সাধারণভাবে নামকরণ ব্যাপারটিকে আপাত লঘু ও বাহ্য ব্যাপার বলে মনে হলেও সাহিতো নামকরণ বিষয়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সাহিত্যের শিরোনামের মধ্য দিয়েই রচনার মূল বিষয় বা ভাবটি পাঠকের নিকট আভাসিত হয়ে ওঠে। সাধারণত ছোটগল্পের বিষয়বস্তু অথবা নায়ক নায়িকার নাম অনুসারে ছোটগল্পের নামকরণ হয়। আবার কখনো কখনো ছোটগল্পের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রধান বক্তব্য বা বিষয়কেই শিরোনামের মধ্যে আভাসিত করা হয়ে থাকে। ছোটগল্পের মূল বক্তব্য, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনদর্শনের গভীর প্রকাশ হয় বলেই সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে নামকরণের তাৎপর্য এত ব্যাপক। সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, এখানে মুসলমান সমাজে প্রচলিত পারস্পরিক বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপক একটি শব্দকে সরাসরি গল্পনাম হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন উক্ত ছোটগল্পের প্রেক্ষিতে নামকরণটি কতদূর সার্থকতায় মণ্ডিত হয়ে উঠেছে, সেটাই আমাদের আলোচ্য।
বিদায়জ্ঞাপক শব্দ ‘আদাব’ মূলত একটি আরবি শব্দ। শ্রদ্ধা, প্রীতি বা স্নেহভাজন ব্যক্তির স্থান ত্যাগ উপলক্ষে এই শব্দটিকে মুসলমানেরা ব্যবহার করে থাকেন। আলোচ্য গল্পেও সুতা-মজুরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে মুসলমান মাঝির উত্তিতে এই ‘আদাব’ শব্দটি আমরা পাই। কিন্তু এই গল্পের কাহিনীর ধারা অনুসরণ করে পরিণতিতে পৌঁছলে বোঝা যায়, মানব ইতিহাসের এক বিশেষ সংকটজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিছক বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপনের সীমা ছাড়িয়ে আরো গভীরতর মাত্রায় ব্যঞ্ছিত হয়ে উঠেছে উক্ত ‘আদাব’ শব্দটি।
১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট তৎকালীন মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর ডাক দিলে সারা বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের যে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, তারই পটভূমিতে আলোচ্য গল্পটি রচিত হয়েছে। এর কাহিনীর শুরু বিভীষিকাময় দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে। দা, সড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে তখন উন্মত্ত হিন্দু মুসলমান তৈরি পরস্পরকে নিধন করবার জন্য। চতুর্দিকে দাঙ্গাকারীদের উল্লাস, বস্তিতে আগুন আর মরণভীত নারী শিশুদের কাতর আর্তনাদ। এর মধ্যে রয়েছে শাসনকর্তার কারফিউ অর্ডার এবং ১৪৪ ধারা। মানুষের জীবনের মূল্য তখন নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর সমান। তারা এই মৃত্যুনিথর পরিবেশের অসহায় শিকার, অথচ এই পরিস্থিতি তৈরির পশ্চাতে তারা বিন্দুমাত্র দায়ী নয়। তাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ তারা হিন্দু কিংবা মুসলিম ধর্মাবলম্বী। আর কেবল এই কারণেই তাদের রক্তস্নাত দেহগুলো থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়াটা কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। পঙ্কিল রাজনীতির আবর্তে স্বার্থসর্বস্ব, মনুষ্যত্ববর্জিত মুষ্টিমেয় নেতাদের ‘কৃপায়’ এইসব সাধারণ মানুষেরা তখন অকালে নিজেদের জীবনকেই ‘আদাব’ জানাতে বাধ্য।
আলোচ্য গল্পের কাহিনীতে আমরা দেখি, দাঙ্গার রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে প্রাণ ভয়ে ভীত একটি লোক আশ্রয় নেয় দুটি গলির মধ্যবর্তী স্থানে রাখা এক ডাস্টবিনের আড়ালে। পড়ে থাকে নিঃসাড়ে, মাথা তোলার সাহসটুকুও তখন তার লুপ্ত। এমন সময় নড়ে ওঠে ডাস্টবিনটা। অপর পাশে তারই মতো আর একটি লোক ভীত-সন্ত্রস্ত। দুজনেই দুজনকে অবিশ্বাস করে। তীব্র শঙ্কায় আর সন্দেহে অপেক্ষা করে থাকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের। কিন্তু আক্রমণ যখন আসে না, উৎকণ্ঠায় অধৈর্য হয়ে তখন শুরু হয় পরিচয়ের পালা। একজন ‘নারাইনগঞ্জের’ সুতাকলের শ্রমিক, অপরজন নৌকোর মাঝি, বাড়ি ‘বুড়িগঙ্গার হেইপারে সুবইডায়। নৌকার মাঝি মুসলমান আর সুতাকলের শ্রমিক হিন্দু। প্রাথমিক পরিচয়ের পরেও বিশ্বাসহীনতা দানা বেঁধে থাকে মনের মাঝে। সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় আতঙ্ক আর অবিশ্বাস ধীরে ধীরে দূরে সরতে থাকে। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা বাড়ে—’তুমি চইলা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি?’ ক্রমশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু আত্মীয়ের মতো পরস্পর কথা বলে। দাঙ্গার জন্য ব্যাবসার ক্ষয়ক্ষতি, পারিবারিক অসহায়তা, অযথা প্রাণহানি এবং শোচনীয় পরিস্থিতির প্রসঙ্গ ওঠে। ‘আদাব’ তখনো দূরে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। বিশেষত মুসলমান মাঝিকে সুদূর এক নিস্তব্ধ উপত্যকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সে তৈরি।
সুতা-শ্রমিক আর মাঝি হঠাৎ শুনতে পায় টহলদারি পুলিশের ভারী বুটের শব্দ। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তারা পৌঁছায় পাটুয়াটুলি রোডে। ইংরেজ অফিসারের দৃষ্টি এড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকে দুজনে। অদূরে মুসলিম এলাকা, ইসলামপুর ফাঁড়ি। সেখানেই পৌঁছতে হবে মাঝিকে। তারপর বুড়িগঙ্গা পার হলেই তার বাড়ি। পরদিন ঈদ। এদিন মাঝি বাড়ি ফিরলে সকলের আনন্দ। সোহাগী বিবি আর ‘পোলামাইয়া’ অধীর অপেক্ষায় রয়েছে তার আনা নতুন জামাকাপড়ের আশায়। বাড়ি তাকে যেতেই হবে। যাওয়ার সময় মাঝি সুতা-শ্রমিককে বলে—’যাই…ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার লগে মোলাকাত হইব। আদাব।’ সুতা-শ্রমিক হিন্দু হয়েও গভীর আন্তরিকতায় মাঝিকে ‘আদাব’ জানায়। তারপর সে ভাবতে থাকে, মাঝি বাড়ি ফিরলে তার বিবির সোহাগের কথা, মেয়ের আনন্দের কথা। আলোচ্য গল্পের এই স্থান পর্যন্ত ‘আদাব’ শব্দটি পারস্পরিক বিদায়-সম্ভাষণের অতিরিক্ত অন্য কোনো অর্থ বহন করে না। অল্প সময়ের মধ্যে ভিন্নধর্মাবলম্বী দুটি মানুষের ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের পর দাঙ্গার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে তাদের বিচ্ছেদ পাঠকমনে যদিও এক কারুণ্যের বেদনা জাগায়।
গল্পের শেষাংশে এসে আমরা চমকে উঠি মুসলমান মাঝির বাসনা আর বাস্তবের মধ্যে নিষ্ঠুর বৈপরীত্য দেখে। সুতা শ্রমিকের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার একটু পরেই পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। উত্তেজিত সুতা শ্রমিক অনুমান করে যে, মাঝি বোধহয় আর বাড়ি ফিরতে পারল না। তার বিহ্বল চোখের সামনে ভেসে ওঠে. মাঝির বুকের রক্তে রাঙা হয়ে যাচ্ছে তার মেয়ে ও বিবির পোশাক। যন্ত্রণাকাতর মাঝি যেন তাকে বলছে ‘পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিনে। দুশমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগো কাছে।’ আমরা বুঝতে পারি, ক্ষমতা ও অহংসর্বস্ব এই ‘দুশমনরাই মাঝির সংসার-উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন-সাধ-ভালবাসাকে নিঃশেষে দলে-পিষে দিল। মাঝি তার নিজের জীবনকেই যেন ‘আদাব’ জানাতে বাধ্য হল অকালে। আবার মাঝি কেবল একা নয়, ১৯৪৬-এর দাঙ্গা-বিধস্ত বাংলায় অসংখ্য হিন্দু-মুসলমানকে এভাবে অকালে ‘আদাব’ জানাবার শিকার হতে হয়েছিল।
‘আদাব’ গল্পটিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে দেখলে অন্য আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আদাব’ শব্দটি মানবিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান বহন করে। রাজনীতির নির্মম নিষ্পেষণে বিশেষ যুগে-কালে নিরপরাধ অগণিত সাধারণ মানুষ মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত হতে পারে, কিন্তু মানুষের পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব চিরকালীন। তা সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন হলেও মৃত্যুঞ্জয়ী। আর এই অমর সম্প্রীতির স্পষ্ট স্বাক্ষর আলোচ্য গল্পের এই ‘আদাব’ শব্দটি। সন্দেহ, হিংসা, ভীতি, বিদ্বেষের অন্ধকার ভূমিতে দাঁড়িয়েও এ গল্পে হিন্দু ও মুসলমান দুটি মানুষ যেভাবে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়েছে, তার মানবিক আবেদন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের এবং শাসকের রক্তচক্ষুর অনেক ঊর্ধ্বে। সর্ববন্ধনমুক্ত মানবতার এক দিক-নির্দেশক হয়ে উঠেছে আলোচ্য গল্পের এই ‘আদাব’ শব্দটি। এভাবে এ গল্পে নিছক বিদায়জ্ঞাপক শব্দ হিসেবে না থেকে ‘আদাব’ শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির এক মহৎ মানবিক ব্যঞ্জনায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আলোচ্য গল্পের ‘আদাব’ নামকরণ সর্বাংশে সার্থক এবং কাহিনী ও চরিত্রের সঙ্গে তা যথার্থ সঙ্গতিপূর্ণ।
Leave a comment