পুলিশ টহল দিচ্ছে। মাঝি ও সুতা-শ্রমিক হঠাৎ শুনতে পায় তাদের ভারী বুটের শব্দ। মাঝির নির্দেশ মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তারা দুজনে পৌঁছায় পাটুয়াটুলি রোডে। ইংরেজ অফিসারের দৃষ্টি এড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকে দুজনে। অদূরে মুসলিম এলাকা, ইসলামপুর ফাঁড়ি। সেখানেই পৌঁছতে হবে মাঝিকে। তারপর বুড়িগঙ্গা পার হলেই তার বাড়ি। পরদিন ঈদ। এদিন বাড়ি ফিরলে সকলের আনন্দ। সোহাগী বিবি আর ‘পোলামাইয়া’ নতুন জামাকাপড়ের আশা করে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। বাড়ি তাকে যেতেই হবে। একরাশ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনা নিয়ে সুতা-শ্রমিক মাঝিকে বিদায় জানায়। একটু পরেই মাঝির গমনপথের দিকে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রে গর্জে ওঠে। উত্তেজিত সুতা শ্রমিক অনুমান করে যে, মাঝি বোধ হয় আর বাড়ি ফিরতে পারল না। তার বিহ্বল চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মাঝির বুকের রক্তে রাঙা হয়ে যাচ্ছে তার মেয়ে ও বিবির পোশাক।

আলোচ্য গল্পের আদি-মধ্য-অন্ত্য জুড়ে রয়েছে দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরের রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ। এই পরিবেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দূষিত। অন্ধ ভেদবুদ্ধির নির্বিবেক স্থূল উল্লাসে মত্ত কিছু হিন্দু ও মুসলমানের কাছে কবি-কথিত ‘মোরা একই বৃত্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’—এই মহৎ উচ্চারণ তখন উপহাস ও বিদ্রূপের বস্তু। এ গল্পে মাঝি আর সুতা-শ্রমিক আসলে দুই ধর্মের সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি: যারা কলুষমুক্ত ও নিরপরাধ হয়েও সাম্প্রদায়িক কলুষতার শিকার। ব্যক্তিগত জীবনে গভীর সংকট ঘনিয়ে এলেও যারা মানসিক সহমর্মিতায় অপর সংকটাপন্ন মানুষকে আপন করে নেওয়ার প্রতিভা রাখে।